খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন কেন সংঘটিত হয়েছিল?,খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন আন্দোলনের ফলাফল ব্যাখ্যা কর।,খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের কারণে এ আন্দোলন ব্যর্থ হয়?
ভূমিকা : ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা চলে যায় ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাতে। ফলে দেখা যায়, একদিন যারা এ উপমহাদেশের রাজা, সম্রাট বা সুলতানদের কাছে অনুগ্রহ প্রার্থী বা করুণা প্রার্থী এখন তারাই করুণা বিতরণের অধিকারী হয়। ফলে দেখা দিতে থাকে ভারতে শাসনতান্ত্রিক জটিলতা। শাসনতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনের জন্য একপর্যায়ে ভারতে দলগত বিভেদ দেখা দেয়। ১৯১৬ সালে জাতীয় প্রশ্নে ভারতবাসী আবার ঐক্যবদ্ধ হন। এভাবে দেখা যায় ১৯১৯ এর পর কংগ্রেস ১৯১৯ সালের আইনের প্রতিবাদে এক আন্দোলনের ডাক দেন যা অসহযোগ আন্দোলন নামে খ্যাত। অন্যদিকে ১ম বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে মুসলমানরা তুরস্কের খিলাফত রক্ষা করার জন্য যে আন্দোলন গড়ে তোলেন তা খিলাফত আন্দোলন নামে খ্যাত।
খিলাফত আন্দোলন : ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে মর্যাদাকর বিষয় ছিল খিলাফত। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, হযরত মুহম্মদ (স) এর পর নবুয়াতের মাপকাঠির আলোকে এ খিলাফতের মর্যাদা ৬৩২-৬৬১ পর্যন্ত বজায় ছিল। ৬৬১-৭৫০ পর্যন্ত আবার উমাইয়া খিলাফত এর শাসন ছিল এবং ৭৫০-১২৫৮ পর্যন্ত ছিল আব্বাসীয় রাজতান্ত্রিক খিলাফতের শাসন। এ খিলাফতকে কেন্দ্র করে ভারতীয় উপমহাদেশে আন্দোলন দেখা দেয়। কারণ, মুসলমানরা সব খিলাফতের মর্যাদা রক্ষায় তৎপর ছিলেন। এজন্য তারা যে আন্দোলন বা ত্যাগ স্বীকার করতে পিছপা হন নি।
ঠিক এসময় দেখা যায়, ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়। প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্ক জার্মানিকে সমর্থন করেন। ফলে ব্রিটিশ সরকার তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এমনি পর্যায়ে ভারতীয় মুসলমানদের মাথায় হাত পড়ে যায়। কারণ, তারা ধর্মীয় দিক থেকে তুরস্কের খিলাফতকে সমর্থন ও রক্ষা করতে তৎপর ছিলেন। অন্যদিকে আবার রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত ছিলেন। ফলে মুসলমানরা প্রথম অবস্থায় কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না কি করা যাবে। ফলে একপর্যায়ে তারা ব্রিটিশ সরকারের কাছে তুরস্কের খিলাফত রক্ষার দাবি সংক্রান্ত একটি দাবি পেশ করেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ তখন প্রতিশ্রুতি দেন যে, এ যুদ্ধ হল তুরস্কের বিরুদ্ধে কিন্তু খিলাফতের বিরুদ্ধে নয়। এছাড়া তিনি খিলাফতের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু যুদ্ধপরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার একপর্যায়ে বলে উঠে যে, এটা তাদের একার আওতার বাইরে। তাই ব্রিটেনের কিছু করার নেই। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের ঘোষণায় ভারতবর্ষের মুসলমানরা তুরস্কের খিলাফতের মর্যাদা রক্ষার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার দায়ে ব্রিটিশ সরকারকে চাপ দেন এবং আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মাওলানা মুহাম্মদ আলী ভ্রাতৃদ্বয়। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এটাই খিলাফত রক্ষার্থে পরিচালিত আন্দোলন বা খিলাফত আন্দোলন।
খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপট : ইসলাম ধর্মে তুরস্কের খিলাফতকে পবিত্র বলে মনে করা হতো। এ খিলাফতের মর্যাদা রক্ষার জন্য কখনও মুসলমানরা পিছপা হতেন না। এ খিলাফতের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার নিদর্শন পূর্বে অনেক বিবরণে পাওয়া যায়। যেমন : ৬৩২ সালে হযরত মুহাম্মদ (স) এর ওফাতের পর হযরত আবুবকর (রা) থেকে হযরত আলী (রা) এর খিলাফত কাল (৬৩২-৬৬১), পরে বংশীয় শাসন তথা উমাইয়া খিলাফত প্রায় (৬৬১-৭৫০) এবং শেষে আব্বাসীয় খিলাফত (৭৫০-১২৫৮) পর্যন্ত। ইসলামী বিশ্বের দিকনির্দেশনা শক্তি হিসেবে তারা খিলাফতকে মনে করত। তবে ১২৫৮ এরপর এটা তেমন পূর্বের মত ছিল না। তবে এ খিলাফতের প্রতি মুসলমানদের আস্থা বিভক্ত হয় নি ।
এমনি এক অবস্থায় প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষে যোগদান করেন। ফলে ব্রিটিশ সরকার এর বিরুদ্ধে চলে যান। কারণ, প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটেন মিত্র পক্ষে ছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলেও ব্রিটিশ সরকার প্রলোভন দেখিয়ে মুসলমানদেরকে উত্তেজিত না হওয়ার জন্য চেষ্টা করেন। ফলে মুসলমান রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থন করেন। এর বিনিময়ে তারা ব্রিটিশ সরকারের কাছে তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য দাবি করেন ।
কিন্তু ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণায় দেখা যায়, তুরস্ককে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলা হয়। এতে দেখা যায়, তুরস্ক সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার পূর্বে যে ওয়াদা করেন তার কিছু অংশও কার্যকরী হয় নি। যুদ্ধের পূর্বে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর লয়েড জর্জ বলেছিলেন যে, এশিয়া মাইনর ও থ্রেসের সমৃদ্ধশালী ও সুপ্রসিদ্ধ জায়গাসমূহ থেকে তুরস্ককে বঞ্চিত করার জন্য আমরা এ যুদ্ধ করছি না। কারণ, এসব এলাকা একচ্ছত্রভাবে তুর্কি জাতিভুক্ত। কিন্তু যুদ্ধশেষে ব্রিটিশ সরকার এ ওয়াদা ভঙ্গ করেন।
মুসলমানদের আর একটি দাবি ছিল, বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত পবিত্র স্থানসমূহ সম্পূর্ণভাবে তুরস্কের খলিফার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিন্তু যুদ্ধ বিরতির শর্তানুযায়ী তুরস্ককে তার নিজস্ব আবাসভূমি থেকে বঞ্চিত করা হয়। থ্রেস প্রদান করা হয় গ্রিসকে। হুকুম নামার ছদ্মাবরণে ব্রিটেন ও ফ্রান্স তুরস্ক সাম্রাজ্যের এশিয়া অঞ্চলসমূহ নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। এতে দেখা যায়, একজন হাইকমিশনারের মাধ্যমে মিত্রশক্তি পুরোপুরি তুরস্কের শাসনভার গ্রহণ করে এবং সুলতানকে একজন কয়েদীর ন্যায় ফেলে রাখেন। এতে দেখা যায়, শুধু ভারতের মুসলমান নয় অন্যান্য সম্প্রদায়ও লয়েড জর্জের এ বিশ্বাসঘাতকতায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ভারতের মুসমানরা এ সময় দাবি আদায়ের জন্য এক সর্বাত্মক আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়। প্রথম বোম্বের মুসলিম ব্যবসায়ীগণ মজলি, খিলাফত নামে একটি সংস্থা গঠন করেন। ফলে লক্ষ্ণৌতে একটি কনফারেন্স ডাকা হয় এবং একটি সর্ব ভারতীয় খিলাফত কমিটি গঠন করা হয় ।
২৪ নভেম্বর ১৯১৯ দিল্লিতে এ. কে. ফজলুল হকের সভাপতিত্বে খিলাফত কনফারেন্সের প্রথম সভা হয়। কনফারেন্সে অনেকগুলো প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। যথা :
i. মুসলমানদের প্রতি আবেদন জানানো হয় যে, তারা যেন ব্রিটিশ সরকারের বিজয় উৎসবে অংশ গ্রহণ না করে।
ii. ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা হবে।
iii. খিলাফতের ব্যাপারে দাবি না মানলে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে । এ অধিবেশনের সিদ্ধান্তের সাথে গান্ধীজি একাত্মতা ঘোষণা করেন।
ফলে হিন্দু ও মুসলমানদের এক যৌথ সভায় গান্ধী খিলাফত কনফারেন্সের সাথে সহযোগিতা করার ঘোষণা দেন। তিনি একপর্যায়ে বলেছেন, এ সুযোগ আর একশ বছরে পাওয়া যাবে না। তাই খিলাফত আন্দোলন বেগবান হয়। এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ আলী, মাওলানা আব্দুল বারী, মাওলানা শওকত আলী প্রমুখ ।
২. গভর্নরের নিয়োগ পদ্ধতি : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনানুযায়ী গভর্নরগণ ছিলেন ব্রিটিশ রাজের প্রতিনিধি। তারা ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক নিযুক্ত হতেন এবং শাসন ক্ষমতা লাভ করতেন। এরূপ নিয়োগ পদ্ধতি ছিল স্বায়ত্তশাসন নীতির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ।
৩. গভর্নরের সীমাহীন ক্ষমতা : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনানুযায়ী প্রাদেশিক গভর্নরের হাতে প্রভৃত পরিমাণ ক্ষমতা দেওয়া হয়। যথা ঃ
ক. আইনসভার উপর নিয়ন্ত্রণ : এ আইন অনুসারে প্রাদেশিক গভর্নর তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে আইন পরিষদের নিম্নকক্ষ ভেঙে দিতে পারতেন। আইনসভা প্রণীত বিল গভর্নরের সম্মতির জন্য প্রেরিত হলে তিনি এতে ভেটো প্রয়োগ করতে পারতেন অথবা বিলটি গভর্নর জেনারেলের বিবেচনার জন্য সংরক্ষিত রাখতে পারতেন। গভর্নর প্রাদেশিক আইনসভায় ইচ্ছার বিরুদ্ধে গভর্নরের আইন ও অধ্যাদেশ জারি করতে পারতেন।
খ. আইনসভার আর্থিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ : প্রাদেশিক সরকারের আয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে গভর্নরগণ আইনসভার উপর প্রাধান্য সৃষ্টি করতে পারতেন। প্রাদেশিক আইনসভা কর্তৃক বাতিলকৃত কোন ব্যয় বরাদ্দপূর্ণ বহাল করার ক্ষমতা গভর্নরদের প্রদান করা হয়েছিল ।
গ. মন্ত্রিসভার উপর গভর্নরের নিয়ন্ত্রণ : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রদেশে সংসদীয় ও দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি অনুযায়ী মন্ত্রিসভার হাতেই প্রকৃত শাসনক্ষমতা ন্যস্ত হওয়া উচিত ছিল কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গভর্নর মন্ত্রীদের সাথে পরামর্শ না করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। বিশেষ দায়িত্ব পালনের অজুহাতে গভর্নর মন্ত্রিসভার কোন পরামর্শ উপেক্ষা করতে পারতেন। অথচ মন্ত্রিসভাকে গভর্নর ও আইনসভা উভয়ের কাছে দায়ী থাকতে হতো। এমনকি গভর্নর মন্ত্রিসভাকে ভেঙেও দিতে পারতেন।
৪. গভর্নর জেনারেলের অপ্রতিহত ক্ষমতা : গভর্নরের ক্ষমতার ক্ষেত্রে আরো অন্যান্য দিক ছিল । যথা :
ক. গভর্নর জেনারেল কর্তৃক গভর্নরদের উপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ : যে সমস্ত ক্ষেত্রে গভর্নরগণ স্বীয় বিচার বুদ্ধি বলে, বিশেষ দায়িত্ব পালন করতেন এবং স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে মন্ত্রীদের সাথে পরামর্শ না করে কাজ করতেন। সেসব ক্ষেত্রে গভর্নরগণ সরাসরি গভর্নর জেনারেলের নিয়ন্ত্রণাধীনে থেকে কাজ করতে বাধ্য ছিলেন।
খ. গভর্নরদের উপর গভর্নর জেনারেলের নির্দেশ : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ১২৬ ধারায় বলা হয় যে, ভারতবর্ষের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার উদ্দেশ্যে গভর্নর জেনারেল গভর্নরদের কাছে নির্দেশ পাঠাতে পারবেন। গভর্নরদের জন্য এসব নির্দেশ পালন করা বাধ্যতামূলক ছিল। এর ফলে শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্টের অজুহাতে গভর্নর জেনারেল প্রাদেশিক শাসনকার্যে যে কোন মুহূর্তে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন।
গ. গভর্নর জেনারেল কর্তৃক জরুরি অবস্থা ঘোষণা : গভর্নর জেনারেল জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলে কেন্দ্রীয় আইনসভা প্রাদেশিক বিষয়েও আইন প্রণয়ন করতে পারত। শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টির অজুহাতে গভর্নর জেনারেল প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা ও আইনসভা ভেঙে দিয়ে প্রদেশের শাসন ক্ষমতা স্বহস্তে গ্রহণ করতে পারতেন। গভর্নর জেনারেলের উপদেশাবলি : গভর্নর তার ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেলের কাছ থেকে উপদেশাবলি পেতেন। এসব উপদেশাবলিকে গভর্নর আদেশের মতই মান্য করতেন।
ঘ. ৫. প্রাদেশিক আইনসভার সীমাবদ্ধতা : প্রাদেশিক আইনসভা সব বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারত না। যেমন ব্রিটিশ জনগণের বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রতি হুমকি বা বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে এরূপ বিষয়সহ আরোও কতিপয় বিষয়ে আইন প্রণয়ন ক্ষমতা প্রাদেশিক আইনসভার এখতিয়ার বহির্ভূত রাখা হয় ।
৬. যুগ্ম তালিকার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের প্রাধান্য : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়গুলোর উপর আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কেন্দ্র ও প্রদেশের উপর অর্পণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়ের উপর প্রাদেশিক সরকারের কোন ক্ষমতা ছিল না বললে চলে। কেননা, যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়ে কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে মতানৈক্য ঘটলে কেন্দ্রীয় সরকারের আইন বা অভিমতই বলবৎ থাকত ।
৭. প্রাদেশিক বিষয়ে বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ : এ আইনে বলা হয় যে, ব্রিটিশ সরকার নির্দেশনামা জারির মাধ্যমে ভারতবর্ষের যে কোন প্রাদেশিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। যা ছিল স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার পরিপন্থি।
৮. প্রাদেশিক সরকারের সীমিত প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা : প্রাদেশিক প্রশাসনে নিযুক্ত আই. সি. এস, আই. পি. এস প্রভৃতি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ ভারত সচিব নামক ব্রিটিশ মন্ত্রী কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন। ভারত সচিব তাদের চাকরির শর্তাদিও নির্ধারণ করতেন। এসব উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ ভারত সচিব, গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতেন এবং তাদের নির্দেশ মেনে চলতেন। অথচ প্রাদেশিক সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ছিল মন্ত্রিসভার উপর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ও আদেশ নির্দেশের প্রতি ইচ্ছাকৃত উদাসীনতা বা অবহেলা প্রদর্শন করতেন।
৯. গভর্নরের নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভাগ : উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা সীমাহীন অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিল। বিশেষ করে পুলিশ বিভাগের অভ্যন্তরীণ সংগঠন ও প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে মন্ত্রিসভার পরিবর্তে গভর্নরের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মূলনীতিই বিনষ্ট হয়েছিল।
এছাড়াও প্রদেশে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার পথে আরও কতিপয় বাধা ছিল। যথা : কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ এর মধ্যে বিরোধ। কারণ দেখা যায়, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ পরাজিত হলে প্রাদেশিক আইনসভাগুলোতে লীগ নানাভাবে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার বিরোধিতা করতে থাকেন। তাদের অভিযোগ কংগ্রেস মন্ত্রিসভা মুসলমানদের নিরাপত্তা রক্ষার পরিবর্তে হিন্দুদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যস্ত। এসব কারণে প্রাদেশিক সরকারগুলো যথাযথভাবে কাজ করতে পারেন নি এবং প্রদেশগুলোতে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় মহাসমর শুরু হলে ভারতীয় জনগণের সম্মতি না নিয়ে সরকারের যুদ্ধ ঘোষণার প্রতিবাদে বিভিন্ন প্রদেশের কংগ্রেস মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করেন। মি. জিন্নাহ কংগ্রেস শাসনের অবসানাস্ত্রে ‘মুক্তি দিবস’ পালন করেন। এভাবে প্রায় আড়াই বছর ধরে প্রাদেশিক স্বাতন্ত্র্যের যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল তার অবসান ঘটে।
সমালোচনা : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রয়োগের কথা ডাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হলেও বাস্তবক্ষেত্রে তা প্রয়োগ না করায় এতে পূর্ণ বা প্রকৃত শাসন এর নামগন্ধ ছিল না। তাই দেখা যায় যে, প্রাদেশিক গভর্নর ও গভর্নর জেনারেলের ন্যায় প্রভাবশালী কর্তার কর্তৃত্বের মুখে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন অর্থহীন হয়ে পড়ে। পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু ১৯৩৫ সালের এ আইনকে দাসত্বের এক নতুন অধ্যায় বলে মন্তব্য করেন । যদিও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হয় তথাপিও বাস্তবে তা ছিল অসম্পূর্ণ ও অর্থহীন এবং হাস্যকর স্বায়ত্তশাসন। IC.S এবং I.P.S কর্মচারী সুবিধা অধিকারের মুখেও গভর্নরের বিশেষ দায়িত্বের পরিপ্রেক্ষিতে এটা অবাস্তব হয়ে পড়ে। অনেকের মতে, এটা ছিল প্রহসন, বাস্তবতা বিবর্জিত এবং চাতুরতাপূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা। মি. জিন্নাহ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, It was two percent of autonomy and ninety eight percent of safe guards. এছাড়া তৎকালীন ভারত সচিব লর্ড জেটল্যান্ড নিজেই স্বীকার করেছেন যে, ১৯৩৫ সালের আইনে প্রদেশসমূহে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হয় নি। তবে বলা যায়, ১৯৩৫ সালের আইনে অনেক অসম্পূর্ণতা ও ত্রুটি থাকলেও ভারতের প্রদেশগুলোতে সীমাবদ্ধ আকারে হলেও দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। আর এ অভিজ্ঞতা ভারতবাসীর জন্য কাজে দিয়েছিল। এ শিক্ষা থেকে ভারতীয়রা পরে অগ্রসর হন।
উপসংহার : অতএব বলা যায়, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয় তা ছিল ভারতবাসীর জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু এ ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হয় নি। তবে বাস্তবায়িত না হওয়ার জন্য যেমন ব্রিটিশ সরকারের ভেলকিবাজি দায়ী ছিল অনুরূপভাবে এদেশীয় জনসাধারণের মানসিকতাও দায়ী ছিল। ফলে দেখা যায়, ব্রিটিশ সরকারের যে উদ্যোগ তা ব্যর্থ হয়। তবে বলা যায় যে, এতে ভারতবাসীর জন্য অনেকটা আশার সঞ্চার হয়েছিল । তাই এ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মূল্য ভারত ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।