খিলাফত আন্দোলন কি?, খিলাফত কারা এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হয় কেন

খিলাফত আন্দোলন কি?, খিলাফত কারা এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হয় কেন


ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের প্রারম্ভ থেকে ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশ শাসনকে গ্রহণ করেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও। অনিচ্ছা সত্ত্বে গ্রহণ করলেও ব্রিটিশ সরকারের নীতি আদর্শের সাথে একাত্ম হতে পারেন নি। একপর্যায়ে দেখা যায় যে, মুসলমানরা যখনই সুযোগ পান তখনই বিরোধিতা করেন। এমনি এক আবহাওয়ায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার তুরস্কের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন।

এ সময় ভারতে অবস্থানরত মুসলমানরা এক বিপজ্জনক অবস্থায় পড়ে যান। কারণ, ধর্মীয় কারণে তারা তুরস্কের প্রতি অনুগত ছিলেন আবার রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত ছিলেন। একপর্যায়ে তারা ব্রিটিশ সরকারের সাথে আলোচনা করেন। কিন্তু তা ব্যর্থ হলে খিলাফতের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেন যা খিলাফত আন্দোলন নামে খ্যাত।

এ খিলাফতের মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্যায়ে গোলযোগ দেখা দেয়। যুদ্ধের প্রারম্ভে ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীকে নিজ আয়ত্তে আনার জন্য এক সময় বলেছেন যে, এ যুদ্ধ শুধুমাত্র তুরস্ক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে, সুলতানের বিরুদ্ধে নয়। তাই পবিত্র স্থানগুলোর মর্যাদা রক্ষা করা হবে। এ ধরনের প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করে তারা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সমর্থন করেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষান্তে দেখা যায় যে, ব্রিটিশ সরকার পূর্ব প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হন।

ফলে মুসলমানরা তুরস্কের খিলাফতের মর্যাদা রক্ষার্থে একটি আন্দোলন গড়ে তোলেন যা খিলাফত আন্দোলন নামে খ্যাত । খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপট : ইসলাম ধর্মে তুরস্কের খিলাফতকে পবিত্র বলে মনে করা হতো। তাই খিলাফত এর প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব থেকেই সংঘটিত হয় খিলাফত আন্দোলনের। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভারতীয় মুসলমানরা ধর্মীয় কারণে ছিলেন তুরস্কের প্রতি অনুগত আবার রাজনৈতিক কারণে তারা ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক আদর্শগত কারণে জার্মানিকে সমর্থন করেন, ফলে এক জটিল সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যাটি হল ভারতীয় মুসলমান কোন পক্ষকে সমর্থন করবে।

কারণ, তুরস্ককে তারা ধর্মীয় কারণে রক্ষা করার জন্য সমর্থন করেন, এদিকে আবার রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশ সরকার এর প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের অনুগত থাকতে হতো। এ ধরনের অবস্থায় মুসলমানরা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জের সাথে সাক্ষাৎ করেন। লয়েড জর্জ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রতিশ্রুতি দেন যে, এশিয়া মাইনর ও থ্রেসের সমৃদ্ধশালী ও সুপ্রসিদ্ধ জায়গাসমূহ থেকে ভুরস্ককে বঞ্চিত করার জন্য আমরা এ যুদ্ধ করছি না। কারণ, এসব এলাকা একচ্ছত্রভাবে তুর্কি জাতিভুক্ত।

কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে, ব্রিটিশ সরকার এসব ওয়াদা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা ও ভঙ্গ করেন। এ সময় মুসলমানরা দাবি করেন যে, তুরস্কের মধ্যে অবস্থিত পবিত্র স্থানসমূহ তুরস্কের খলিফার অধীনে থাকবে। কিন্তু যুদ্ধ শেষান্তে দেখা যায় তুরস্ককে তার নিজস্ব আবাসভূমি থেকে বঞ্চিত করা হয়। থ্রেসকে দিয়ে দেওয়া হয় গ্রিসের কাছে। হুকুমনামার ছদ্মাবরণে গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স – তুরস্ক সাম্রাজ্যের এশিয়া অঞ্চলসমূহ নিজেদের মধ্যে বাটোয়ারা করে নেয়। একজন হাইকমিশনারের মাধ্যমে মিত্রশক্তি পুরোপুরি তুরস্কের শাসনভার গ্রহণ করে এবং সুলতানকে একজন কয়েদির ন্যায় ফেলে রাখে।

এতে শুধু ভারতের মুসলমানরা নয় অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনও লয়েড জর্জের এ বিশ্বাসঘাতকায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে এ ধরনের অসন্তোষের জন্য তারা আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। প্রথম বোম্বের মুসলিম প্রতিনিধিগণ ‘মজলিশে খিলাফত’ নামে একটি সংস্থা গঠন করেন এবং লক্ষ্ণৌতে সর্বভারতীয় খিলাফত কমিটির একটি অধিবেশন আহ্বান ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। কনফারেন্সে এ. কে. এম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে কতকগুলো প্রস্তাব গৃহীত হয়।

যথা : ক. মুসলমানদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয় যে, যাতে তারা ব্রিটিশ সরকারের বিজয় উৎসবে যোগদান না করে।

খ. ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করতে হবে।


গ. সরকার খিলাফতের ব্যাপারে দাবি না মানলে ব্রিটিশ সরকারের সাথে অসহযোগের ডাক দেওয়া হবে। গান্ধীজি মুসলমানদের এ দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন করেন এবং বলেছেন যে, এ ধরনের সুযোগ আগামী একশ বছরেও আর পাওয়া যাবে না।

ফলে ৬ ডিসেম্বর জমিয়াতুল উলামার এক অধিবেশনে অসহযোগের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯১৯ সালের শেষ সপ্তাহে অমৃতসরে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ বার্ষিক অধিবেশনে মিলিত হন। এ অধিবেশনে মাওলানা মোহাম্মদ আলী উক্তি করেন যে, “তিনি ছিন্দাওয়ালা জেল থেকে সরাসরি এসেছেন” সাথে একটি ফিরতি টিকেট নিয়ে। এ অধিবেশনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, খিলাফতের ব্যাপারে ইউরোপে একটি প্রতিনিধি প্রেরণ করা হবে।


এ ধরনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম ড. আনসারীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রথম ভাইসরয় এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। ভাইসরয় তুরস্কের ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। তবে তিনি বলেছেন, বিলেতে যে প্রতিনিধি দল যাবে তিনি তাদেরকে এক্ষেত্রে সহযোগিতা করবেন। ১৯০২ সালে ১৭ মার্চ মাওলানা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জের সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু কমিটি তাদের কোন দাবি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি নিতে ব্যর্থ হন। বৈঠকে মাওলানা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল আশানুরূপ ফলাফল না পাওয়ায় বিভিন্ন সভা সমিতিতে ব্রিটিশ শাসনকে ধ্বংসকারী শাসন বলে প্রচারণা চালান। তিনি আরো বলেছেন যে, মুসলমানরা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু তাদের আত্মা বিক্রি করবে না। কোন প্রজার মুখে পূর্বে ইংরেজরা এ ধমকের সুর শুনেন নি ।


১৯২০ সালে ২৮ মে মাসে বোম্বেতে খিলাফত কমিটির এক সভায় অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি নেওয়া হয়। পরে ১৯২০ এর এপ্রিলে কলকাতা ও মাদ্রাজ কনফারেন্সে অসহযোগ আন্দোলনের সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করা হয়। জুন মাসের প্রথম দিকে হিন্দু ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক যুগ্ম সভা ডাকা হয়। সভায় নিযুক্ত কমিটি একটি ভবিষ্যৎ কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। এ সময় গান্ধীজি তাঁর ‘কায়সার ই হিন্দ’ পদক প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু ভাইসরয় চেমসফোর্ড তা প্রত্যাখ্যান করেন । ১০ আগস্ট সেভারস এর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মুসলমানরা স্বভাবতই বিক্ষুব্ধ হয় এবং ৩১ আগস্টে সমগ্র উপমহাদেশে খিলাফত দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বস্তুত এটাই অসহযোগ আন্দোলনের সূচনালগ্ন।


খিলাফত আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণ : মুসলমান খিলাফত কমিটির উদ্যোগে যে আন্দোলন এতে গান্ধীজি একাত্মতা ঘোষণা করেন। কিন্তু এ একাত্মতা ঘোষণা করাকে মিসেস বেসান্ত, মালাভিয়া, মতিলাল নেহেরু এবং চিত্তরঞ্জন দাস সমালোচনা করেন। এদিকে মুসলিম লীগও অনুরূপ প্রস্তাব পাস করে নেন। ফলে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন একীভূত হয়। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন একীভূত হওয়ার ফলে ভারতীয় ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ অধ্যায় ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানদের সম্মিলিত আক্রমণ। গান্ধীজি বলেছেন, মুসলমানরা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব করেছে । ঈশ্বর না করুন শান্তির শর্তসমূহ তাদের পছন্দ না হলে তারা সরকারের সাথে সকল সহযোগিতা বন্ধ করে দেবেন। আমরা সরকারের উপাধি ও পদকসমূহ ধারণ করতে বা সরকারি অফিসে কাজ করতে বাধ্য নই। সরকার খিলাফতের ন্যায় যদি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন তাহলে অসহযোগ ছাড়া কোন উপায় নেই ।


১৯২০ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আলী ইংলন্ড থেকে ফিরে আসলে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। তিনি গান্ধীজি সহকারে ভারতের বিভিন্ন এলাকা সফর করেন এবং ছাত্রদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে আন্দোলন করার জন্য আহবান জানান। আইনজীবীগণকে আদালত ত্যাগ করতে বলেছেন। ফলে ১৯২১ সালে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। কলকাতার ৩,০০০ ছাত্র ধর্মঘট করেন এবং জাতীয় কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সুভাষ চন্দ্র বসু ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ইস্তফা দেন এবং এ কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগদান করেন। অনেক আইনজীবী আইন পেশা ত্যাগ করে আন্দোলনে যোগ দেন। এভাবে খিলাফত আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়।


খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতা : ১৯২০ সালে সংঘটিত খিলাফত আন্দোলন বিরাটাকার রূপ নিলেও তা সফল হতে পারে নি। কারণ, কোন আন্দোলনকে সফল করতে হলে যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন তা ছিল কি ছিল না এর মধ্যে এ তত্ত্ব নিহিত-


১. সুদক্ষ সংগঠক এর অভাব : খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল তুরস্কের খিলাফতের প্রতিষ্ঠা এবং স্বরাজ লাভ। আন্দোলন বিশালাকার ধারণ করলেও তা টিকিয়ে রাখার মত বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন ছিল সর্বাগ্রে। কিন্তু দেখা যায়, খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে এ ধরনের বলিষ্ঠ নেতা না থাকায় তারা সফল হতে পারেন নি


২. মালবারের হত্যাকাণ্ড : খিলাফত আন্দোলনের কয়েকজন উগ্রপন্থি মুসলমান বিদ্রোহী হয়ে কয়েকজন ইউরোপীয় ও বহু হিন্দুকে হত্যা করেন। এ ঘটনা সারা ভারতে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। এ হত্যাকাণ্ডকে উপলক্ষ্য করে গান্ধীজি সাময়িকভাবে আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেন। এ ঘোষণা ছিল আন্দোলন ব্যর্থতার জন্য একটি অন্যতম কারণ। কারণ, এ সুযোগে ব্রিটিশ সরকার দমননীতি গ্রহণ করেন।


৩. হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা : খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন একপর্যায়ে সহিংস আন্দোলনে পরিণত হয় এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা বেধে যায়। ফলে ১৯২১/২২ সালে মহররম উপলক্ষ্যে ও ১৯২২/২৩ সালে বাংলা ও পাঞ্জাবে, ১৯২৩ সালে অমৃতসর, মুলতান ও পাঞ্জাব, সিন্ধু, মোরাদাবাদ, মীরাট, এলাহাবাদ, আজমীর প্রভৃতি স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যায়। এ ঘটনার ফলে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেন। তাই তা ব্যর্থ হয়।


৪. ব্রিটিশ সরকারের দমননীতি : ব্রিটিশ সরকার খিলাফত আন্দোলনের ব্যাপকতা লক্ষ্য করে তা নির্মূল করার জন্য অনায়াসে পাইকারি হারে খিলাফত আন্দোলনের নেতাদের বন্দি করতে থাকেন। ফলে একপর্যায়ে মাওলানা মুহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলী, ড. সাইফুদ্দীন কিচলু, জগৎগুরু শংকরাচার্য, মাওলানা নিসার আলী, পীর গুলাম মুজাদ্দিদ, মৌলভী হোসাইন আহমদকে বন্দি করা হয়। এতে দেখা যায়, খিলাফত আন্দোলন নেতৃত্বশূন্য হয়ে যায়। যার জন্য তা ব্যর্থ হয় ।

৫. চৌরিচৌরার হত্যাকাণ্ড : ১৯২২ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি উত্তর প্রদেশের গৌরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরা নামক স্থানে উন্মত্ত কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক ও চাষিদের হাতে একুশজন পুলিশ ও চৌকিদার জীবন্ত দগ্ধ হয়। এখানে আইন অমান্য আন্দোলন দমন করতে গিয়ে পুলিশ জনতার বেষ্টনীতে আটকা পড়ে যায়। ফলে তাদেরকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। এ ঘটনার ফলে গান্ধীজি দেখলেন, কংগ্রেস কর্মীরা এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। তিনি বুঝলেন, কর্মীদের আরো প্রশিক্ষণ প্রয়োজন । তাই তিনি আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন। যা ছিল এ আন্দোলন বেগবান করে সফল করার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।


৬. তুর্কি নেতার ঘোষণা : তুরস্ককে নিয়ে বা তুরস্কের খিলাফতকে নিয়ে যখন এত আন্দোলন তখন একপর্যায়ে তুরস্কের নেতা মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের খিলাফত ভেঙে দিয়ে তুরস্ককে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। ফলে দেখা যায়, মুসলমানদের আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায় ।

খিলাফত আন্দোলনের ফলাফল : খিলাফত আন্দোলন সফল না হলেও এর যে প্রভাব তা গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিম্নে এ আন্দোলনের ফলাফল আলোচনা করা হল :-


১. রাজনৈতিক চেতনার সঞ্চার : ভারতবর্ষের ইতিহাসে এ আন্দোলন ছিল প্রথম নিরস্ত্র ভারতবাসীর সশস্ত্র ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন। এ আন্দোলনে প্রথম বাংলার মুসলমান জনসাধারণ শিক্ষিত, বেকার, চাকরিজীবী, ছাত্র, আইনজীবী সবাই অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় নেমে আসেন। ফলে ভারতীয় জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার সঞ্চার হয়।


২. নাগরিক অধিকারবোধের ধারণা : ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেখা যায়, এতদিন পর্যন্ত যতগুলো আন্দোলন সংঘটিত হয় তা ছিল শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত কিন্তু ১৯২০ সালে সংঘটিত খিলাফত আন্দোলন ছিল ভারতের আপামর জনতার আন্দোলন। এ আন্দোলনে সকল শ্রেণির জনসাধারণ নাগরিক অধিকার বোধের জায়গা থেকে অংশগ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “The Movement Served as baptism of fire which initiated the people to a new faith and new hope and inspired with a new confidence in their power to fight for freedom. As a result the Congress movement for the first time became a really mass movement. ‘


৩. কংগ্রেসের শক্তি বৃদ্ধি : এ আন্দোলনের ফলে জাতীয় কংগ্রেসের শক্তি ও প্রচার বৃদ্ধি পায় এবং দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কংগ্রেস প্রথম ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হন।


৪. মুসলিম নেতৃত্ব : এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুসলমান নেতাদের আবির্ভাব হয় ভারত ইতিহাসে। এছাড়া এ আন্দোলনের শিক্ষা থেকে ভারতে মুসলিম নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ফিরে আসে। যা ছিল ভারতের জন্য একটি ব্যতিক্রম বিষয়।


৫. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন : ১৯১৬ সালে এমনি একপর্যায়ে ভারতের হিন্দু-মুসলমানরা ঐকমত্যে এসেছিল। এ শিক্ষা থেকে মুসলমানরা আবার খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে ঐকমত্যে আসে। ফলে সাম্প্রদায়িক ঐকমত্যে আসার কারণে খিলাফত আন্দোলন বেগবান হয়। ৬. ব্রিটিশ শাসক শ্রেণির সচেতনতা : খিলাফত আন্দোলন অবলোকন করে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের ঐক্য মনোভাব সম্পর্কে অবগত হন। তাই তারা রাজনৈতিক দিক থেকে আরো বেশি তৎপর হন। যা ব্রিটিশ শাসন মজবুতকরণে ভূমিকা পালন করেছিল।


উপসংহার ঃ অতএব বলা যায় যে, ১৯২০ সালে সংঘটিত যে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন তা ছিল ভারত ইতিহাসের জন্য একটি চরম পরীক্ষা। এ আন্দোলনের শিক্ষা থেকে ভারতীয় জনসাধারণ ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব সম্পর্কে অবগত হন। এছাড়া ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশ শাসন পদ্ধতির কৌশল সম্পর্কে অবগত হন। তবে দুঃখ যে, এর ফলে কেবল হত্যা ও দাঙ্গার সংখ্যা বেশি সৃষ্টি হয়। বাস্তবক্ষেত্রে তেমন কিছু এ আন্দোলনে লক্ষ করা যায় না। তবে এটা ভারতবাসীকে পরবর্তী আন্দোলনের জন্য তৈরি হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছিল বলা যায়।

Leave a Comment