আলোচ্য বিষয়: আলোর প্রতিফলন

ডিপ্লোমা -ইন -ইঞ্জিনিয়ারিং ( সিভিল বিভাগ)
বিষয়ঃ পদার্থ বিজ্ঞান
আলোচ্য বিষয়: আলোর প্রতিফলন।
সেমিস্টার: ২য়
শিক্ষকের নাম: মাহাবুবা সিদ্দিকা।

আলোর প্রতিফলনঃ

যে সকল বস্তু নিজে থেকেই আলো বিকিরন করে তাদেরকে আলোক উৎস ( source of light ) বলা হয় ।
এই আলোক উৎস দুই ধরনের হতে পারে
i》স্বপ্রভ বা স্বয়ংপ্রভ উৎস ( luminous or self-luminous source ) ও
ii》নিষ্প্রভ বা অপ্রভ উৎস ( non-luminous source ) ।
স্বপ্রভ বা স্বয়ংপ্রভ উৎস হল সেইসব আলোক উৎস বা বস্তু যেগুলি নিজের আলো নিজেই বিকিরণ করে ( অর্থাৎ নিজের আলো নিজেই উৎপন্ন করে ) । যেমন :- সূর্য, নক্ষত্র, বৈদ্যুতিক বাল্ব, জ্বলন্ত মোমবাতি ইত্যাদি । অন্যদিকে যে সব বস্তুর নিজস্ব কোনো আলো নেই, স্বপ্রভ বস্তু থেকে পাওয়া আলো প্রতিফলিত করে আলোকিত হয়, সেইসব বস্তুকে নিষ্প্রভ বা অপ্রভ উৎস বলে ।
আমাদের চারপাশের বস্তুগুলির অধিকাংশই হল নিষ্প্রভ বস্তু । চাঁদ ও গ্রহগুলিও হল নিষ্প্রভ । এই বস্তুগুলি সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে বলেই আমরা এদেরকে আলোকিত দেখি । সুতরাং আলোর প্রতিফলন না ঘটলে আমরা কোনো নিষ্প্রভ বস্তুকেই দেখতে পেতাম না । যেমন দিনের বেলায় আকাশে সূর্য দেখতে পেতাম ঠিকই, কিন্তু রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ইত্যাদি সবকিছুই দৃষ্টির অগোচরে থাকত । স্পষ্টতই আলোর প্রতিফলন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ।

আলোর প্রতিফলনঃ

আলো কোন স্বচ্ছ মাধ্যমের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় অন্য কোন মাধ্যমে বাধা পেলে দুই মাধ্যমের বিভেদতল থেকে কিছু পরিমাণ আলো আগের মাধ্যমে ফিরে আসে, এ ঘটনাকে আলোর প্রতিফলন বলে।

আলোর প্রতিফলনর একটি অন্যতম উদাহরণ হল- সমতল দর্পণ বা আয়নার সামনে যখন আমরা দাঁড়াই তখন আমরা আমাদের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই।

দর্পণে আলোর প্রতিফলনের জন্যেই বিম্বের সৃষ্টি হয়। আলোর প্রতিফলন সাধারণত দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করেঃ

আলোর আপতন কোণ ও মাধ্যমগুলোর প্রকৃতি। আপতিত রশ্মি যত বেশি কোণে আপতিত হবে এবং প্রতিফলক যত বেশি মসৃণ হবে আলোর প্রতিফলন তত বেশি হবে। পক্ষান্তরে, আমসৃণ কিংবা স্বচ্ছ প্রতিফলক থেকে আলোর প্রতিফলন কম হয়।

প্রতিফলনের শ্রেণীবিভাগঃ

আলোর ব্যাপ্ত প্রতিফলনঃ

প্রতিফলক পৃষ্ঠের প্রকৃতি আনুযায়ী আলোর প্রতিফলন দু ধরনের হতে পারে।
যথাঃ

১। নিয়মিত প্রতিফলন ও
২।ব্যাপ্ত প্রতিফলন।

নিয়মিত প্রতিফলনঃ

যখন একগুচ্ছ সমান্তরাল আলোকরশ্মি কোন পৃষ্ঠে আপতিত হয়ে প্রতিফলনের পর সমান্তরাল থাকে বা অভিসারী কিংবা অপসারীগুচ্ছে পরিণত হয়,

তবে আলোর সেই প্রতিফলনকে নিয়মিত প্রতিফলন বলে। প্রতিফলক পৃষ্ঠ মসৃণ হলে যেমন- সমতল দর্পণে আলোর নিয়মিত প্রতিফলন হয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি আলোক রশ্মির আপতন কোণ সমান হয় ও প্রতিফলন কোণগুলোও সমান হয়।

গ্রিসের প্রখ্যাত গণিতবিদ এবং ইঞ্জিনিয়ার- হীরন সর্বপ্রথম আলোর নিয়মিত প্রতিফলনের ধর্ম লক্ষ্য করেন।

ব্যাপ্ত প্রতিফলনঃ

যদি একগুচ্ছ সমান্তরাল আলোক রশ্মি কোন পৃষ্ঠে আপতিত হয়ে প্রতিফলনের পর অসমান্তরাল হয় বা অভিসারী বা অপসারীগুচ্ছে পরিণত না হয় তবে আলোর সেই প্রতিফলনকে ব্যাপ্ত প্রতিফলন বলে। প্রতিফলক পৃষ্ঠ সমান্তরাল না হলে এরূপ হয়।

এক্ষেত্রে সমান্তরাল রশ্মিগুলো প্রতিফলকপৃষ্ঠের বিভিন্ন বিন্দুতে বিভিন্ন কোণে আপতিত হয় বলে তাদের প্রতিফলন কোণও আলাদা হয়।প্রতিফলন এর উদাহরণ হিসেবে আয়না বলা যায়।

গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংজ্ঞাঃ

নিম্নে আপতিত রশ্মি, আপতন বিন্দু, অভিলম্ব, প্রতিফলিত রশ্মি, আপতন কোণ, প্রতিফলন কোণ এর সংজ্ঞা দেওয়া হল:

আপতিত রশ্মিঃ

যে রশ্মি প্রতিফলকের উপর এসে পড়ে তাকে আপতিত রশ্মি বলে

আপতন বিন্দুঃ

আপতিত রশ্মি প্রতিফলকের উপর যে বিন্দুতে এসে পড়ে তাকে আপতন বিন্দু বলে।

অভিলম্বঃ

আপতন বিন্দুতে প্রতিফলকের উপর অঙ্কিত লম্বকে অভিলম্ব বলে।

প্রতিফলিত রশ্মিঃ

প্রতিফলকে বাধা পেয়ে যে রশ্মি আগের মাধ্যমে ফিরে আসে তাকে প্রতিফলিত রশ্মি বলে।

আপতন কোণঃ

আপতিত রশ্মি ও অভিলম্বের মধ্যবর্তী কোণকে আপতন কোণ বলে। একে “i” দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

প্রতিফলন কোণঃ

প্রতিফলিত রশ্মি অভিলম্বের সাথে যে কোণ উৎপন্ন করে তাকে প্রতিফলন কোণ বলে। একে “r” দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

আলোর প্রকৃতি:
যখন কোনো আলোক উৎস থেকে আলো সরাসরি আমাদের চোখে আসে তখন আমরা উৎসটি দেখতে পাই।

আলোক উৎস থেকে নির্গত আলো কোনো বস্তুর পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত হয়ে যখন আমাদের চোখে আসে তখনও আমরা বস্তুটি দেখতে পাই।

আলো হচ্ছে এক প্রকার শক্তি বা বাহ্যিক কারণ যা আমাদের দেখতে সাহায্য করে বা দর্শনের অনুভূতি সৃষ্টি করে

আলো হলো এক প্রকার শক্তি যার মাধ্যমে আমরা কোনো বস্তু দেখতে পাই।

আমরা যখন কানো বস্তু দেখি, তখন বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে আসে। চোখে প্রবিষ্ট আলো চোখের রেটিনায় বস্তুটির প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে এবং জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কে বস্তুটির অনুরূপ একটি বস্তুর অনুভূতি সৃষ্টি করে।

প্রাচীনকাল হতে মানুষ আলোর প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভের চেষ্টা করে আসছে। এক সময় ধারণা করা হতো আমাদের চোখ হতে আলো কোনো বস্তুর উপর পড়ে, তাই আমরা সেই বস্তু দেখতে পাই।

আসলে যখন কোনো বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে আসে, তখনই কেবল আমরা সেই বস্তু দেখতে পাই।

আলোর প্রধান প্রধান ধর্মগুলো নিম্নরূপ:
কোনো স্বচ্ছ সমসত্ব মাধ্যমে আলো সরলপথে চলে।
কোনো নির্দিষ্ট মাধ্যমে আলো একটি নির্দিষ্ট বেগে চলে। শূন্যস্থানে এই বেগের মান, c = 3 × 10 8 ms-1।
আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যতিচার, অপবর্তন, বিচ্ছুরণ এবং সমবর্তন ঘটে।
আলো এক প্রকার শক্তি।

আলো এক ধরনের তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ।
কোনো কোনো ঘটনায় আলো তরঙ্গের ন্যায়, আবার কখনো কখনো আলো কণার ন্যায় আচরণ করে।

আলোর প্রতিফলন:
যে সকল বস্তু নিজে থেকে আলো নিঃসরণ করে তাদেরকে বলা হয় দীপ্তিমান বস্তু। যেমন-সূর্য,তারা, জলন্ত মোমবাতি, নক্ষত্র ইত্যাদি।

যে সকল বস্তু নিজের আলো নেই বা নিজে আলো নিঃসরণ করতে পারে না তাদেরকে বলা হয় দীপ্তিহীন বস্তু। যেমন- মানুষ, গাছপালা, টেবিল, দেয়াল, ছবি, চক বোর্ড ইত্যাদি।

যখন দীপ্তিমান বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে আসে তখন আমরা সেই বস্তুটি দেখতে পাই।
আলোর প্রতিফলনের কারণে আমাদের চারপাশে যে সকল দীপ্তিহীন সাধারণ বস্তু আছে সেগুলো আমরা দেখতে পাই।

একটি স্বচ্ছ I সমসত্ত্ব মাধ্যমে আলোকরশ্মি সরলপথে গমন করে এবং একই বেগে চলে।
আলোকরশ্মি যখন এক মাধ্যম দিয়ে চলতে চলতে অন্য এক মাধ্যমের কোনো তলে আপতিত হয় তখন দুই মাধ্যমের বিভেদতল হতে কিছু পরিমাণ আলো আবার প্রথম মাধ্যমে ফিরে আসে। এ ঘটনাকে আলোর প্রতিফলন বলে।
যে পৃষ্ঠ হতে আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে তাকে প্রতিফলক পৃষ্ঠ বলে।

প্রতিফলনের সূত্র:
আপতিত রশ্মি এবং প্রতিফলিত রশ্মি দুটি সহজ সূত্র মেনে চলে-
প্রথম সূত্র: আপতিত রশ্মি, প্রতিফলিত রশ্মি এবং আপতন বিন্দুতে প্রতিফলকের উপর অঙ্কিত অভিলম্ব একই সমতলে অবস্থান করে।

দ্বিতীয় সূত্র: প্রতিফলন কোণ আপতন কোণের সমান হয়।
যখন আলো কোনো পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত হয় তখন তা অবশ্যই প্রতিফলনের সূত্র মেনে চলে।
কোনো পৃষ্ঠ থেকে কীভাবে আলো প্রতিফলিত হবে তা নির্ভর করে প্রতিফলকের পৃষ্ঠের প্রকৃতির উপর।

প্রতিফলক পৃষ্ঠের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে প্রতিফলনকে দুইভাগে ভাগ করা যায়।
যথা-
নিয়মিত বা সুষম প্রতিফলন
ব্যাপ্ত বা অনিয়মিত প্রতিফলন

নিয়মিত প্রতিফলন :
যদি একগুচ্ছ সমান্তরাল আলোকরশ্মি কোনো মসৃণ তলে আপতিত হয়ে প্রতিফলনের পর সমান্তরাল রশ্মিগুচ্ছ বা অভিসারী বা অপসারী রশ্মিগুচ্ছে পরিণত হয় তবে এ ধরণের প্রতিফলনকে আলোর নিয়মিত প্রতিফলন বলে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- যদি একগুচ্ছ সমান্তরাল আলোকরশ্মি কোনো সমতল দর্পণে বা খুব ভালোভাবে পালিশ করা কোনো ধাতব পৃষ্ঠে আপতিত হয়, তবে প্রতিফলনের পরেও রশ্মিগুচ্ছ সমান্তরাল থাকে। এ ক্ষেত্রে রশ্মিগুচ্ছের প্রত্যেকটি আলোকরশ্মির আপতন কোণের মান সমান এবং নিয়মিত প্রতিফলনের ফলে প্রত্যেকটি রশ্মির প্রতিফলন কোণেরও মান সমান হয়।

ব্যাপ্ত প্রতিফলন:
যদি একগুচ্ছ সমান্তরাল আলোকরশ্মি কোনো তলে আপতিত হয়ে প্রতিফলনের পর আর সমান্তরাল না থাকে বা অভিসারী বা অপসারী রশ্মিগুচ্ছে পরিণত না হয় তবে এ ধরণের প্রতিফলনকে আলোর ব্যাপ্ত বা অনিয়মিত প্রতিফলন বলে।

একগুচ্ছ সমান্তরাল আলোকরশ্মি একটি অমসৃণ তলে আপতিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে রশ্মিগুলো অমসৃণ তলের বিভিন্ন আপতন বিন্দুতে বিভিন্ন আপতন কোণে আপতিত হয়, ফলে এ সকল রশ্মির আনুষঙ্গিক প্রতিফলন কোণগুলোও বিভিন্ন হয়। যার ফলে প্রতিফলিত রশ্মিগুলো আর সমান্তরাল থাকে না।

আমাদের চারপাশে যে সকল বস্তু দেখতে পাই, তাদের অধিকাংশের পৃষ্ঠ মসৃণ নয়। ফলশ্রুতিতে আমাদের চোখে যে সকল প্রতিফলিত রশ্মি প্রবেশ করে তারা ব্যাপ্ত প্রকৃতির। যার ফলে বস্তুগুলো আমাদের নিকট উজ্জ্বল না হয়ে অনুজ্জ্বল দেখায়।

খালি চোখে দেখা অধিকাংশ পৃষ্ঠ আপাতদৃষ্টিতে মসৃণ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সকল পৃষ্ঠ মসৃণ নয়।

Leave a Comment