গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের রাজস্ব সংস্কারের বিবরণ দাও
সুশাসক ও প্রশাসক হিসেবে ওয়ারেন হেস্টিংসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য । ক্লাইভ বাংলাদেশ তথা ভারতে কোম্পানির রাজত্বের যে সূচনা করেছিলেন , দক্ষ প্রশাসন দ্বারা ওয়ারেন হেস্টিংস তাকে দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছিলেন ।
প্রশাসক হিসেবে দক্ষ হলেও , এ কথা সত্য যে , ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রশাসনের মূল লক্ষ্য ছিল কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা ও বৃদ্ধি করা । তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে , প্রশাসনকে দক্ষ ও দুর্নীতি মুক্ত করতে না পারলে কোম্পানির স্বার্থ রক্ষিত হবে না । বস্তুত দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত শাসন দ্বারা তিনি চেয়েছিলেন—
( ১ ) কোম্পানির বাণিজ্যিক আয় ও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করতে ।
( ২ ) কোম্পানির সামাজিক স্বার্থ পূরণ করা এবং
( ৩ ) ভারতে আগত ইংরেজ জনগণের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযােগ সুবিধা বৃদ্ধি করা । উপর্যুপরি পলাশী ও বক্সার -এর যুদ্ধে বিপর্যয়ের ফলে বাংলায় নবাবি প্রশাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল । তদুপরি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল বাদশার হটকারী সিদ্ধান্তের ফলে ‘ দেওয়ানি ’ লাভ করে যে “ দ্বৈত শাসন ” শুরু করে , তাতে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ঘােরালাে হয়ে ওঠে । এই অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলার সুযােগ নেয় কোম্পানির স্বার্থান্ধ কর্মচারীরা । তারা বাংলা ও কোম্পানির স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নিজেদের স্বার্থপূরণে মনােযােগী হয়ে ওঠে । ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে । কোম্পানির কর্মচারীদের অসততার ফলে কোম্পানির আয়ও প্রচুর কমে যায় । এহেন অবস্থায় ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর -এর দায়িত্ব নিয়ে ভারতে আসেন ( ১৭৭২ খ্রিঃ ) । পরের বছরের রেগুলেটিং আইন জারি করে তাকে ‘ গভর্নর জেনারেল ’ আখ্যা দেওয়া হয় । এই নতুন সম্মানের মর্যাদা রক্ষার জন্য তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করেন ।
ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রশাসনিক সংস্কার
‘ দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার ’ কুফল সম্বন্ধে তিনি পূর্বেই অবহিত হয়েছিলেন । তাই ভারতে এসেই হেস্টিংস এক আদেশবলে দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটান ( ১৭৭২ খ্রিঃ ) এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি কোম্পানির হাতে নেন । দ্বৈত শাসনের দুই অত্যাচারী নায়ক রেজা খাঁ ও সীতাব রায়কে অভিযুক্ত করে পদচ্যুত করা হয় এবং নায়েব ও সুবা পদ দুটি বিলুপ্ত করা হয় । তিনি নবাবের বাৎসরিক ভাতা ৩২ লক্ষ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ লক্ষ টাকা করেন । সরকারি কোষাগার মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয় । কোম্পানির সদরদপ্তর হয় কলকাতা । ফলে এখন থেকেই কলকাতার রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে ।
ওয়ারেন হেস্টিংসের রাজস্ব সংস্কার
রাজস্ব ব্যবস্থাকে ন্যায়সঙ্গত ও নিয়মিত করার জন্য হেস্টিংস বেশ কয়েকটি সংস্কার সাধন করেন । তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ন্যায্য দাবির ভিত্তিতে ভূমি রাজস্বের পরিমাণ কিছু কালের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া , যাতে জমিদার ও কোম্পানি । উভয়েই স্ব স্ব প্রাপ্য ও দেয় রাজস্ব সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতে পারে । এজন্য তিনি কয়েকটি ব্যবস্থা নেন । স্থির হয় , পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হবে । প্রত্যেক জেলায় হাজির হয়ে জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করার জন্য একটি ভ্রাম্যমাণ কমিটি ( Committee of Circuit ) গঠন করা হয় । ইতিপূর্বে কোম্পানির রাজস্ব বিষয়ে তত্ত্বাবধান করার জন্য ‘ সুপারভাইজার ’ নামক কর্মচারী ছিল । হেস্টিংস এদের নতুন নামকরণ করেন ‘ সংগ্রাহক ’ বা ‘ কালেক্টর ’ ( Collector ) । এইসব শ্বেতাঙ্গ কালেক্টরের হাতে রাজস্ব আদায়ের ভার ন্যস্ত হয় । দেওয়ানি বিষয়ে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব দেওয়া হয় বোর্ড অব রেভিনিউ ( Board of Revenue ) নামক একটি সভার উপর । কাউন্সিলের দুজন সদস্য এবং তিনজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে নিয়ে এই রাজস্ব বাের্ড গঠন করা হয় । ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা , বিহার ও উড়িষ্যাকে ছয়টি অঞ্চলে ভাগ করে প্রত্যেকটিকে একটি প্রাদেশিক কাউন্সিলের অধীনে রাখা হয় । প্রত্যেক কাউন্সিলকে সাহায্য করার জন্য একজন করে ভারতীয় দেওয়ান নিযুক্ত করা হয় । কাউন্সিলের সদস্যরা যাতে দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারেন , তার জন্য তাদের মাসিক তিন হাজার টাকা বেতন স্থির হয় ।
একশালা বন্দোবস্ত
হেস্টিংস ভেবেছিলেন , পাঁচশালা ব্যবস্থার ফলে প্রকৃত জমিদাররা উপকৃত হবে এবং রাজস্ব আদায় সুনিশ্চিত হবে । কিন্তু দেখা গেল প্রকৃত জমিদারের বদলে বহু ফড়ে-মহাজন জমি বন্দোবস্ত পেয়ে গেছে । কোম্পানির কর্মচারীরাও জমিদারি বৃত্তিতে যুক্ত হয়ে পড়েছে । অত্যাচার বেড়েছে চাষিদের উপর । এমতাবস্থায় হেস্টিংস পূর্বসিদ্ধান্ত বাতিল করে পুনরায় এক বছরের জন্য বন্দোবস্ত ( একশালা ) প্রথা চালু করেন । ভ্রাম্যমাণ কমিটিও ইতিমধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল । তাই তিনি এই কমিটি উঠিয়ে দেন এবং প্রাদেশিক কাউন্সিলেরও বিলােপসাধন করে রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্ত কর্তৃত্ব রাজস্ব বাের্ডের হাতে অর্পণ করেন । দুর্নীতিগ্রস্ত হবার জন্য ‘ কালেক্টর ’ পদেরও অবসান ঘটানাে হয় । অতঃপর ( ১৭৭৬ খ্রিঃ ) রাজস্ব সংক্রান্ত কাজ সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য হেস্টিংস ‘ আমিনি কমিশন ’ ( amin commission ) নিযুক্ত করেন ।
ওয়ারেন হেস্টিংসের বাণিজ্য সংস্কার
কোম্পানির বাণিজ্যবৃদ্ধির জন্য হেস্টিংস ‘ দস্তক ‘ প্রথা লােপ করেন ( ১৭৭৩ খ্রিঃ ) । ফলে কোম্পানির কর্মচারী ও এজেন্টদের অবৈধ বাণিজ্য করার সম্ভাবনা হ্রাস পায় । কেবলমাত্র লবণ , সুপারি ও তামাকের উপর কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য অধিকার বজায় রেখে অন্যান্য দ্রব্যের বাণিজ্য সকলের নিকট উন্মুক্ত রাখা হয় । এজন্য ভারতীয় বা ইউরােপীয় সকলকেই শতকরা ২.৫ টাকা হারে শুল্ক দিতে বলা হয় । জমিদারদের নিজস্ব শুল্ক আদায়ের ঘাঁটিগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয় । ফলে সমগ্র প্রদেশে দ্রব্যচলাচল সহজ হয়ে ওঠে । তিনি কেবলমাত্র ৫ টি শুল্কর্ঘাটি বজায় রাখেন । এগুলি হল মুর্শিদাবাদ , হুগলী , কলকাতা , পাটনা এবং ঢাকা । তাঁতিদের উপর যাতে অত্যাচার না হয় , সে বিষয়ে তিনি কঠোর নির্দেশ জারি করেন । বাণিজ্যের উন্নতির জন্য হেস্টিংস ভুটান ও তিব্বতে জর্জ বােগল-এর নেতৃত্বে বাণিজ্য প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন । মুদ্রাসংস্কারের প্রতিও তিনি আগ্রহী হয়েছিলেন ।
ওয়ারেন হেস্টিংসের বিচার বিভাগীয় সংস্কার
বিচার বিভাগের দুর্নীতি দূর করে বিচার ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু , সুস্থ ও ন্যায় সংগত করার জন্য হেস্টিংস বিশেষ মনােযােগী হয়েছিলেন । তাঁর এদেশে আগমনকালে দ্বৈত শাসনের ফলে বিচার ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছিল । নবাবের হাতে ছিল ফৌজদারি বিচার পরিচালনার দায়িত্ব । কারণ তৎকালীন রীতি অনুযায়ী রাজস্ব ও বিচার বিভাগ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল । কিন্তু প্রকৃত অর্থে কোনাে ক্ষমতা না থাকার ফলে নবাব যথাযথভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে পারছিলেন না । ফলে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতাে বিচার ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছিল । হেস্টিংস বুঝেছিলেন যে , বিচার ব্যবস্থার পুনর্গঠন করতে না পারলে দেশে দুর্নীতি দূর করা যাবে না । আর দুর্নীতি দূর না হলে কোম্পানির বাণিজ্যিক তথা আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বার্থও সিদ্ধ হবে না । তাই তিনি মুঘল আমলের জটিল বিচার পদ্ধতি পরিহার করে ইউরােপীয় আধুনিক বিচার ব্যবস্থা প্রণয়নে উদ্যোগী হন ।
বিকেন্দ্রীকরণ
বিচার ব্যবস্থাকে জনমুখী ও সহজলভ্য করে তােলার উদ্দেশ্যে হেস্টিংস সমগ্র বাংলাকে ৩৫ টি জেলায় বিভক্ত করেন । প্রতিটি জেলাই দেওয়ানি ও ফৌজদারি ( নিজামতি ) বিচারের সর্বনিম্ন ভিত্তি ( unit ) হিসেবে গৃহীত হয় । ভ্রাম্যমাণ কমিটির সুপারিশ অনুসারে প্রতিটি জেলায় একটি করে মফঃস্বল দেওয়ানি আদালত ও মফঃস্বল ফৌজদারি আদালত স্থাপন করা হয় । হিন্দু পণ্ডিতদের সহায়তায় ‘ হিন্দু আইন বিধি ’ সংকলন করা হয় । মফঃস্বল দেওয়ানি আদালতের বিচার পরিচালনা করতেন কালেক্টরগণ । বিচারে তাদের সাহায্য করতেন হিন্দু পণ্ডিত ও মৌলবিগণ । এঁদের পরামর্শে হিন্দু ও মুসলিম আইন অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালিত হত । জেলা ফৌজদারি আদালতে কাজি ও মুফতিগণ বিচার পরিচালনা করতেন । উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণসহ ফৌজদারি বিচার পরিচালিত হচ্ছে কিনা , তা কালেক্টরগণ তত্ত্বাবধান করতেন । এর উপরে ছিল ‘ সদর দেওয়ানি আদালত ’ ও ‘ সদর নিজামত আদালত ’ । এই বিচারালয় দুটি যথাক্রমে কলকাতা ও মুর্শিদাবাদে স্থাপিত হয়েছিল । মফঃস্বল দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যথাক্রমে সদর দেওয়ানি ও সদর নিজামত আদালতে আপিল করা যেত । জেলা ফৌজদারি আদালত সদর নিজামত আদালতের অনুমােদন ব্যতীত কারও প্রাণদণ্ড কার্যকর করতে পারত না । সদর নিজামত আদালতে বিচারকার্য পরিচালিত করতেন নবাবের প্রতিনিধি ও প্রধান কাজি । গভর্নর জেনারেল ও তার কাউন্সিল এই আদালতের কাজকর্মের উপর নজর রাখতেন ।
বিচার বিষয়ক নিয়ম
হেস্টিংস-এর শাসনকালে বিচারবিভাগে কয়েকটি নিয়ম চালু হয় । তাঁর নির্দেশে প্রত্যেক আদালতে মােকদ্দমা সংক্রান্ত নথিপত্র রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় । নিয়ম করা হয় যে , ঘটনায় বারাে বছরের মধ্যে মামলা রুজু করলে তা তামাদি হয়ে যাবে । সুদের হার নিয়ন্ত্রিত রাখার প্রতিও সরকারি নজরদারি বৃদ্ধি করা হয় । বিচারের ক্ষেত্রে হেস্টিংসের বড় অবদান হল যে , তিনি আইনের চক্ষে সকলের সম-অধিকারের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন এবং বিচারব্যবস্থাকে কাজির মর্জির উপর নির্ভরশীল না রেখে তাকে কিছুটা ন্যায়ানুগ ও বিশ্বাসযােগ্য করে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন ।