খিলাফত রাষ্ট্র ও আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র পার্থক্য, খিলাফত রাষ্ট্র vs আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র পার্থক্য
খিলাফত ও বর্তমান আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের মাঝে মৌলিক পার্থক্য কী তা নিয়ে কিছু আলোকপাত করা দরকার মনে হচ্ছে, যাতে এই কথা স্পষ্ট হয় যে বর্তমান রাষ্ট্রসমূহ খিলাফতের সাথে নূন্যতম কোনো মিল তো দূরের কোথা, উসমানী বা মুগোলদের সাথে তার দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। নিম্নে বর্ণিত পার্থক্যগুলো যদিও বিস্তারিত বলার দাবী রাখে কিন্তু সংক্ষিপ্ততার জন্য অল্পকথায় উপস্থাপন করছি।
প্রথম: জাতীয়তাবাদী ইসলামী রাষ্ট্র
খিলাফত ও বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের প্রথম মৌলিক পার্থক্য হলো, বর্তমানের সকল মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে জাতীয়তাবাদের আলোকে গড়ে তোলা হয়েছে। অথচ পূর্বের কোনো যুগে এর অস্থিত্ব ছিলোনা। জাতীয়তাবাদ বলা হয়, একটি নির্দিষ্ট ভুখণ্ডের সীমারেখা দিয়ে সে হিসেবে ব্যক্তির পরিচয় ও ব্যক্তিত্ব নির্ধারণ। যেমন পাকিস্তানী আফগানী বাংলাদেশী ইত্যাদি। আর এই ভিসা এম্বাসি এগুলো হলো, জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের ফলাফল। জাতীয়তাবাদের মৌলিক কিছু গুণাবলি আছে।
ক. জাতীয়তাবাদ মূলত মানুষের মাঝে পরস্পরে ঘৃণার সৃষ্টি করে। নিজ জাতি ছাড়া অন্যজাতিকে সর্বদা প্রতিপক্ষ ভাবাতে শিখায়।
খ. ভালো-মন্দের হিসাব নিজস্ব জাতীর বিবেচনায় করা হয়। যেকোনো ভালো-মন্দ বা যেকোনো স্বার্থে প্রথমে নির্দিষ্ট সে ভূখণ্ডের জাতির প্রতি লক্ষ্য রাখা হবে। যেমন, আফগানে যখন আমেরিকা আক্রমণ করে তখন পাকিস্তানে এই শ্লোগান তোলা হয়েছিলো ‘পাকিস্তানের স্বার্থই সর্বপ্রথম’।
গ. মানুষকে স্বার্থপরী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত করে তুলে। যত ধরনের অর্থনৈথিক, সামরিক উন্নতি ও অগ্রগতি আছে সবকিছুই হবে শুধু ঐ নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও তার মানুষের জন্য। এই অর্থে পুঁজিবাদ ও জাতীয়তাবাদ একই ফলাফলে পৌঁছে। তা হলো, ব্যক্তি স্বাধীনতা। একটিতে ব্যক্তিকে অফুরন্ত সম্পদ, শক্তি ও নফসের পুঁজার জন্য তৈরি করা হয় আর অন্যটিতে জাতিকে তৈরি করা হয়। (এখানে উল্লেখ্য যে, জাতীয়তাবাদ মূলত পুঁজিবাদের একটি সামর্থক বিষয়।)
ঘ. জাতীয়তাবাদে জাতির জন্য অর্থনৈথিক উন্নতি ও দুনিয়ার খুশি-তামাশা ছাড়া ব্যক্তি জীবনে উন্নতির আর কোনো লক্ষ্য দেওয়া হয়না। পুঁজিবাদই এখানে জীবনের ‘কল্ল্যাণের’ একমাত্র লক্ষ্য। একজন পুঁজিবাদি নিজেও এই জীবন গ্রহণ করে এবং অন্যরাও যাতে জীবনের লক্ষ্যতা নির্ধারণ করে তার পূর্ণ ব্যবস্থা করে দেয়।
ঙ. জাতীয়তাবাদ মানুষকে উপনিবেশবাদের মানসিকতায় বেড়ে উঠায়। তা মানুষকে একটিই লক্ষ্য দেয় তা হলো, জাতীর স্বার্থ এবং নিজ জাতি অন্য
জাতীর উপর বিজয়ী হবে, অন্য সমস্ত জাতি তার জাতির অধিনস্তে থাকবে। আর এই জন্য অন্য জাতী গোষ্ঠীকে অধিনস্ত করে এমন প্রত্যেক কাজকে ‘ভালো’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। জাতীয়তাবাদের এই চেতনা ইসলামের মৌলিক আদর্শের সাথে পূর্ণ বিপরীত।
ইসলামে ভূখণ্ডভিত্তিক স্বার্থপরতার কোনো স্থান নেই। বরং মুসলিমদের শ্রেষ্ঠত্ব এই কারণে দেওয়া হয়েছে যাতে সে অন্য জাতীর উপকারে আসে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
كنتم خير أمة أخرجت للناس تأمرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَر
“তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মাত তোমাদের বের করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে”। (সুরা আলে ইমরান: ১১০)
অর্থাৎ মুসলিম জাতীর জীবনের অন্যতম প্রধাণ মাকসাদ হলো, মানুষের সংশোধন করা। ‘এক উম্মাহ’ দর্শণের দুটো দিক।
এক হলো, উম্মাতে দাওয়াত আরেক হলো, উম্মাতে ইজাবাত। কাফেরদের সাথে মুসলিম জাতীর সম্পর্ক ঘৃণার বা বিদ্বেষের নয় বরং দাওয়াত ও সংশোধনের। কাফেরদের সাথে যখন যুদ্ধের সম্পর্ক তৈরি হয় তখন তা এই জন্য নয় যে, কাফেররা আমাদের থেকে সম্পদ ও সমৃদ্ধিতে অগ্রগামী হয়ে গেছে। মুসলিমদের যুদ্ধের একমাত্র লক্ষ্যই হলো, সত্যের সে আহবান কবুল করে তা দুনিয়ার ছড়িয়ে দেওয়ার মহান কাজে তারাও অংশীদার হোক, যা একজন মানুষের জন্য তার স্রষ্টা আল্লাহ পছন্দ করেছেন। ‘জাতীয়তাবাদ’ আর ‘উম্মাহ’ এই দুই দর্শণ কখনো একই সাথে সঠিক হতে পারে না। কারণ তা একটি অপরটির সম্পূর্ণ বিপরীত কনসেপ্ট। জাতীয়তবাদের দর্শণ প্রতিষ্ঠাই হয় ঘৃণার উপর আর ‘উম্মাহ’ এই দর্শণের মূলই হলো সম্পৃতি ও সহমর্মিতা।
পরারাষ্ট্রনীতিতে ইসলামের দর্শন
পরারাষ্ট্রনীতিতে ইসলামের দর্শন উপনিবেশবাদ নয়, বরং জিহাদ। যেখানে সম্রাজ্য বিস্তারের অর্থ অন্যদের গোলাম বানানো নয়, বরং ইসলামের দাওয়াতের পরিবেশ তৈরি করে অন্য জাতিগোষ্ঠীকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। ইসলামের খিলাফতের ইতিহাসে সর্বদা জিহাদ ছিলো। উসমানী ও মুঘল সম্রাজ্যেও পরারাষ্ট্রনীতি জিহাদের উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলো যেমন পূর্ব যুগে ছিলো।
উসমানী খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা উসমান খান ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে মাত্র সাত হাজাত বর্গমাইল নিয়ে উসমানী সম্রাজ্য শুরু করেছে যা সুলতান মুহাম্মত ফাতেহের আমলে ১৪৮১ হিজরীতে একলক্ষ্য বর্গ কিলোমিটার অতিক্রম করে ফেলে। তবে এই কথা সত্য যে, উসমানীরা শেষ যুগে ইসলামি রাষ্ট্র বিস্তারে মুসলিমদের সোনালী ইতিহাস ও সভ্যতা থেকে দূরে সরে গেছে। এবং এটাই ইসলামি খিলাফত পতনের অন্যতম কারণ। কারণ, এতে অমুসলিমদের ইসলামের অন্তর্ভুক্তি কমে গেছে যার ফলস্রুতিতে ইসলামি ব্যক্তিত্ব থাকে। এমনকি মুসলিমরাই নিজেদের সভ্যতা ও বিধান কে কঠিন মনে করতে শুরু করলো এবং নিজেদের ধ্বংসে খুশী হতে লাগলো।
দ্বিতীয়: রাসুলের প্রতিনিধি হিসেবে নয় জনগনের প্রতিনিধি হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা
গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাধারণ জনগনকে নাগরীক কারো দ্বারা শাসিত (citizens) না হয়ে শাসক (autonomous) হিসেবে ধরা হয়। রাষ্ট্র এই জনগনের সকল চিন্তা ও চাহিদার বাস্তাবায়নের কাজ করে যায়। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালকগণ জনগনের প্রতিনিধি হয় (representatives), যাদের কাজ হলো, মানুষকে এই
বিশ্বাস দেওয়া যে, তাদের সকল চাহিদা রাষ্ট্রে পূরণ করা হবে এবং জনগনের আনন্দ-উপভোগ ও চাহিদা পূরণের যথাসম্ভব ব্যবস্থপনা করে দেওয়া হবে। এটাই জনগনের প্রতিনিধি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বাস্তবতা যেখানে মানুষ্য চাহিদা অর্জনই হলো জনগনের সাথে শাসকের একমাত্র অঙ্গীকার ও তাদের পরস্পরের সম্পর্ক।
আর যে শাসক তা যত বেশি পূরণ করতে পারবে তার গ্রহণযোগ্যতা তত বেশি হবে এবং তাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য সাহায্য করা হবে। আর যারা জনগনের ‘চাহিদার’ যোগানের থলি ভরতে পারবে না, তাদের অনুসরণ যোগ্যই মনে করা হবেনা। গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পুরো দর্শন এই ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত। এবং সকল প্রতিষ্ঠান ও এনজিওসমূহ এই বিশ্বাসকেই দৃঢ় করার জন্য কাজ করে যায়। গনতন্ত্রের সারমর্মই হলো, ‘সকল সিদ্ধান্ত জনগনের চাহিদা ও ইচ্ছার অনুকুলে হতে হবে’। আর তার ফলাফল হলো, সকল ভালো-মন্দ নির্ধারণ করার মাপকাটি হলো জনগনের মন-চাহিদা।
অপরদিকে ইসলামি রাষ্ট্রে জনগন হলো প্রজা (رعية) আর শাসক জনগনের নয় আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধি। যার কাজ মানুষের চাহিদার পূরণ করা নয় বরং মানুষের চাহিদা যেনো শরীয়তের অনুগামি হয় সে মানসিকতা তৈরি করা। এই অর্থে যে রাষ্ট্র যত বেশি গনতান্ত্রিক সে রাষ্ট্র ততবেশি অনৈসলামিক।
ভোট প্রদান করা কি বাইয়াতের বিকল্প?
ভোটকে কেউ কেউ বাইয়াতের বিকল্প মনে করে থাকে, অথচ ভোট পরিপূর্ণ বাইয়াতের বিপরীত। বাইয়াতের অর্থ হলো, হেদায়েতের উদ্দেশ্যে কোনো মহান ব্যক্তির হাতে নিজের সত্ত্বাকে অর্পণ করা। আর ভোট হলো, জনগন নিজের স্বাধীনতার ক্ষমতাকে তার রক্ষা করার শর্তে কিছু মানুষের হাতে অর্পন করা। এই অর্থই জনগন হলো সকল ক্ষমতার উৎস। ইসলামে ভালো-মন্দ নির্ণয়ে জনসাধারণের ইচ্ছা বা আধিক্যের কোনো স্থান নেই বা ধারণাই নেই। ইসলামি খিলাফতে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের মৌলিকনীতি হলো, কোনো বিধান
বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টি ও ইচ্ছের অর্জন করার চেষ্টা করা। আর এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহ ও রাসুলের সন্তুষ্টি কী তা শুধু কুরআন সুন্নাহের ইলম রাখে এমন আলেমগণই বুঝতে সক্ষম। ‘শাসক জনগণের প্রতিনিধি’ রাষ্ট্র পরিচালনার এমন কোনো দর্শন খিলাফায়ে রাশেদিন থেকে নিয়ে ইসলামের পুরো ইতিহাসে কখনোই ছিলোনা। এমনকি ইসলামি জ্ঞানের কোনো শাখায় এর উল্লেখ পর্যন্ত নেই। জনগনের শাসন ও শাসক জনগনের প্রতিনিধি এই দর্শন জঘন্যতম একটি বেদআত।
তৃতীয়: উলুমে ইসলামিয়াকে বাদ দিয়ে আধুনিক জ্ঞান- বিজ্ঞানকে রাষ্ট্রে শিক্ষানীতি বানানো
বর্তমান পৃথিবীতে একটি রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তা বুঝার অন্যতম মাধ্যম হলো সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় শিক্ষা কাঠামো কী তা জানা। কারণ শিক্ষাব্যবস্থাই একটি রাষ্ট্র কী ধরনের নাগরিক চায় তা তৈরি করার কারখান। যদি মুসলমানরা কখনো শক্তির মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতেও পারে, কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ততক্ষণ স্বপ্নই রয়ে যাবে যতক্ষণ না সমাজে ইসলামি শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা হবে। কারণ শিক্ষানীতি থেকেই রাষ্ট্র পরিচালনার পলিসি ও তার বাস্তবায়নের জন্য যোগ্য লোক তৈরি হয়।
প্রতিটি শিক্ষানীতি সমাজে তিনটি উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে প্রণয়ন করা হয়।
১. রাষ্ট্রের ঐ সকল সভ্যতা ও সংস্কৃতি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে শিক্ষা দেওয়া যা অর্জন করা ছাড়া সে রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তি সফলতা অর্জন করতে সক্ষম নয়।
২. রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিককে জীবনের নির্দিষ্ট একটি উদ্দেশ্য দিবে ও নাগরীকরা সে উদ্দেশ্য তার জীবনের জন্য গ্রহণ করে পরস্পর কীভাবে সমাজে চলতে পারবে, শিক্ষানীতি রাষ্ট্রের নির্ধারন করা সে উদ্দেশ্য নাগরিকদের প্রধান করে।
৩. পরস্পরের সম্পর্কের ভিত্তিতে সে সমাজ আর রাষ্ট্র গঠিত হয় সে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যা ও তা দূরীকরণে যে পলিসি নির্ধারণ করা হয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে সে পলিসির জন্য উপযোগী যোগ্য লোক তৈরি করা।
সুতরাং কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র তখনই ইসলামি হতে পারবে যখন তার শিক্ষানীতি ইসলামিক হবে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান বা পশ্চিমা সমাজ বিজ্ঞানে নয়। কারণ যখন শিক্ষানীতিতে ইসলামের আধিক্য না হবে তখন সমাজ ও রাষ্ট্রের যেকোনো পলিসি ইসলামের অনুযায়ী করা সম্ভব হবেনা। ইসলামি জ্ঞানশাস্ত্র হলো কুরআন-হাদিস ও তার থেকে জ্ঞান আরোহনের মূলনীতিসমূহ অর্জণে শাস্ত্রসমূহ এবং ইলমে কালাম ও তাসাউফের সংকলিতরূপ। তার মধ্যে একটি হলো ফিকহ ও উসুলে ফিকহ। তা অর্জনের উদ্দেশ্য হলো, কুরআন-সুন্নাহ থেকে এমন কোনো মূলনীতি বের করা যার আলোকে মানুষের জীবনের সকল কাজ কিভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে, তার সঠিক পদ্ধতি নির্ণয় করা।
বিপরীত দিকে পশ্চিমা সমাজ বিজ্ঞানের পরিনাম হলো পুঁজিবাদী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা। পুঁজিবাদের বাস্তবায়নের সম্ভাব্য সকল পলিসি নির্ধারণ করা ও রাষ্ট্রের সংবিধান সেনুযায়ী সুবিন্যস্ত করা। পশ্চিমা সমাজ বিজ্ঞান একদিকে পুঁজিবাদি সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিগঠনের তত্ত্ব সামনে আনে। অন্যদিকে জনগনের মাঝে স্বাধীন ইচ্ছে শক্তির এমন সব মৌলিক ভিত গড়ে তুলে যাতে অটোমেটিক রাষ্ট্র ও সমাজ পুঁজিবাদে গঠিত হয়ে যায়। এক কথায় পশ্চিমা সমাজ বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যে হলো সমাজ ও রাষ্ট্রে এমন এক নতুন সংবিধান, রীতি-নীতি প্রণয়ন ও এমন রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা যার সাথে আসমানি ওহির কোনো সম্পর্ক নেই।
এই দৃষ্টিতে যদি আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র আর ইসলামি রাষ্ট্রনীতি তুলনা করা হয় তাহলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে চৌদ্দশত বছরে যে জ্ঞান শাস্ত্রের প্রভাব ছিলো তা ছিলো ইসলামি জ্ঞান শাস্ত্রের। যার বর্তমান রূপ হলো উপমহাদেশের দরসে নেজামি।
আমাদের ইতিহাসে ইসলামি জ্ঞান শাস্ত্রের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রীয় পলিসি প্রণয়ণ করা হতো। হাঁ, কখনো শাসকরা নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থের জন্যেও অনেক পলিসি প্রণয়ন করতো। বর্তমান জামানায় যেমন রাষ্ট্রীয় যেকোনো পলিসি সমাজ বিজ্ঞানের আলোকে বিশেষ করে পুঁজিবাদের আলোকে গঠন করা হয় আর শাসকরা এই সমস্ত পলিসি আর নিয়মের ভিতরে থেকেই নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে থাকে।
আজ এই কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, যত দ্রুত পশ্চিমা সাইন্সে অগ্রগতি হচ্ছে ততটাই দ্রুত ইসলামি জ্ঞান শাস্ত্র মানুষের কাছে অহেতুক মনে হচ্ছে। আধুনিক সাইন্সের উদ্দেশ্যই হলো মানুষের সীমাহীন চাহিদাকে দুনিয়াতে পূর্ণ করার কর্তৃত্ব তার হাতের মুঠোয় এনে দেওয়া। আধুনিক সাইন্স অনুযায়ী আল্লাহর সন্তুষ্টি জীবনের উদ্দেশ্য নয় বরং দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় এনে নিজের চাহিদা ও ইচ্ছা শক্তিকে সকলকিছুর উপর প্রতিষ্ঠিত করা। আধুনিক বিজ্ঞান এরকম জাহেলি চিন্তা আর পাগলামিকে আরো উস্কে দেয় যে, মানুষ তার আকল-বুদ্ধি ব্যবহার করে সকল গোপন রহস্য উন্মোচন করে নিজেকে ছাড়া সকল প্রকার শক্তির অধীনস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে যেতে পারবে। এক কথায় মানুষ নিজেই নিজের খোদায় পরিনত হতে পারবে এই বিশ্বাস তার মাঝে তৈরি করা।
এই শিক্ষানীতি ঐসকল মানুষকেও সমাজের একজন প্রতিষ্ঠিত, সম্মানি ও জ্ঞানী ব্যক্তি করে তুলে, যারা নবিদের শিক্ষা ও আদর্শ থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে যদিও সে বিভিন্ন ঘৃণিত স্বভাবের অধিকারীও হয়না কেন! এই শিক্ষানীতিই রাষ্ট্রে সকল রীতি-নীতি তৈরিতে ভূমিকা রাখে যার পুরো ভিত্তি হয় মানুষের কামনা-বাসনা। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টি নয়। যেহেতু বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে এই জাহিলি শিক্ষানীতি প্রতিষ্ঠিত, তাই কোনোভাবেই ইসলামি খিলাফাহ বা রাষ্ট্রের সাথে তার কোনো মিল নেই। উল্টো সমাজে যতই এই শিক্ষানীতি মজবুত হচ্ছে ততই উপনিবেশবাদ ও তাগুতি সিস্টেম মুসলিম রাষ্ট্রকে গ্রাস করে ফেলার কাজে সহযোগিতা করছে।
চতুর্থ: শরীয়া আইনের বিপরীত হিউম্যান রাইটসকে (মানবতাবাদ) রাষ্ট্রের সংবিধান বানাবো
আমাদের রাষ্ট্রসমূহের সকল আইন-কানুন প্রণয়ন হয় সংবিধান অনুযায়ী। আর এই সংবিধান আল্লাহর হাকিমিয়্যার বিপরীত মানুষের হাকিমিয়্যাহ প্রতিষ্ঠা করে। আর তা প্রণয়ন করা হয়েছে শরীয়ত বাস্তবায়নের সকল সম্ভাব্য পথ বন্ধ করে দিয়ে। কারণ সংবিধানের মর্যাদা গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ঐ পরিমান, যেমন একটি শরীয়া রাষ্ট্রে আসমানী গ্রন্থ কুরআনের যে মর্যাদা। গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রর সংবিধানের যেকোনো আইন প্রণয়নের ভিত্তি হলো হিউম্যান রাইটস। পৃথিবীর কোনো গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইন যদি হিউম্যান রাইটসের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে তা আইনীভাবে অগ্রহনযোগ্য বলে ধর্তব্য হয়, যেমন ইসলামি খিলাফাহ ব্যবস্থায় কোনো আইন যদি কুরআন-সুন্নাহের বিপরীত হয়। হিউম্যান রাইটসের খোলাসা কথাই হলো, রাষ্ট্রের প্রতিটি ব্যক্তিকে তার স্বাধীন ইচ্ছেমতো যেকোনো কাজ করতে পারার অধিকার দেওয়া। আর এই আইন দুটো উদ্দেশ্য সামনে রেখে তৈরি করা হয়।
এক, প্রত্যেক ব্যক্তির যা চাইবে সে চাওয়ার অধিকার তার থাকবে এবং তা অর্জন করতে পারবে, যতক্ষণ না তা অন্যের স্বাধীনতার মাঝে বিঘ্নতা সৃষ্টি না করে। যেমন ধরে নিন, এক ব্যক্তি মদ পান করতে চায়। এখন প্রশ্ন দাঁড়াবে যদি সকল মানুষ মদ পান করতে চায় তাহলে কি সকলের জন্য এভাবে মদের অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে? যেহেতু সকল মানুষকে মদ পানের অনুমতি দিলে কারো ব্যক্তি স্বাধীনতায় কোনো বিপ্লতা আসেনা সেহেতু হিউম্যান রাইটসের উপর প্রতিষ্ঠিত গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মদ পান করা কোনো গর্হিত কাজ নয়।
কিন্তু বিপরীত কোনো মানুষ যদি মদ পান করে গাড়ি চালাতে চায় তাহলে তাহলে তার এই কাজ অন্যায় হিসেবে ধর্তব্য হবে। কারণ সকল মানুষকে যদি এই কাজের অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে কেউ গাড়ি চালাতে পারবেনা। কারণ তাতে অন্যের ক্ষতি হবে। এই মূলনীতির কারণেই পরস্পরের সেচ্ছাসম্মতিতে ভাই বোনের সাথে বিবাহ করা, পিতা তার মেয়ের সাথে বা ছেলে তার মায়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক করা কোনো গর্হিত কাজ নয়। কারণ যদি সকল মানুষ এই কাজ করে তাহলে অন্যের স্বাধীনতায় তাতে কোনো ব্যাঘাত ঘটবেনা। চরিত্রের এই মূলনীতিকে ক্যান্টের উদ্ভাবিত বৈশ্বিকনীতি (Principle of universalizability) বলা হয়। এই মূলনীতি অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তির আইনগতভাবে ঐকাজ ও ইচ্ছের বাস্তবায়ন করার অনুমতি আছে যা অন্যের স্বাধীনতার পথে বিঘ্নতা সৃষ্টিতে কোনো বাঁধা হবেনা।
দুই, প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীন অধিকারকে এমনভাবে সাজানো যাতে সে তার স্বাধীনতাকে এমনভাবেই ব্যয় করতে বাধ্য হয় যার ফলে অন্যের স্বাধীনতায় কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করতে পারে। যেমন কোনো পিতা যদি তার মেয়েকে রাত্রে ইউনিভার্সিটির কোনো অনুষ্ঠানে যেতে নিষেধ করে তাহলে মেয়ের এই অধিকার আছে, সে পুলিশ ঢেকে এনে আদলের সামনে শান্তির জন্য সম্মুখীন করতে পারবে। তেমনি কোনো পিতা যদি তার সন্তানকে নামাজের জন্য বাধ্য করে তাহলে সন্তানের আইনত এই অধিকার রয়েছে যে, সে তার পিতাকে এজন্য পুলিশে দিতে পারবে।
হিউম্যান রাইটস অনুযায়ী প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধান হওয়ার একমাত্র ভিত্তি হলো মানুষের খাহেশাত ও প্রতিটি আইন তৈরি করা হবে এই দর্শনকেই সামনে রেখে, যাতে প্রতিটি মানুষের আইনের মাধ্যমে বেশি থেকে বেশি নিজের স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে। বর্তমানের প্রায় অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রের আইনের মূল ভিত্তিই হল এই হিউম্যান রাইটস। এবং বিশ্বের মোড়লদের কাছে শুধু সেই আইনই আইন হওয়ার উপযুক্ত যাতে হিউম্যান রাইটসকে ভিত্তি বানানো হয়েছে।
উপসংহার
এই হলো একটি খিলাফাহ রাষ্ট্র তত্ত্ব ও আধুনিক রাষ্ট্র তত্ত্বের পার্থক্যের মৌলিক কিছু দিক। এছাড়াও আরো অসংখ্য মৌলিক পার্থক্য ও শাখাগত হাজারো পার্থক্য রয়েছে। একটি মৌলিক কথা মনে রাখতে হবে, দুটো বস্তুর মৌলিক গঠণের মূলধাতুই যদি ভিন্ন হয় তাহলে বাহ্যত কিছু মিলের কারনে তা কখনই এক হয় না। একজন মানুষ আর একটি বানরের সৃষ্টির মূল ধাতুই ভিন্ন, এক মানুষের কিছু আচরণ যদি বানরের মাঝে পাওয়া যায় এতে যেমন বানরকে মানুষ বলা যায় না, তেমনি বানরের কিছু আচরণ মানুষের মাঝে পাওয়া যাওয়ার কারনে তাকেও বানর বলা হবে না।
তেমনি ইসলামের কিছু শাখাগত বিষয় গণতন্ত্রের মাঝে পাওয়া গেলেই তা কখনোই ইসলামি হয়ে যাবে না। তেমনি ইসলামের কোনো সুন্দর কিছু গণতন্ত্রের মাঝে পাওয়া গেলে তাও গণতন্ত্র হয়ে যাবে না। কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয় হলো, কুকুর আর মানুষের কিছু বাহ্যত কিছু মিল দেখে কুকুর ও মানুষ মূলত একই বস্তু এই অসম্ভব এক সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে ইসলামি গণতন্ত্রের প্রবক্তাগণ! আল্লাহ তাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুক। ও এই চিন্তার মানুষ থেকে উম্মতে মুসলিমাকে হিফাজত করুক। আমীন
উপসংহার : খিলাফত রাষ্ট্র ও আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র মধ্যে পার্থক্য আলোচনা, খিলাফত রাষ্ট্র ও আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র তুলনামূলক আলোচনা, খিলাফত রাষ্ট্র ও আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র বৈসাদৃশ্য গুলো তুলে ধর
একাডেমিক শিক্ষা বিষয়ক লিখিত প্রশ্ন সমাধান পেতে ক্লিক করুন।