গ্রন্থ সমালোচনা: রাইফেল রোটি আওরাত, রাইফেল রোটি আওরাত গ্রন্থ সমালোচনা, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’, রাইফেল রোটি আওরাত: মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস, রাইফেল রোটি আওরাত PDF রিভিউ

প্রশ্ন সমাধান: গ্রন্থ সমালোচনা: রাইফেল রোটি আওরাত, রাইফেল রোটি আওরাত গ্রন্থ সমালোচনা, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’, রাইফেল রোটি আওরাত: মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস, রাইফেল রোটি আওরাত PDF রিভিউ, আনোয়ার পাশার উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’

‘রাইফেল রোটি আওরাত’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসকে মুক্তিযুদ্ধের অনেকে একটি প্রামাণ্য দলিলও বলে থাকেন। উপন্যাসের রচয়িতা শহীদ আনোয়ার পাশা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক আনোয়ার পাশা ছিলেন একাধারে নির্ভীক শিক্ষক, সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাত, যা আসলে তাঁর নিজের বয়ানে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে পরবর্তী কিছুদিনের প্রতিটি মুহুর্তের বর্ণনা। উপন্যাস যে কালের সাক্ষী হয়ে উঠতে পারে, বহন করতে পারে সময়ের চিহ্ন তার প্রমাণ ‘রাইফেল রোটি আওরাত’।

উপন্যাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সুদীপ্ত শাহীন চরিত্রের আড়ালে আনোয়ার পাশা নিজেকেই একেঁছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন দেশের ক্রান্তিকালে বিভিন্ন মানুষের মনস্তত্ব। তিনি দেখেছেন প্রগতিশীলতার আড়ালে অনেকের পাকিস্তানপন্থী মনোভাব, আবার অনেককে দেখেছেন গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে।

সুদীপ্ত শাহীনের বয়ানে উপন্যাসটিতে আমরা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ দেখি, সুদীপ্তর মনযাতনা দেখি, পাশাপাশি নতুন দিনের আশাবাদও দেখি। আনোয়ার পাশা উপন্যাস শুরু করেছেন “বাংলাদেশে নামলো ভোর” –লাইনটি দিয়ে। শেষ করেছেন, “নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত। সে আর কতো দূরে। বেশি দূরে হ’তে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো! মা ভৈঃ! কেটে যাবে।”– কিন্তু লেখক যে স্বাধীন ভোর দেখার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, তা তিনি দেখে যেতে পারেননি।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আনোয়ার পাশা ঘাতক আলবদর কর্তৃক অপহৃত ও নিহত হন। আনোয়ার পাশা স্বাধীন দেশের নতুন ভোর দেখে যেতে না পারলেও আমাদের জন্য রেখে গেছেন নতুন ভোরের বার্তা। যদিও মানুষ তাঁকে বেশি চেনে এই উপন্যাসটি দিয়ে তবে তাঁর রচিত আরো কিছু গল্প, উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ, প্রবন্ধ রয়েছে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা করেছেন। রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা নামে দু’খন্ডের সমালোচনা গ্রন্থ লিখেছেন।

ষাটের দশকে আইউব সরকারের আমলে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালন করার অপরাধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁর পাসপোর্ট ছয় বছরের জন্য স্থগিত করে। তিনি ১৯৭১ সালে প্রবন্ধ গবেষণায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০২০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত হন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সাহায্য করেছেন।


আরো ও সাজেশন:-

পরিবারের স্মৃতিতে আনোয়ার পাশা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের পাশে আনোয়ার পাশা নামে একটি আলাদা ভবনে এখন তাঁর দুই ছেলে ও স্ত্রী মোহসিনা খাতুন থাকেন। আনোয়ার পাশার ছোট ছেলে প্রকৌশলী রবিউল আফতাবের সঙ্গে কথা হয় ভয়েস অফ আমেরিকার এই প্রতিবেদকের। রবিউল আফতাব বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত আছেন। তাঁর কাছ থেকে জানা গেলো মুক্তিযুদ্ধকালীন ও পরবর্তী সময়ের অনেক স্মৃতিচারণ এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সংগ্রামের কথা।

“বাবা যখন মারা যান তখন আমার বয়স মাত্র ছয় বছর। বাবা খুবই স্নেহপরায়ণ মানুষ ছিলেন। আমি প্রথম স্কুলে যাই বাবার হাত ধরে। বাবা রেডিও পাকিস্তানে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন। তিনি বাসায় এলে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করতাম, বাবা আপনি রেডিওর ভেতরে কিভাবে ঢুকলেন! বাবার এই স্মৃতিগুলো আমার ভীষণ মনে পড়ে। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও আনোয়ার পাশা এই তিনজনের স্মৃতিচারণ করে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে ড. নীলিমা ইব্রাহিমের স্মৃতিচারণে জানতে পারি বাবা রেডিও পাকিস্তানে অনেক আগে থেকেই অনুষ্ঠান করতেন। যেসব অনুষ্ঠান বাংলাদেশের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিপক্ষে যায় সেসব অনুষ্ঠান তিনি করতেন না। যুদ্ধের ভেতরেও এমন অনেক অনুষ্ঠান করবার চাপ ছিলো তাঁর ওপর। সেগুলো তিনি করেননি।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হঠাৎ করেই অসংখ্য মানুষের চিৎকার, আর্তনাদ ভেসে আসে। তখন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হল বর্তমানে জহুরুল হক হলের চারতলায় থাকতাম। চারতলা থেকেই দেখি, চারপাশ আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি আর্মিরা ইকবাল হলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। এখন যেটা মহিলা কর্মজীবী হোস্টেল, তার সামনে আগে রেললাইন ছিলো।

রেললাইনের দু’পাড়ের বসতিতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে অনেক বস্তিবাসী আমাদের ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলো। ২৭ মার্চ সকালে কিছু সময়ের জন্য কারফিউ তুলে নেয়া হয়। সে সময় বাবা ছাদে গিয়ে অনেক লাশ দেখেছিলেন। ছাদে, সিড়িতে, ভবনের আশেপাশে আমরা লাশ পড়ে থাকতে দেখি। রক্তের দাগ, মাথার চুল দেয়ালে লেগেছিলো। যে সময়টাতে কারফিউ ছিলো না, সে সময়ে আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে যাই। কারণ আমার আম্মা এই পরিস্থিতির ভেতর আর থাকতে চাচ্ছিলেন না। আমরা তখন রায়েরবাজারে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠি। মে মাস পর্যন্ত আমরা বাসার বাইরে কাটিয়েছি।এরপর আমরা প্রথমে নীলক্ষেত এলাকায় ছিলাম, তারপর ঈসা খান রোডের বাসায় উঠি। ”

বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করে বললেন, “১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকালে বাবা নাশতা করছিলেন। সঙ্গে ছিলেন রাশিদুল হায়দার (ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক)। আমরা বারান্দায় ক্যারাম বোর্ড খেলছিলাম। উঁকি দিয়ে দেখলাম অস্ত্র হাতে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তখনও বুঝতে পারিনি আমাদের বাসাতেই এসেছে। এরপরের ঘটনাগুলো খুব তাড়াতাড়ি ঘটে যায়। বাবাকে, রাশিদ চাচাকে ধরে নিয়ে যায়।

উল্টোদিকের বাড়ি থেকে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যকেও নিয়ে যায়। সবাইকেই তারা চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। খুব নিষ্ঠুর ও অমানবিক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে ঘটনাগুলো ঘটে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারির ২ বা ৪ তারিখে আব্বার মৃতদেহ পাওয়া যাওয়ার খবর পাই। সেদিন সকালে যারা এসে আব্বা এবং অন্যান্য শিক্ষকদের ধরে নিয়ে যায়, তারা ‘ইপিআরটি’র বাসে চড়ে এসেছিলেন। বাস ড্রাইভারকে পরে শনাক্ত করা হয়েছিলো। সেই ড্রাইভার মিরপুর শিয়ালবাড়ির বধ্যভূমির সন্ধান দিয়েছিলো। সেখানেই লাশ পাওয়া যায়।”

[ বি:দ্র: নমুনা উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)]

স্বাধীনতার পরে কঠিন একটা সময় পার করে এসেছেন এই শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবার। বললেন, “স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যেক শহীদ শিক্ষকের পরিবারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসাগুলিতে ষোল থেকে আঠার বছর বসবাস করার সুযোগ দেয়। এছাড়াও পরিবারগুলোকে একটা মাসিক ভাতা দেয়া হতো যা আসলে খুবই কম ছিলো। এই দিয়ে খুব কষ্টেই সংসার চলতো। একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিলো। পাশাপাশি স্বজন হারানোর মানসিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠাটাও সময়সাপেক্ষ ছিলো। শুধু আমরা না, সব শহীদ পরিবারই ভয়াবহ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গেছে।

এর মধ্যেই আমাদের পরিবারে আরেকটা দুর্ঘটনা ঘটে। আব্বা যখন নিহত হন, বড় ভাই তখন কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ১৯৭২ সালে তিনি এইচএসসি পাশ করেন। ১৯৭২ সালে তাকে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বামপন্থী সন্দেহে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পুলিশকে তথ্য দেয়া হয়েছিলো আমাদের বাসায় অস্ত্রের মজুদ আছে এবং বড়ভাই খুব সক্রিয়ভাবে বাম রাজনীতি করে। এটা মার্চ-এপ্রিলের দিকের ঘটনা ছিলো। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর হস্তক্ষেপে ছাড়া পায়। এই ঘটনা এবং আব্বাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার মানসিক ধাক্কা সে কখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সে খুব নিরীহ ও মেধাবী ছাত্র ছিল। কিন্তু এই ঘটনার ধাক্কায় মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েও পড়াশুনা চালিয়ে নিতে পারেননি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সে ভর্তি হন, কিন্তু সেখানেও পড়া শেষ করতে পারেননি। মানসিক সমস্যা বেড়েই চলছিলো। আমরা ছিলাম অভিভাবকশূন্য। অর্থনৈতিক অবস্থারও বেহাল দশা। তখন বাংলাদেশে মানসিক রোগের ভালো চিকিৎসাও ছিল না, এ অসুখ নিয়ে আমাদের কারো কোনো ধারণাও ছিলো না। পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা করা হতো। ভায়োলেন্ট হয়ে গেলে ইলেকট্রিক শক দেয়া হতো। খুব অমানবিক ও কঠিন সময় পার করেছি আমরা। পরে বড় ভাইয়ের মানসিক সমস্যা কমেছে তবে এখন অনেক ধরণের শারীরিক সমস্যার জন্য চিকিৎসাধীন আছেন। আমার মা’ও গত দুইবছর ধরে শয্যাশায়ী। জিবিএস ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিনি চলৎশক্তি হারিয়েছেন। মা আর বড় ভাইয়ের দেখাশোনা আমিই করি।”

‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ উপন্যাসের পান্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া ও বইটি প্রকাশ সম্পর্কে জানান, “বাবা যে এরকম একটা পান্ডুলিপি লিখেছেন সেটা আমরা জানতাম। ১৯৭১ সালে তখন রোজার মাস । পাকিস্তানি মিলিটারিরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সব বাসায় বাসায় ঢুকে চেক করতে লাগলো। ইফতারের সময় হয়ে যাওয়াতে সেবার তারা আমাদের বাসায় না ঢুকেই চলে গিয়েছিলো। কিন্তু যদি বাসায় ঢুকে, সেই আতঙ্কে আমার আম্মা পান্ডুলিপি লুকানোর জায়গা খুঁজতে লাগলেন। প্রথমে টয়লেটের কমোডের উপরের ফ্ল্যাশের উপর রাখার চেষ্টা করেন। সেখানে রাখা সম্ভব হয়নি। তারপরে মিটসেফের ভেতরে পান্ডুলিপি রেখে তার উপরে কাগজ বিছিয়ে হাড়ি-পাতিল রেখে দেন। যাতে বাসায় ঢুকে খুঁজলেও পান্ডুলিপি পাওয়া না যায়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক ড. কাজী আব্দুল মান্নান ছিলেন বাবার বন্ধু। তিনি জানতেন বাবার ডাইরি লেখার অভ্যাস ছিলো। তিনি বাবার মৃত্যুর পরে তাঁর সব লেখাগুলো খুঁজে বের করেন, ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ উপন্যাসের পান্ডুলিপিটি সংগ্রহ করেন। ‘গণমিছিল’ প্রকাশনা থেকে বইটি প্রথম ছাপা হয়। পরে ড. কবীর চৌধুরী বাংলা একাডেমি থেকে বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন।”


Paragraph/Composition/Application/Email/Letter/Short Storiesউত্তর লিংক
ভাবসম্প্রসারণ/প্রবন্ধ, অনুচ্ছেদ/ রচনা/আবেদন পত্র/প্রতিবেদন/ চিঠি ও ইমেলউত্তর লিংক

বাবার কাজের মুল্যায়ন ও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরপূর্তী প্রসঙ্গে বলেন, “আমার বাবা সরাসরি কখনও কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবে রাজনৈতিক সচেতনতাবোধ ছিলো প্রখর। তিনি যখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে শিক্ষকতা করতেন তখন সাহিত্য মজলিশ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন। সেখানে পদস্থ সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে অন্যান্য পেশার লোকজনও যুক্ত ছিলেন। এ সংগঠনের মাধ্যমে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবোধ তৈরি করতেন। পরে বাবার এক প্রাক্তন ছাত্র যিনি পরবর্তীকালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষক, তাঁর কাছে জানতে পারি পাবনাতেও আইউববিরোধী আন্দোলনের সাথে বাবা যুক্ত ছিলেন। সেখানে কারফিউ ভেঙ্গে তাঁরা আন্দোলন করেছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে তিনি অনেক কাজ করেছেন।

১৯৭২ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ওই বক্তৃতামালা পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয়। সেখান থেকে জানা যায়, বাবা নিজের টাকা ছাড়াও ওয়াকিল আহমেদসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যান্য অধ্যাপকের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি গোপন প্রচারপত্রে তিনি নিয়মিত লিখতেন। যুদ্ধের নয় মাসই বাবার উপর বারবার চাপ সৃষ্টি করা হয় পাকিস্তানীদের পক্ষে লেখার, রেডিওতে তাদের পক্ষে অনুষ্ঠান করার, নিন্দা বিবৃতিতে স্বাক্ষর প্রদানের। বাবা এর কোনোটাই করেননি। ২৫ মার্চ রাতে মরতে মরতেও বেঁচে যাই আমরা, তবু তিনি ঢাকা ছেড়েও যাননি। বাবার জন্ম মুর্শিদাবাদে, তিনি চাইলেই ইন্ডিয়া চলে যতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাঁর মতো করেই মুক্তিযুদ্ধ করে গেছেন।

এই যে, একজন মানুষের প্রত্যয়, লড়াই করে যাওয়ার মনোভাব; আমি মনে করি এর থেকেই জন্ম হয়েছে ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ উপন্যাসের। খুব অল্প সময়ে, আমরা যে সময়টা ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলাম সেই সময়ের মধ্যেই তিনি উপন্যাসটা লিখেছিলেন।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে আমাদের অর্জন অনেক, আশার জায়গাও অনেক। কিন্তু আমার একটা ব্যক্তিগত খেদ, আমরা বা আমাদের সমাজ যুদ্ধ শিশুদের জন্য কিছুই করেনি। তারা এদেশে বড় হতে পারেনি। অথচ তারা তো সবচেয়ে বেশি সম্মানের দাবীদার ছিলো কিন্তু সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হলো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাদেরকে আমরা যন্ত্রনা ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি।”

‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ উপন্যাস প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক

কথা বলি খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আনোয়ারা সৈয়দ হকের সঙ্গে। ১৯৭১ সালে তিনি ঢাকার অবরুদ্ধ অবস্থা দেখেছেন। আনোয়ার পাশার উপন্যাস সম্পর্কে বলতে গিয়ে সেই দীর্ঘ নয় মাসের কঠিন সময়ের কথা মনে করলেন । বললেন, “এই উপন্যাসটি আমি বহু আগেই পড়েছিলাম। এখন আবার পড়তে গিয়ে বইয়ের পাতায় পাতায় আমি পুরোনো স্মৃতিতে চলে গিয়েছি। ভীষণভাবে একাত্তরের সেই দিনগুলো নিজের অন্তরের ভিতর অনুভব করেছি এবং আমার চোখ সজল হয়ে উঠেছে। আনোয়ার পাশা নিজেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক।

তিনি সেই সময়ে প্রত্যক্ষ করেছেন ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও তার পালিত পুত্র, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, ড. মুকতাদির, ড. ফজলুর রহমান সহ আরো অনেক হত্যাকাণ্ডের বিভৎসতা। সেগুলো তিনি উপন্যাসের পাতায় তুলে এনেছেন। সে রাতের গণহত্যার পর রক্তের ধারা কীভাবে বয়ে যাচ্ছে সিঁড়ির উপর দিয়ে আনোয়ার পাশা তার বর্ণনা দিয়েছেন ।

এই বর্ণনা অত্যন্ত লোমহর্ষক এবং বেদনাদায়ক সমস্ত বাঙ্গালির জন্য। উপন্যাসে একটি রক্তাক্ত অধ্যায়ের বর্ণনা করা হয়েছে। সবচেয়ে করুণ বিষয় যেটি, সেটি উপন্যাসটির নাম। ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ এই নামের মূল প্রতিপাদ্য হলো পাকিস্তানী সেনাদের কাছে খাদ্য, রাইফেল এবং নারী এই তিনটিই ছিলো মৌলিক চাহিদা। উপন্যাসের শেষের দিকের ক’টি লাইনে আমরা দেখি,‘শুধু চাই মদ-মাগী ও হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা। সেজন্য পূর্ব-বাংলাকে শোষণ অব্যাহত রাখতে হবে। প্রীতি চাইলে শোষণ চলে না-এটুকু বুদ্ধি ওদের আছে।’ আমার মনে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যে প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ চোখে দেখেননি তাদের জন্য এই উপন্যাসটি পড়া অত্যন্ত জরুরি।

প্রশ্ন ও মতামত জানাতে পারেন আমাদের কে ইমেল : info@banglanewsexpress.com

আমরা আছি নিচের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুলোতে ও

Leave a Comment