পঞ্চশালা বন্দোবস্ত কি? পঞ্চশালা বন্দোবস্ত কেন প্রবর্তন করা হয়েছিল? পঞ্চশালা বন্দোবস্ত ফলাফল কি

পঞ্চশালা বন্দোবস্ত কি? পঞ্চশালা বন্দোবস্ত কেন প্রবর্তন করা হয়েছিল? পঞ্চশালা বন্দোবস্ত ফলাফল কি


১৭৫৭ সালে পলাশীর অন্যায়মূলক যুদ্ধের মাধ্যমে কোম্পানি বাংলার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা পান। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ প্রত্যক্ষ শক্তির পরিচয় দিয়ে কোম্পানি নিজেদের সালে কোম্পানি কর্তৃক দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। দ্বৈত শাসনব্যব নেমে আসে চরম দুর্ভোগ।

তাই এ ব্যাপারে ডাইরেক্টর সভার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হেস্টিংসকে বাংলার দায়িত্ব দিয়ে পাঠান এবং হেস্টিংসকে রাজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য পরামর্শ করে পরীক্ষামূলক রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন যা পঞ্চসালা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। পালা বন্দোবস্ত : ওয়ারেন হেস্টিংস ক্ষমতা গ্রহণ করে কোম্পানির পূর্বের যে রাজার ব্যবস্থা তা বাতিল দিয়ে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি কোম্পানির কর্মচারীর উপর না করেন। এজন্য পূর্বের সেরা নিয়োজিত নায়েব-নাজিম ছিল তাদের বরখাস্ত করেন এবং পূর্বের যে পর্যবেক্ষক হিসেবে একজন ছিলেন তার নাম করে কালেক্টর করেন। এ কালেক্টরগণ জমিদারদের কাছে গিয়ে সরাসরি কথা বলে পাঁচ বৎসর মেয়াদি চুক্তি এটাই হল পঞ্চসালা বন্দোবস্ত। এটা ছিল পরীক্ষামূলক। তবে পঞ্চসালা বন্দোবস্তের অনেক কারণ ছিল। নিম্নে এ দেশের প্রবর্তনের কারণগুলো আলোচনা করা হল :


১. রাজস্ব রহস্য উদঘাটন রাজস্ব শাসনের জন্য প্রয়োজন রাজস্ব বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। এদেশের ভূমি রাজ ব্যবস্থা এমন জটিল যে, প্রত্যেক জেলা, পরগনা, এমনকি গ্রামের জন্য ভিন্ন ধরনের নিয়ম, আচার-প্রথা, বেওয়া বিদ্যমান। রাজস্ব শব্দ, ভূমির মাপ, হিসাব পদ্ধতি, খাজনার হার প্রভৃতির জন্য কোন পদ্ধতি পরগনার নিয়ম অন্য পরগনায় ছিল অচল। এসব বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার। এদেশে রাজস্ব এ বংশানুক্রমিক ব্যাপার ছিল। তাই রাজস্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভের জন্য এ ব্যবস্থার দরকার ছিল।


২. দেশী সরকারের স্বৈরাচারী কার্যকলাপের অবসান । দেশী সরকার ছিল স্বৈরাচারী। স্বৈরাচারী ক্ষমতা প্রয়োগ করে নবাব জমিদারদের বাধ্য করত তাদের ভরণপোষণ খরচ ছাড়া বাকি সব আদায়কৃত রাজস্ব নবাবকে দিয়ে দিতে। নবাব যে স্বৈরাচারী উৎপীড়ন চালাত জমিদারদের উপর জমিদার আবার সেই একই কায়দায় সর্বস্ব আদায় করে নিত এদের অধীনের ইজারাদার রায়তের কাছ থেকে। নবাব ও জমিদারের মধ্যবর্তী মুৎসুদ্দিরাও লুটের উপর বখরা বসাতো। জমিদারি আমলা, নায়েব, গোমস্তারাও চালাতো একই রকম অত্যাচার। নবাব থেকে নগণ্য রায়ত পর্যন্ত ছিল অত্যাচা উপর অত্যাচারী। নবাব আদায় করেছে মহামুৎসুদ্দি ও জমিদারদের কাছ থেকে; মহামুৎসুদ্দি ও জমিদারেরা আদায় করেছে মাঝারি ও ছোট তালুকদার, ইজারাদারদের কাছ থেকে; তালুকদার ইজারাদার, নায়েব, গোমস্তারা শোষণ করে গ্রামীণ প্রধানদের এবং গ্রামীণ প্রধান সবশেষ থাবা বসায় সাধারণ রায়তের উপর। তাই এ অত্যাচারী স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের জন্য পঞ্চসালা বন্দোবস্তের প্রয়োজন ছিল।


৩. কোম্পানির স্বার্থ হাসিল কৌশল : কোম্পানি শাসক নয়, একটি বাণিজ্যিক সংস্থা। লাভজনকভাবে শেয়ার হোল্ডারদের পুঁজি বিনিয়োগই হল এর কাজ। রাজস্ব সংগ্রহের ঝামেলায় নিপতিত হওয়া বাণিজ্যিক স্বার্থ গর্হিত কাজ। বছর বছর ভূমি বন্দোবস্ত করা, রাজস্ব আদায়, বাকির হিসাব রাখা, দুর্বোধ্য আঞ্চলিক প্রথা প্রতিষ্ঠান, ওজন মাপ হিসাব রক্ষা করা কোম্পানির পক্ষে অসম্ভব নয় অনভিপ্রেতও বটে। কোম্পানির স্বার্থে রাজস্ব ব্যবস্থাকে যথাসম্ভব সরল সোজা রাখা বাঞ্ছনীয়।
৪. দীর্ঘ মেয়াদি ইজারাদারি ব্যবস্থার সুফল : ‘হেস্টিংস যুক্তি দেখান যে, ইজারাদারি ব্যবস্থা অবলম্বন করলে তা বার্ষিক না হয়ে দীর্ঘ মেয়াদি হওয়া সুবিধাজনক। ন্যূনতম পাঁচ বৎসরের কম মেয়াদি জমি ইজারা দিলে তা একদিকে যেমন সরকারের ঝামেলা বাড়ায়, অন্যদিকে কৃষির জন্যও তা অতি ক্ষতিকর। তাই এ ধরনের মানসিকতা থেকে পঞ্চসনা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয়। পঞ্চসনা বন্দোবস্তের নীতিমালা :

নিম্নে পঞ্চলনা বন্দোবস্তের নীতিমালা সম্পর্কে আলোচনা করা হল :


১. কমিটির পথ নির্দেশ সংক্রান্ত নীতিমালা ও উল্লিখিত যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ফোর্ট উইলিয়ামের প্রেসিডেন্ট এ্যাড কাউন্সিল পাঁচ বছর মেয়াদি ইজারাদারি বন্দোবস্তের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ১৪ মে (১৭৭২) এবং বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটির পথ নির্দেশ সংক্রান্ত কতকগুলো নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়। নীতিমালাগুলো হল :
বন্দোবস্তের মেয়াদ পাঁচ বছর, ১৯ এপ্রিল ১৭৭২ থেকে ১০ এপ্রিল ১৭৭৭ সাল পর্যন্ত। ইজারা জমি গঠিত হবে পুরো পরগনা নিয়ে এবং এর সরকারি জনা হবে এক লাখ টাকা।
ইজারাদারের সাথে শর্তাদি সম্বলিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। ইজারাদারও অনুরূপভাবে শর্তাদি উর করে রাতকে পাঠা দেবে। পাঠায় দখলিকৃত জমির পরিমাণ ও খাজনার উল্লিখিত হার থাকবে।
iv. পাটায় অনুল্লিখিত সমস্ত আবওয়াব বা বিবিধ কর আদায় অবৈধ হবে।
v. নজর, সেলামি প্রভৃতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে।
i. জেলা কালেক্টর উক্ত সব নীতিমালা সর্বত্র ঘোষণা করবেন এবং ইজারা গ্রহণে আগ্রহী প্রার্থীদের থেকে নিলাম ডাক আহ্বান করবেন।
vii. কালেক্টর একটি পরগনাওয়ারী হস্তবুদ তৈরি রাখবেন। ঐ হস্তদের নিরিখে কমিটি নিলাম পরিচালনা ধরবে।

জমিদার তালুকদারদের প্রতি গৃহীত নীতি : পঞ্চানা বন্দোবস্তের মূল লক্ষ্য ছিল প্রকৃত উৎপাদনের নিরিनে সরকার হাজার স্থির করা। এতে বলা হয় যে, জমিদারদের সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট এন্ড কাউন্সিল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জমিদারদের প্রস্তাব সর্বোচ্চ হলে বা ইজারাদারদের প্রস্তাবের সমান হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জমিদারদের সাথে বন্দোবস্ত করা হবে। জমিদারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার যুক্তি হিসেবে বলা হয় যে, বংশানুক্রমিক শাসক হিসেবে অমিদাররা তাদের প্রজাদের চাষাবাদে উৎসাহ যোগাবে এবং রাজস্ব শোধে তারা হবে ইজারাদারের চেয়ে বেশি নির্ভরশীল ও অব্যর্থ। কেননা, জমিদার স্থাত্রী আর ইজারাদার অস্থায়ী। পঞ্চসনা বন্দোবস্ত করা হয় পরগনা ভিত্তিক। এজন্য অনেক অসুবিধা হয়েছিল। এতে শেষে বলা হয় যে, ছোট ছোট জমিদাররা পঞ্চসনা বন্দোবস্তকালে ইজারাদার বলে গণ্য হবে এবং অন্যান্য ইজারাদারদের বেলায় যেসব নিয়মকানুন আছে তাদের বেলায়ও সেসব নিয়মকানুন প্রযোজ্য হবে এবং তাদের এস্টেটের সঠিক সম্পদ নিরূপণের জন্য সরকারি তদন্তে তাদের সহযোগিতা করতে হবে।


জমিদারদের প্রতিক্রিয়া : পূর্বে জমিদারগণ রাজস্ব সংগ্রহ ছাড়াও তাদের ছিল বিচারের, পুলিশের এমনকি সামরিক দায়িত্ব। কিন্তু এ ব্যবস্থায় করা হয় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ১৭৭২ সালের পঞ্চসনা বন্দোবস্তের মাধ্যমে যখন আবহমানকালের জমিদারি সুযোগ সুবিধা কলমের এক খোঁচায় নস্যাৎ করে দেয় তখন স্বাভাবিক কারণে জমিদার মহ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সাধারণ ফটকাবাজদের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে তারা ভূমি নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে কর্ম ভাতা ভোগীতে পরিণত হওয়া তারা সহজভাবে মেনে নিতে পারেন নি। সমাজের চোখে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার চেয়ে অসম্ভব শর্তে বন্দোবস্ত গ্রহণ করে অনেকে নিশ্চিত ধ্বংসের মুখোমুখি হওয়াকে শ্রেয় মনে করেন। পঞ্চসনা বন্দোবস্তের ফলাফল ঃ ১৭৭৪ সাথে ২৪ মার্চ এক পত্রে কোর্ট অব ডাইরেক্টরস পঞ্চানা বন্দোবস্ত পরিকল্পনা অনুমোদন করে। এতে বলা হয় যে, কোন কারণে কোন ইজারাদার সরে দাঁড়ালে বা চুক্তিভঙ্গ করলে সৃষ্ট শূন্যতা নিলামের মাধ্যমেই বন্দোবস্ত করা উচিত হবে এবং কোন অবস্থাতেই সরেজমিনে তদন্ত ছাড়া বিশেষ ইজারাদারের রাজস্ব হ্রাস বা মওকুফ করা যাবে না। এ বন্দোবস্ত প্রকাশিত হওয়ার পর কলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম সরকার ও কোর্ট অব ডাইরেক্টরস প্রতীক্ষায় ছিলেন সুফলের। কিন্তু বন্দোবস্তের পর একবছর অতিক্রম হতে না হতেই সরকার মহা দুঃসংবাদ পেতে থাকে যা পঞ্চসনা বন্দোবস্তের কুফল। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হল ঃ ১. রাজস্ব আদায়ের অনিশ্চয়তা : রাজস্ব সংগ্রহে প্রাদেশিক কাউন্সিলগুলো কেন্দ্রীয় সরকারকে অবহিত করে যে, অধিকাংশ ইজারাদারই বন্দোবস্তের শর্ত মোতাবেক রাজস্ব কিস্তি শোধে ব্যর্থ হচ্ছে এবং রাজস্ব দাবি হ্রাস না করলে চুক্তি পালনে তারা অক্ষম বলে আর্জি জানায়। প্রথম প্রথম এদের আর্জিকে সরকার মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেন এবং বকেয়া রাজস্ব সংগ্রহের জন্য কঠোর নির্দেশ দেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও দেখা যায় যে, প্রতি বছর যথেষ্ট পরিমাণ রাজস্ব বাকি পড়ে। বকেয়া রাজস্বের বিরাট অংশ প্রতি বছর মওকুফ করতে হয়। পঞ্চসনা সময়ের ১৭৭২-১৭৭৭ সরকারি জমা, উত্তল এবং বাকির একটি পরিসংখ্যান দেখানো হল : পঞ্চসনা বন্দোবস্তের জমা, উত্তল, বাকি ও মওকুফ হিসাব : ১৭৭২/- 1995/9 D বৎসর জমা টাকা উল টাকা বাকি টাকা 3993/0 २৮,৫,৬२२ ২৭,০৩৫,৬৮১ ১,৫২৯, ৯৪১ 3990/8 28,800,008 ২৭,১৮০, ২७० 1998/0 ২৯, ২৭৮,৬৪২ ২৭,৮৭৯,৪৫৯ ১,৩৯৯,১৮৩ 3998/6 ২৮, ৮৯৫, ২৯৮ ২৩,৩১০, ২१২ ১,৫৭৫,৯৮৬ 3998/9 ২৮,৭৩১, ৩৩০ ২৬,৪২০, ১৪৩ ২,৩১১,১৮৪ মওকুফ টাকা ৬৬৩,৫০৯ ৬৪২,৮৩৬ 688,608 ৫৮৫,৯০৬ অর্থাৎ, এ পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, রাজস্ব কতটুকু ঘাটতি পড়েছিল।

Leave a Comment