কর্নওয়ালিস কোড বলতে কি বুঝ? ইহার প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাখ্যা কর।

কর্নওয়ালিস কোড বলতে কি বুঝ? ইহার প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাখ্যা কর।


১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে কোম্পানি বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু কোম্পানির প্রশাসনিক ভিত্তিকে মজবুত করার ক্ষেত্রে রবার্ট ক্লাইভের চিন্তাধারা, ওয়ারেন হেস্টিংসের চিন্তাধারা কর্নওয়ালিসের চিন্তাধারার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান ছিল। ক্লাইড দেশীয় শাসন পদ্ধতি সংরক্ষণ করে দেশীয়দের হাতে শাসন তার ন্যস্ত করে দেশ শাসনের পক্ষপাতী, ওয়ারেন হেস্টিংস দেশীয় ও ইউরোপীয়দের মিলিত শাসনের পক্ষপাতী এবং কর্নওয়ালিস ছিলেন দেশীয় শাসন পদ্ধতি উৎখাত করে ইউরোপীয় পদ্ধতিতে এককভাবে ইউরোপীয়দের দ্বারা দেশ শাসন করার পক্ষে।

তাই কর্নওয়ালিসের এ ধরনের মানসিকতা থেকে তিনি ফরাসি সম্রাট যেমন নেপোলিয়ন কোড-এর জন্য বিখ্যাত, জাস্টিনিয়ান যেমন আইন সংকলনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন সে দিক থেকে কর্নওয়ালিসও এদের তুল্য ফিরে পরিচয় দিয়ে কর্নওয়ালিস কোড লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে কর্নওয়ালিসের চিন্তা ও কাজে কোন মিল ছিল না। বিধায় তার কোড বিফলতায় পর্যবসিত হয় ।

কর্নওয়ালিস কোডের আদর্শ : লর্ড কর্নওয়ালিস ছিলেন সিস্টেমে বিশ্বাসী। তার মতে, সমাজের উন্নতি বা অবনতি, শৃঙ্খলা বা বিশৃঙ্খলা নির্ভর করে সিস্টেমের উপর। এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি বাংলার জন্য এমন একটি সিস্টেম চালু করতে চান যে সিস্টেমে কোম্পানি, ব্রিটিশ সরকার, জনসাধারণের সবাই উপকৃত হবে এবং সবা সমৃদ্ধির স্বাদ গ্রহণ করবে। তিনি মনে করেন পূর্বেকার সরকার দেশ শাসনের ব্যাপারে ভুল সিস্টেম অনুসরণ করেছিল সে ব্যবস্থা থেকে মন্দ বৈ কোন ফলোদয় হয় নি। তিনি মত প্রকাশ করেন যে, চলতি ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ন পারলে কোন উন্নতি সম্ভব নয়। তাই ইউরোপীয় দর্শন থেকে তিনি এ সিস্টেমের আদর্শ গ্রহণ করেন। তাই সিস্টেমকে কার্যকরী করার জন্য যে পন্থা বেছে নেন তা থেকে কর্নওয়ালিস কোডের ধারণা আসে।

কর্নওয়ালিস কোডের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো / বৈশিষ্ট্য ঃ ১৭৯৩ সালে ১ মে কর্নওয়ালিস তার বিখ্যাত কোড ঘোষণা করেন। কর্নওয়ালিস কোডের মোট রেগুলেশন সংখ্যা ছিল ৪৮টি। এ ৪৮টি রেগুলেশনে কর্নওয়ালিসের বিচারব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, কাজ ও ক্ষমতার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। নিম্নে কর্নওয়ালিস কোডের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হল :


১. স্বাধীনতা নিরপেক্ষ আদালত প্রতিষ্ঠা : কর্নওয়ালিস কোডের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রসাশন থেকে পৃথক একটি স্বা নিরপেক্ষ আদালত প্রতিষ্ঠা। পূর্বে জেলা কালেক্টর ছিলেন একাধারে রাজস্ব প্রশাসক, বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেট। এ প্রথা বিলুপ্ত করে জেলা কালেক্টর থেকে বিচার ক্ষমতা প্রত্যাহার করে প্রতি জেলায় একজন জজ নিযুক্ত করা হয় এবং সমস্ত বিচার ক্ষমতা তাদের আওতাভুক্ত করা হয়। জেলায় একজন জজ নিযুক্ত করা হয় যিনি বিচার ক্ষেত্রে স্বাধীন ছিলেন। কালেক্টরের অধীনে মাল আদালত বা রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করে সমস্ত রাজস্ব বিচার জেলা জজের আওতাভুক্ত করা হয়। এর সাথে বোর্ড অব রিভিনিউর রাজস্ব বিচার ক্ষমতা বিলুপ্ত করে তা দেওয়ানি আদালতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। (রেগুলেশন ২,৩,৪ )


২. কালেক্টরের অধীনে প্রশাসনিক কার্য পরিচালনার দায়িত্ব এতে বলা হয় যে, প্রতি জেলায় একজন কালের আগের মত বলবৎ থাকবে, কিন্তু তার কাজ হবে শুধু রাজস্ব সংগ্রহ এবং বিচারের সাথে সম্পৃক্ত নয়। সকল প্রশাসনিক কার্য তিনি পরিচালনা করবেন। তাকে সহায়তা করার জন্য প্রতি জেলায় থাকবে একটি দেওয়ানি আদালত। জেলা দেওয়ানি আদালত ছাড়া ঢাকা, মুর্শিদাবাদ ও পাটনা শহরের জন্য থাকবে ৩টি পৃথক দেওয়ানি আদালত। সমস্ত দেওয়ানি মামলার প্রথম বিচার হবে জেলা বা শহর দেওয়ানি আদালতে। এ সকল আদালতের জজ নিজ নিজ জেলা বা শহরের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।


৩. জেলাসমূহকে চারটি ডিভিশনে বিভক্ত : বিচার শাসনের সুবিধার্থে জেলাসমূহকে চারটি ডিভিশনে (যথা : ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, কলকাতা ও পাটনা) বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক ডিভিশনের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় তিনজন জজ বিশিষ্ট একটি প্রাদেশিক আপিল আদালতের। জেলা ও শহর দেওয়ানি আদালতের সব মামলার ডিক্রি প্রাদেশিক আদালতে আপিলযোগ্য করা হয়। পূর্বে শুধু এক হাজার টাকার ঊর্ধ্ব মূল্যের দেওয়ানি মামলা উচ্চ আদালতে আপিলযোগ্য ছিল। এ বাধা বিলুপ্ত করে এখন যে কোন মূল্যের মামলা জেলা আদালত থেকে প্রাদেশিক আদালতে আপিলযোগ্য করা হয়। প্রাদেশিক আপিল আদালতের জনগণই হবেন প্রাদেশিক সার্কিট কোর্টের জজ। প্রাদেশিক আপিল আদালত যখন ফৌজদারি বিভাগে বসে তখন এর নাম হয় প্রাদেশিক সার্কিট কোড। (রেগুলেশন ৫)


৪. সদর দেওয়ানি আদালত ও সদর নিয়ামত আদালত প্রতিষ্ঠা ঃ পূর্বে বিচার কার্যের জন্য সদর দেওয়ানি আদালত ও সদর নিয়ামত আদালত এর প্রচলন ছিল। কর্নওয়ালিস এ ব্যবস্থা বহাল রাখেন ।


৫. উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ ঃ মামলাবাজদের নিরুৎসাহিত করার জন্য পূর্বে মামলা রুজু করতে বাদী কর্তৃক আদালতে মামলার মূল্যের শতকরা দুই থেকে পাঁচ টাকা জমা রাখার নিয়ম করা হয়েছিল। বিচার পাওয়া সকলের মৌলিক অধিকার বলে ঘোষণা করা হয় এবং পূর্বের নিয়ম রদ করে সবাইকে অবাধে বিচার প্রার্থনার সুযোগ দেওয়া হয় এবং সবাইকে জেলা আদালতের রায় সম্পর্কে উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ দেওয়া হয়। বিধান করা হয় যে, গ্রাদেশিক আপিল আদালতের রায় চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলার মূল্য এক হাজার টাকা অতিক্রম করবে না এবং ভূসম্পত্তির বেলায় মামলার মূল্য বাৎসরিক ৫০০ টাকার অধিক হবে না। এর ঊর্ধ্বে সব মামলা সদর দেওয়ানি আদালতে আপিলযোগ্য করা হয়। (রেগুলেশন ৬)


৬. আইনের চোখে সকলে সমান ঘোষণা : পূর্বে ব্রিটিশ সরকার ও কোম্পানির অফিসার ছাড়া কোন ব্রিটিশ নাগরিকের কলকাতার দশ মাইলের বাইরে গমনাগমন ও বসবাস নিষিদ্ধ করা হয়। এর উদ্দেশ্য নেটিভদের উপর ইউরোপীয়দের অত্যাচার রোধ কর। যদি কেউ মফস্বলে বসবাস করতে চায় তবে সরকারের অনুমতি গ্রহণ করতে হবে এবং তার বিরুদ্ধে যে কোন নির্যাতিত নেটিভের স্থানীয় আদালতে মামলা করার অধিকার থাকবে। পূর্বে ব্রিটিশ নাগরিকদের বিচার করত একমাত্র কলকাতা সুপ্রিম কোর্ট এবং কোম্পানির কোন কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোন নেটিভ আদালতে মামলা করতে পারত না। এ বাধা রদ করে এখন আইনের চোখে সবাইকে সমান ঘোষণা করা হয় এবং সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে, এমন কি সরকারের বিরুদ্ধেও দেশীয় আধিবাসীদের আদালতে মামলা করার অধিকার দেওয়া হয় । (রেগুলেশন ২৮)


৭. পেশাদার উকিলের সাহায্যে মামলা পরিচালনার বিধান : পূর্বে আদালতে যে কোন ব্যক্তি উকিলের কাজ করতে পারত। সে প্রথা বন্ধ করে আইনকে পেশা হিসেবে গ্রহণের এবং পেশাদার উকিলের সাথে আদালতে মামলা পরিচালনার বিধান ছিল। সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য সরকারি বেতনভোগী উকিল নিযুক্ত করা হয় এবং প্রাইভেট মামলা পরিচালনার জন্য সরকার কর্তৃক অনুমোদিত উকিলের পারমিট দেওয়া হয়। মক্কেলদের যেন উকিলরা শোষণ করতে না পারে সেজন্য উকিলের ফি বেধে দেওয়া হয় এবং সে ফি মক্কেল থেকে আদালত কর্তৃক সংগ্রহ করার আইন করা হয়। (রেগুলেশন ৭)


৮. নেটিভ কমিশনার নিয়োগ : গ্রামাঞ্চলে স্থানীয়ভাবে পাতি মামলা মোকদ্দমা সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য নেটিভ কমিশনার নিযুক্ত করা হয়। নেটিভ কমিশনারের কোর্টে অনুর্ধ্ব ৫০ টাকা মূল্যের মামলা পর্যন্ত গ্রহণ করা হয় । (রেগুলেশন ৪০ )


৯. ঋণ দেওয়া ও জমি ক্রয় নিষিদ্ধ : এতে ঘোষণা করা হয় যে, ইউরোপীয় সিভিলিয়ান কর্তৃক দেওয়া দেশীয় লোকদের ঋণ দেওয়া বা জমি কেনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ।


১০. প্রজাদের দৈহিক নির্যাতন নিষিদ্ধ : পূর্বে বকেয়া খাজনা আদায়ের জন্য প্রজাদের দৈহিকভাবে নির্যাতন করা হতো। কিন্তু এ রেগুলেশনের মাধ্যমে বকেয়া খাজনা আদায়ের জন্য বল প্রয়োগের আশ্রয় না নিয়ে আদালতের আশ্রয় নেওয়ার নিয়ম করা হয়। (রেগুলেশন ১৭ )


১১. ভূমি রাজস্বের নিশ্চয়তা ও পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান : ভূমি রাজস্বের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা বিধান ছিল কর্নওয়ালিসের সিস্টেমের অন্যতম উদ্দেশ্য। নতুন আদালত প্রথার সুযোগ নিয়ে জমিদারগণ যেন সরকারি রাজস্ব নিয়ে কারসাজি না করতে পারে সেজন্য কালেক্টর কর্তৃক ভূমি রাজস্ব সংগ্রহকে নতুন আদালত প্রথার বহির্ভূত রাখা হয়। আইন করা হয় যে, রাজস্ব বাকি পড়লে কালেক্টর সে বকেয়া রাজস্ব আদায়ের জন্য জমি নিলামে বিক্রি করতে পারবেন এবং এ পন্থার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মোকদ্দমা করা যাবে না ।

১২. উত্তরাধিকার আইন সংক্রান্ত : পূর্বে কতিপয় বড় জমিদার পরিবারের মধ্যে প্রচলিত হিন্দু বা মুসলমান উত্তরাধিকার আইনের বদলে শুধু পিতার জ্যেষ্ঠ জীবিত পুত্রের জমিদারির উত্তরাধিকার লাভের প্রথা প্রচলিত ছিল। জমিদারি অটুট ও অক্ষত রাখার জন্য এ প্রথা অনুসরণ করা হয়। এ প্রথা বিলুপ্ত করে এখন থেকে ছোট বড় জমিদারির বেলায় এই হিন্দু বা মুসলমান ধর্মবিশেষের আইন প্রযোজ্য করা হয়। (রেগুলেশন ১১ )


১৩. একজন হিন্দু ও মুসলমান আইন অফিসার নিয়োগ ঃ এতে বলা হয়েছিল যে, দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত বিচার পরিচালনা করবে। ইউরোপীয় বিচারককে হিন্দু ও মুসলিম বিষয়ে সাহায্য করার জন্য প্রত্যেক আদালতে একজন হিন্দু ও একজন মুসলমান আইন অফিসার নিয়োগ করা হবে।


১৪. অভ্যন্তরীণ করের বিলুপ্তি ঃ কর্নওয়ালিসের উদ্দেশ্য ছিল দেশের অর্থনীতিকে সচ্ছল রাখা। এ অর্থনীতিকে উন্নত করার উদ্দেশ্যে শত রকমের অভ্যন্তরীণ কর বিলুপ্ত করা হয়। (রেগুলেশন ২৭)


১৫. জেলাকে থানাতে বিভক্ত । এ কোড এর মাধ্যমে জমিদারের পুলিশ ক্ষমতা প্রত্যাহার ও জমিদারি পুলিশ বিলুপ্ত করে প্রত্যেক জেলাকে কতিপয় থানাতে বিভক্ত করা হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ন্ত্রাধীনে প্রত্যেক থানায় একজন দারোগা নিযুক্ত করা হয়। দারোগার অধীনে থাকে বিশ বা তদুর্ধ্ব সংখ্যক সিপাই বরকন্দাজ। এ ব্যবস্থায় থানায় আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের পাকড়াও করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সোপর্দ করা দারোগার দায়িত্ব ছিল। (রেগুলেশন ২২)


১৬. কাজি নিয়ন্ত্রিত দেশীয় আদালতের বিলুপ্তি ঃ এ ব্যবস্থার ফলে ইউরোপীয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইউরোপীয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত আদালত প্রতিষ্ঠার ফলে কাজি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত দেশীয় আদালত বিলুপ্ত হয়। কাজির কাজ হয় এখন দলিলাদি শনাক্ত করা এবং বিবাহ ও অন্যান্য মুসলমান ধর্মীয় উৎসবে পুরোহিতের কাজ করা।


১৭. পঞ্চসনা রেজিস্টার প্রস্তুত : কর্নওয়ালিস কোডের মাধ্যমে সম্পত্তির নিরাপত্তার জন্য সমস্ত জমি হস্তান্তর, সম্পত্তি সংক্রান্ত চুক্তি, বন্ধক প্রভৃতি রেজিস্ট্রি করার ব্যবস্থা করা হয় এবং নির্দেশ করা হয় যে, দান, বিক্রয় ও উত্তরাধিকার বিভাজনের ফলে জমির মালিকানায় যে রদবদল হয় তা রেকর্ড করার জন্য কালেক্টর একটি পঞ্চসনা রেজিস্টার প্রস্তুত করবেন। পাঁচ বছর অন্তর উক্ত রেজিস্টার নতুন করে প্রস্তুত করা হবে।


১৮. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন : কর্নওয়ালিস কোডের সব আইন ও প্রতিষ্ঠান মূলত শুধু একটি প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেটি হচ্ছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে আইন দ্বারা ঘোষণা করা হয়, এখন থেকে জমির একমাত্র মালিক জমিদার। জমিদার তার ইচ্ছামত জমি বিক্রি করতে পারবে, দান করতে পারবে, বন্ধক রাখতে পারবে, এজন্য সরকারের কোন পূর্বানুমতির প্রয়োজন নেই। সরকারকে দেয় রাজস্বের আর কম বেশি হবে না। চিরকালের জন্য তা ফিরি করা হল এবং ভবিষ্যৎ কোন সরকার এ নিয়মে পরিবর্তন আনতে পারবে না ।


কর্নওয়ালিস কোডের প্রতিক্রিয়া : কর্নওয়ালিস কোড একটি সাধারণ সংস্কার নয়। নির্দিষ্ট ফল লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট থিওরির উপর ভিত্তি করে কর্নওয়ালিস তার শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ কর্তৃক বাংলা শাসনকে ব্রিটিশ ও বাঙালি সবার জন্য লাভজনক করা। এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তিনি ভূমিতে সম্পত্তি সৃষ্টি করেন এবং সে ভূসম্পত্তির উপর Land lord class-এর অনুকরণে একটি সুবিধাভোগী জমিদার শ্রেণী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একচেটিয়া ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রিত একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত সৃষ্টি করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সৃষ্টি করেন থানা ও পুলিশ। জমিদারি বন্দোবস্ত, আদালত ও পুলিশ সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রবর্তিত হয় অসংখ্য আইন, আদেশ ও প্রতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন ।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যে এ কোড পুরোপুরি বাস্তবায়িত করা সম্ভব ছিল না। ১৭৯৪ সালের এ কোডের সংশোধন আনা হয় ।,

ফলে তিন দশকের মধ্যে এমন পরিবর্তন হয় যে স্বয়ং এ কোডের স্রষ্টা যে কর্নওয়ালিস তিনিও চিনতে ভুল করেন। ১৭৯৩ সালে ৪৮টি আইন নিয়ে কর্নওয়ালিস কোড গঠিত হয়। ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সংশোধন পরিবর্তনের পর মোট ৯ খণ্ডে বিস্তৃত ৬৭৫টি আইন পাস হয়। উক্ত আইনসমূহের মধ্যে ৭৮টি আইন ১৮৩৩ সাল নাগাদ জ্যান্ত থাকে। বাকি সব আইনের মৃত্যু হয়। অনেকে এ কোডের ব্যর্থতার জন্য তার তত্ত্বগত ভুলকে দায়ী করেন। অনেকে মত প্রকাশ করেন যে, পাশ্চাত্য তত্ত্ব ও পাশ্চাত্য আইনতরু তিনি প্রাচ্য ভূমিতে রোপণ করে একই ফল আশা করেন। তাদের মতে, পাশ্চাত্য আইন ও পাশ্চাত্য প্রথা পাশ্চাত্য সমাজের জন্য সুফল আনতে পারে। কিন্তু প্রাচ্য সমাজের জন্য তা অনভিপ্রেত। যাক কর্নওয়ালিসের কোড পুরোপুরি সফল হয় নি।


উপসংহার ঃ অতএব বলা যায়, কর্নওয়ালিস ১৭৮৬ সালে বাংলার শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ৪৮টি আইন বিশিষ্ট একটি কোর্ট রচনা করেন। এক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্যগত দিক থেকে কোন ত্রুটি ছিল না। তবে তার চিন্তাধারা ভারতের জন্য ততটা সফল হয় নি। কারণ, পাশ্চাত্যের চিন্তাচেতনা থেকে প্রাচ্য দেশের মঙ্গল কামনা করতে গিয়ে তিনি ভুল পথে হাত দেন। অনেকে আবার বলেন যে, এটা ছিল একজন পাকা জুয়াড়ীর ভুল চাল । যে কারণে তার ভালো উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও তা ব্যর্থ হয় ।

Leave a Comment