অনুপাত বিশ্লেষণ কাকে বলে । অনুপাত বিশ্লেষণ কত প্রকার ও কি কি । অনুপাত বিশ্লেষণ সুবিধা ও অসুবিধা । অনুপাত বিশ্লেষণ গুরুত্ব
মনে করুন, একটি প্রতিষ্ঠানের চলতি সম্পদের পরিমাণ ২,০০,০০০ টাকা এবং চলতি দায়ের পরিমাণ ১,০০,০০০ টাকা। সুতরাং এদের অনুপাত হবে ২,০০,০০০ ১,০০,০০০ = ২:১ অর্থাৎ ১ টাকার চলতি দায়ের বিপরীতে ২ টাকার চলতি সম্পদ রয়েছে। অনুপাতের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকতা অপরিহার্য।
যেমন, মানুষের সাথে মানুষের অনুপাত, অর্থের সাথে অর্থের অনুপাত, যন্ত্রের সাথে যন্ত্রের অনুপাত ইত্যাদি। সুতরাং পরস্পর প্রাসঙ্গিক দুটি বিষয়ের মধ্যে অন্তর্নিহিত সম্পর্কের সংখ্যাগত পরিমাপকে অনুপাত বলে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো অনুপাত বিশ্লেষণের সংজ্ঞা অনুপাত বিশ্লেষণ কাকে বলে?
অনুপাত বিশ্লেষণ কাকে বলে :-
আমরা অনুপাতের সংজ্ঞা পূর্বে জানতে পেরেছি। বিভিন্ন ধরণের অনুপাত রয়েছে যার মাধ্যমে আর্থিক বিবরণীগুলো পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সাফল্যের মাত্রা নিরূপণ করা যায়। আর এ প্রক্রিয়াই হলো অনুপাত বিশ্লেষণ।
আপনি জানেন, আর্থিক বিবরণীগুলোতে যে সব দফা রয়েছে তার মধ্যে আছে পণ্য ক্রয়, পণ্য বিক্রয়, আয়-ব্যয়, লাভ-ক্ষতি, চলতি সম্পত্তি, স্থায়ী সম্পত্তি, মোট লাভ-ক্ষতি, মূলধন, দায় ইত্যাদি। এর একটির সাথে অন্যটির কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে। এক দফার সাথে অন্য দফার এ কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্য যখন অনুপাতকে ব্যবহার করা হয় তখন তাকে অনুপাত বিশ্লেষণ বলা হয়।
অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এ পদ্ধতিতে আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণণ করে থাকে। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা দেয়া হলো
I.M. Pandey বলেছেল, “অনুপাত বিশ্লেষণ হলো একটি প্রক্রিয়া যা একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সফলতা ও দুর্বলতা নির্দেশ করে।”
Khan & Jain বলেন, “অনুপাত বিশ্লেষণ হলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে অনুপাতের ব্যবহার যার সাহায্যে আর্থিক প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা করে একটি প্রতিষ্ঠানের সবলতা, দূর্বলতা, ঐতিহাসিক দক্ষতা ও বর্তমান আর্থিক অবস্থা নিরূপণ করা যায়।”
আই. এম. পান্ডে আরো বলেছেন, “অনুপাত বিশ্লেষণ বিপুল পরিমাণ আর্থিক তথ্যকে সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ এবং ফার্মের আর্থিক দক্ষতার গুণগত মান বিচার করতে সাহায্য করে।”
সুতরাং আমরা বলতে পারি, কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণীর বিভিন্ন দফার মধ্যেকার কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ধারণ, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও তা উপস্থাপনের জন্য অনুপাতকে যখন পর্যালোচনা বা বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় তখন তাকে অনুপাত বিশ্লেষণ বলে।
অনুপাত বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যাবলী :-
একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলীর সফলতা-ব্যর্থতার সাথে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের অনেক পক্ষের স্বার্থ জড়িত থাকে। যেমন, প্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, কর্মকর্তা, কর্মচারী, পাওনাদার, দেনাদার, সরকার, নিরীক্ষক, গবেষক প্রভৃতি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যবসার প্রকৃত অবস্থা জানতে আগ্রহী থাকে। এজন্য আর্থিক বিবরণীসমূহ তথা ক্রয় বিক্রয় হিসাব, লাভ-ক্ষতি হিসাব, লাভ-ক্ষতি কটন হিসাব, তহবিল প্রবাহ বিবরণী, উদ্বৃত্তপত্র ইত্যাদি বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষের চাহিদার আলোকে এ অনুপাত বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়। আর্থিক বিবরণী বা অনুপাত বিশ্লেষণের মূখ্য উদ্দেশ্যাবলী নিম্নে আলোচিত হলো –
১. তারল্য যাচাই :
তারল্য বলতে স্বল্প মেয়াদী ঋন পরিশোধের ক্ষমতাকে বুঝায়। অনুপাত বিশ্লেষণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ব্যবসার স্বল্প মেয়াদী ঋন পরিশোধের ক্ষমতা আছে কিনা তা যাচাই করা।
২. কর্মদক্ষতা যাচাই :
কর্মদক্ষতা সম্পদ ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত। বিভিন্ন সম্পদের সাথে বিক্রয়ের সম্পর্ক নির্ধারণ করে কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মতৎপরতা যাচাই করা যায়। অনুপাত বিশ্লেষণের অন্যতম মূখ্য উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের কর্ম দক্ষতা যাচাই করা।
৩. মুনাফার্জন ক্ষমতা যাচাই :
মুনাফা ব্যবসার মূল লক্ষ্য। কোন প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার মাধ্যম হলো মুনাফার্জন। অনুপাত বিশ্লেষণের মাধ্যমে মুনাফার্জন ক্ষমতা নিরূপণ করা যায়। সুতরাং মুনাফার্জন ক্ষমতা যাচাই এর অন্যতম মূখ্য উদ্দেশ্য।
৪. মূলধন কাঠামো যাচাই :
মূলধন কাঠামো বলতে ইকুইটি, ঋণ বা এতদোভয়ের সংমিশ্রণকে বুঝায়। ঋণের সাথে ঝুঁকি জড়িত। অধিক লাভের ক্ষেত্রে ঝুঁকি গ্রহণ খারাপ নয়। শুধু মাত্র ইকুইটি আবার রক্ষণশীলতার পরিচায়ক। মূলধন কাঠামো এজন্য একটি কাম্য সংমিশ্রণে হওয়া উচিৎ। অনুপাত বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর কামাতার মাত্রা জানা যায়। তাই অনুপাত বিশ্লেষণের অন্যতম মূখ্য উদ্দেশ্য হল প্রতিষ্ঠানের মূলধন কাঠামো যাচাই।
৫. দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক স্বচ্ছলতা বিশ্লেষণ :
কিছু অনুপাত বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক স্বচ্ছলতা কেমন তা জানা যায়। তাই অনুপাত বিশ্লেষণের মৌলিক উদ্দেশ্যের অন্যতম হলো প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক স্বচ্ছলতা বিশ্লেষণ।
৬. প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষমতা যাচাই :
ব্যবসা একটি প্রতিযোগীতার ক্ষেত্র। শিল্প গড় বা আদর্শ মানের সাথে প্রতিষ্ঠানের অর্জিত ফলাফলের কয়েকটি অনুপাত বিশ্লেষণ করলে প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার ক্ষমতা জানা যায়। সুতরাং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষমতা যাচাই করাও অনুপাত বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য।
[ বি:দ্র: উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)]
৭. সম্পদের কাম্য ব্যবহার বিশ্লেষণ :
সম্পদ যত ভাল ব্যবহার হবে প্রতিষ্ঠানের লাভজনকতা তত বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। অলস সম্পদ কখনো লাভার্জনে সহায়ক নয়। কিছু অনুপাত বিশ্লেষণের মাধ্যমে সম্পদ কাম্য মানে ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা জানা যায়। তাই সম্পদের কাম্য ব্যবহার বিশ্লেষণ অনুপাত বিশ্লেষণের অন্যতম মৌলিক উদ্দেশ্য।
৮. ব্যবস্থাপনার দক্ষতা যাচাই :
ব্যবস্থাপনা ভাল হলে প্রতিষ্ঠানের উত্তোরত্তর উন্নতি হয়। পরিবর্তনশীল অবস্থার সাথে ব্যবস্থাপনা সামঞ্জস্য বজায় রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাই অনুপাত বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য হল ব্যবস্থাপনার দক্ষতা যাচাই করা।
৯. প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থা মূল্যায়ন :
মালিক, বিনিয়োগকারী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঋণদাতা প্রভৃতি পক্ষ প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থা জানতে চায়। অনুপাত বিশ্লেষণে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক মূল্যায়ণ করা যায়। অতএব, অনুপাত বিশ্লেষণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থা মূল্যায়ন করা।
অনুপাত বিশ্লেষণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :-
আপনি জানেন আর্থিক বিবরণীগুলোতে প্রতিষ্ঠানের ক্রয়-বিক্রয়, আয়-ব্যয়, মোট নীট লাভ/ক্ষতি, চলতি ও দীর্ঘমেয়াদী দায়-দেনা, স্থায়ী ও চলতি সম্পদ, মূলধন কাঠামো ইত্যাদির প্রাথমিক ধারণা দেয়া থাকে।
ব্যবসার সাথে বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষ থাকে যারা ব্যবসার প্রকৃত অবস্থা কারণসহ জানতে চায়। এজন্য আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ দরকার। অনুপাত বিশ্লেষণ এর অন্যতম সর্বজন প্রিয় / সার্বজনিন মাধ্যম ও ব্যবস্থাপনীয় কৌশল। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত অবস্থা জানা যায়। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে এর গুরুত্ব আলোচনা করা হলো
১. ব্যবস্থাপনার (To Management) :
ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যবসার প্রকৃত জানা একান্ত দরকার এবং সংশোধনমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। এক্ষেত্রে অনুপাত বিশ্লেষণ বিরাট ভূমিকা রাখে।
২. বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে (To the Investors) :
যে প্রতিষ্ঠানের লাভ অর্জন ক্ষমতা বেশী বিনিয়োগকারীরা সে প্রতিষ্ঠানের দিকে বেশী গুরুত্ব দেয়। অনুপাত বিশ্লেষণের মাধ্যমে লাভার্জন ক্ষমতা জানা যায়। সুতরাং বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনুপাত বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৩. ঋণদাতাদের ক্ষেত্রে (To the Creditors) :
ঋণদাতারা ঋণ দানের পূর্বে প্রতিষ্ঠানে মূলধন কাঠামো ও ঋণ মূলধন অনুপাত কেমন তা জানতে চায়। অনুপাত বিশ্লেষণের মাধ্যমে এটা ভালভাবে জানা যায়। সুতরাং ঋণদাতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনুপাত বিশ্লেষণ বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
৪. সরবরাহকারীদের ক্ষেত্রে (To the Suppliers) :
পাওনাদার ও সরবরাহকারীরা প্রতিষ্ঠানের চলতি দেনা পরিশোধের ক্ষমতা আছে কিনা তা যাচাই করে ধারে পণ্য বিক্রয় করা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনুপাত বিশ্লেষণ চলতি দেনা পরিশোধের ক্ষমতা আছে কি না তা জানতে সাহায্য করে। এ জন্য সরবরাহকারীদের জন্য অনুপাত বিশ্লেষণ প্রয়োজনীয়।
৫. কর কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রে (To Tax Authority) :
কর ধার্য করতে হলে উপার্জন ক্ষমতা যাচাই করা দরকার হয়। অনুপাত বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপার্জন ক্ষমতা যাচাই করা যায়। সুতরাং কর কর্তৃপক্ষের কর ধার্যের সিদ্ধান্তের জন্য অনুপাত বিশ্লেষণ প্রয়োজনীয়।
৬. ব্যয় নিরূপণ ও খরচ নিয়ন্ত্রণ (Cost Determination and Cost Control) :
অনুপাত বিশ্লেষণ কাঁচামাল, মজুরী, উপরি খরচ ইত্যাদির মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক ও পরিমাণ নির্ণয়ে সাহায্য করে। আদর্শ খরচ ও প্রকৃত খরচের মধ্যে তুলনা করে ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হয়। এ তুলনার জন্য অনুপাত বিশ্লেষণ করা দরকার হয়। তাই এটার গুরুত্ব রয়েছে।