চৈত সিং ও অযোধ্যার বেগমের সাথে দুর্ব্যবহারের জন্য কি ওয়ারেন হেস্টিংসকে ইম্পিচমেন্ট করা হয়েছিল? ব্যাখ্যা কর
ভুমিকা । ১৭৬৫ সালে লর্ড ক্লাইভ প্রবর্তিত দ্বৈতশাসনের প্রতিক্রিয়া ও ১৭৬৯-৭০ সালের দুর্ভিক্ষের তিয়ার ফলে বাংলার জনসাধারণের জীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। এ সময় কোম্পানির রাজকোষেরও ঘাটতি দেখা যায়। তাই কোড অব ডাইরেক্টরস ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসকে গভর্নর নিয়োগ করেন এবং রাজস্ব সমস্যা সমাধান করেন। মারেন হেস্টিংসে ক্ষমতা গ্রহণ করে পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে কোম্পানির শাসনের ভিত্তিকে মজবুত করার জন্য বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেন। আর এ কৌশল প্রয়োগ করতে গিয়ে তিনি অযোধ্যার বেগম ও বারানসীর রাজা চৈত সিংহের সাথে শোনযোগে জড়িয়ে যান। যার জন্য পরবর্তীতে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পর ইম্পিচমেন্ট-এর মুখোমুখি হতে হয় ।
হেস্টিংস-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ ঃ হেস্টিংসের বিরুদ্ধে যে কয়েকটি অন্যায় আচরণের কথা, প্রকাশিত হয়েছে তা হল । ১, বর্ধমানের রাণীর প্রতি আচরণ, ২. রাণী ভবানীর প্রতি আচরণ, ৩. নন্দকুমারের প্রতি আচরণ, ৪ চৈত সিংহের প্রতি আচরণ ও ৫. অযোধ্যার বেগমের প্রতি আচরণ। ইংল্যান্ডে হেস্টিংস ফিরে যাওয়ার পর দীর্ঘ সাত বছর পর্যন্ত উপরিউক্ত অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করা হয়। অন্যান্য অভিযোগ থেকে তিনি মুক্তি পেলেও বারানসীর রাজা চৈত সিংহ ও অযোধ্যার বেগমের অভিযোগ হতে মুক্তিপত্র পান নি। তাই শেষ পর্যন্ত তাকে ইম্পিচ করা হয়। নিম্নে বারানসীর চৈত সিংহ ও অযোধ্যার বেগমের প্রতি হেস্টিংসের আচরণের বিবরণ দেওয়া হল :
ক. চৈত সিংহের প্রতি আচরণ। চৈত সিংহের প্রতি হেস্টিংসের আচরণ নিম্নরূপ :
১. চৈত সিংহের কাছে অর্থ সাহায্য : ১৭৭৫ সালে অযোধ্যার নবাবের সাথে কোম্পানির চুক্তির শর্তানুসারে বারানসে কোম্পানির প্রাধান্য স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু এ চুক্তিতে বারানসের রাজার উপর কোম্পানির কেবলমাত্র বাৎসরিক কর ভিন্ন অপর কোন প্রকার দাবি থাকবে না- এ শর্তটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা ছিল। কিন্তু মারাঠা ও ফরাসিদের সাথে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অর্থের অনটন ঘটলে হেস্টিংস বারানসীর চৈত সিংহের কাছে অর্থ সাহায্য চান।
২. চৈত সিংহকে গ্রেপ্তার মারাঠা ও ফরাসিদের সাথে যুদ্ধের ব্যয়ভার পুষিয়ে নেওয়ার জন্য হেস্টিংস চৈত সিংহের কাছে ৯ লক্ষ টাকা দাবি করেন। প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে একবারের জন্য অর্থ সাহায্য দেওয়ার শর্তে রাজি হন। কিন্তু ১৭৭৯ সালে আবার তিনি চৈত সিংহের কাছে অর্থ সাহায্য দাবি করেন। রাজা অর্থ দানে অক্ষমতা জানালে হেস্টিংস তার রাজ্যে সৈন্য প্রেরণ করে মোট দাবির উপর আরও ২০০০ পাউন্ড জরিমানা হিসেবে আদায় করলেন এবং চৈত সিংহকে বন্দি করেন।
৩. চৈত সিংহের পদচ্যুতি । ১৭৮০ সালে হেস্টিংস পুনরায় চৈত সিংহের কাছে অর্থ দাবি করেন। চৈত সিংহ দুই লক্ষ টাকা উপহার হিসেবে প্রেরণ করে তার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু হেস্টিংস দুই লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেও তাকে নিষ্কৃতি দিলেন না, চৈত সিংহের কাছে বাৎসরিক কর ভিন্ন আরও পাঁচ লক্ষ টাকা দাবি করেন। চৈত সিংহের আপত্তিতে তা কিছু কমানো হল। কোম্পানির ব্যবহারের জন্য দুই হাজার অশ্বারোহী সৈন্য দিতে বলা হলে চৈত সিংহ পাঁচশত অশ্বারোহী ও পাঁচশত পদাতিক সৈন্য সংগ্রহ করে হেস্টিংসকে জানালেন কিন্তু কোন সাড়া পেলেন না। হেস্টিংস চৈত সিংহের অশ্বারোহী সৈন্য যোগাড় বিলম্বের কারণে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা জরিমানা করার মনস্থ করেন। শেষ পর্যন্ত কাউন্সিলের অনুমতিক্রমে হেস্টিংস স্বয়ং উপস্থিত হয়ে কৈফিয়ত দাবি করেন। ফলে উপযুক্ত ভাতার বিনিময়ে বারানসের জমিদারি ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। এভাবে রাজাকে অপমান করা হয়।
খ. হেস্টিংসের প্রতিহিংসাপরায়ণতা : চৈত সিংহ জমিদার হলেও তার কতকগুলো বিশেষ অধিকার ছিল। কোম্পানির সাথে কর দান ছাড়া তার কোন প্রকার সম্পর্ক থাকবে না, এই শর্ত ১৭৭৫ সালের চুক্তিতে বলা ছিল। আর এ শর্তের কথা বাদ দিলেও অপরাপর জমিদারদের কাছ থেকে যখন কোন প্রকার অর্থ বা সামরিক সাহায্য দাবি করা হয় নি। কিন্তু চৈত সিংহের কাছে পুনঃ পুনঃ অর্থ সাহায্য দাবি তার প্রতিহিংসাত্মক মনোভাবের পরিচায়ক হেস্টিংস-এর কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল যখন প্রকৃত শাসন ক্ষমতা হস্তগত করেছিল তখন চৈত সিংহ তাদের কাছে একবার উপহার প্রেরণ করেছিলেন। সেই সময় থেকে হেস্টিংস চৈত সিংহের প্রতি অন্যায় আচরণ শুরু করেন। সুতরাং ব্যক্তিগত আক্রোশ বশে হেস্টিংস এ ধরনের আচরণ করেছিলেন বলা যায়। গ. অযোধ্যার বেগমদের প্রতি আচরণ : অযোধ্যার বেগমদের প্রতি হেস্টিংসের আচরণ নিম্নরূপ :
১. বেগমের পরিচয় ঃ সুজা-উদ-দৌলার স্ত্রী এবং মাতা অযোধ্যার বেগম নামে অভিহিত। সুজা-উদ-দৌলার মুর পর উভয় বেগম তাদের নিজের ব্যয় সংকুলানের জন্য জায়গীর ভোগ করতেছিলেন, এটা ছিল সে সময়কার রীতি।
২. আসফ-উদ-দৌলাকে উৎসাহ দান । অযোধ্যার বেগমদের নিজস্ব প্রচুর পরিমাণ মণিমুক্তা ও অর্থ পতি ি আসফ-উদ-দৌলা যখন ক্রমেই কোম্পানির পাওনা মিটাতে পারলেন না তখন তিনি হেস্টিংসের পরামর্শে নিজ মাতা পিতামহীর অর্থের দিকে দৃষ্টি দিলেন। হেস্টিংস এ বিষয়ে আসফ-উদ-দৌলাকে সাহায্য করলেন।
৩. বেগমদের উপর অত্যাচার : আসফ-উদ-দৌলার অর্থাভাব দূর করার জন্য বেগম অর্থাৎ তার মাতা তাকে fee লক্ষ টাকা দিয়ে কোম্পানির কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করলেন যে, ভবিষ্যতে কোম্পানি অথবা আসফ-উদ-ে অর্থের জন্য বিরক্ত করবে না। ১৭৮১ সালে বেগমরা চৈত সিংহকে কোম্পানির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সময় সমর্থন করেছিলেন এজন্য কোম্পানি বেগমদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়। তার পর অযোধ্যার ব্রিটিশ প্রেসিডে মিডলটনের স্কুলে অধিকতর অত্যাচারী ব্রিটিশ কর্মচারী ব্রিস্টোকে নিযুক্ত করা হল। বেগমদের দেওয়ান ও খোজাদের দি করে রেখে নানাভাবে নির্যাতন করা হল। হেস্টিংস আসফ-উদ-দৌলার মতের বিরুদ্ধে একদল সৈন্য প্রেরণ করে বোরে ভীতি প্রদর্শন করলেন। বেগমদের যাবতীয় ধনরত্ন জোরপূর্বক আদায় করা হল। এভাবে অর্থের জন্য নিরীহ বৃদ্ধা গেমসের উপর অত্যাচার হেস্টিংসের হিংসাত্মক মনোভাবের পরিচায়ক।
৪. হেস্টিংসের ইম্পিচমেন্ট : হেস্টিংসের রাজত্বকালের শেষদিকে ইংল্যান্ডে তার বিরুদ্ধে নানা অভি উত্থাপিত হতে লাগল। ১৭৮২ সালে ডান্ডাস, স্যার ইলিজা ইম্পে, ওয়ারেন হেস্টিংস, লরেন্স সুলিভান কর্মচারীগণকে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। শেষে ইলিজা ইম্পোকে ফিরে যেতে হয়। এরপর পিট প্রধানমন্ত্রী হন। পিট হেস্টিংসের কার্যকলাপকে সমর্থন করতেন না। এভাবে হেস্টিংসের বিরুদ্ধে বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পেলে তিনি স্বদেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন। পরবর্তী তিন বছর পিট ও ডান্ডাসের চেষ্টায় হেস্টিংসকে ইি করা হল। ১৭৮৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭৯৫ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত দীর্ঘ সাত বছর ধরে পর্ড কর্তৃক কমপসভায় হেস্টিংসের বিচার চলল। এ অভিযোগের মধ্যে সবগুলো কিছুটা কেটে গেলেও চৈত সিংহ ও অযোধ্যার বেগমদের অভিযোগের তিনি অভিযুক্ত হলেন। এক পর্যায়ে হেস্টিংসকে ‘মানবতার শত্রু’ বলে অভিহিত করা হল। দীর্ঘ সাত বছর ধরে বিচারের পর হেস্টিংস অভিযোগ হতে মুক্তি পেলেন। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যয় সংকুলান করতে গিয়ে তিনি সর্বস্বান্ত হলেন। তাই দুঃখ করে হেস্টিংস বলেন, “I gave you all and you have rewarded me with confication disgrace and a life of impeachment.”
৫. হেস্টিংসের ইম্পিচমেন্টের সমালোচনা : ইংরেজদের স্বার্থের দিক দিয়ে বিচার করলে হেস্টিংসের ইম্পিচমেন্ট ব্রিটিশ জাতির অকৃতজ্ঞতার নিদর্শন ছাড়া কিছুই ছিল না। বাংলায় ইংরেজ শাসন যখন ধ্বংসের দিকে তখন অর্থাভাব দে ভারতে ইংরেজ কোম্পানির শাসনে দৃঢ়তা ও স্বচ্ছতা আনয়ন করেন। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্থপতি ছিলেন হেস্টি এতে কোন দ্বিমতের অবকাশ নেই। ভাই তাকে ইম্পিচ করা ইংরেজ জাতির অকৃতজ্ঞতার পরিচায়ক বটে। কিন্তু মানবতা ও শাসনকার্যে সততার দিক থেকে বিচার করলে তাকে ইম্পিচ করে ইংরেজ জাতির নেতৃবৃন্দ তাদের মানসিক উৎকর্ষের পরিচয় দান করেছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাকে ইম্পিচ করে ভারতে ব্রিটিশ শাসনে ন্যায় ও সত্যতার সূচনা করা হয়েছিল। শাসনকার্যে দায়িত্ব জ্ঞান বৃদ্ধি, শাসিতের প্রতি সম্মানজনক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাবোধ ওয়ারেন হেস্টিংসের ইম্পিচমেন্টের ফলে বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা ছিল ব্রিটিশ শাসনের জন্য মঙ্গলজনক।
উপসংহার : অতএব বলা যায় যে, হেস্টিংস-ক্লাইভ প্রবর্তিত দ্বৈতশাসনের কুফলের জন্য দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে বাঙালি যখন বিপর্যস্ত তখন তিনি যোগ্যতা ও দক্ষতার মাধ্যমে এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনেন। তাই সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনা ও কোম্পানির স্বার্থকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য তাকে অনেক অন্যায়মূলক কাজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও করতে হয়। আর এ সকল কাজ করে যদিও কোম্পানির সার্বিক উন্নতি হয়েছিল বলা যায় কিন্তু ব্রিটিশ সরকার শেষে এগুলো বিবেচনায় আনেন নি। আর বিবেচনায় না আনার জন্য ব্রিটিশ শাসনের স্থপতি বলে খ্যাত হেস্টিংসকে ইম্পিচমেন্টের মুখোমুখি হতে হয়। এটাই ইতিহাসের চরম সত্য যে, অন্ধ স্বার্থের দিকে লক্ষ রাখলে পরে নিজের জীবনে নেমে আসে মিথ্যার গ্লানি। যার জন্য গৌরবময় কার্যকলাপ চাপা পড়ে যায়, যা হেস্টিংসের ক্ষেত্রে হয়েছিল।