বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি কী, অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের পরিণতি ও ব্যর্থতার কারণ
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রশ্নে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলির বক্তব্যর পরপরই তৎকালীন পশিমবঙ্গের নেতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা বাংলার হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পশ্চিম বাংলা প্রদেশ গঠনের দাবি জানায় এবং ভারতের স্বাধীনতার পর পশ্চিম বাংলা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবার দাবি জানায়। তাদের এই দাবির পক্ষে কলকাতার হিন্দুত্ববাদী পত্রিকা ও বাঙ্গালি অবাঙালী ধনিক গোষ্ঠী এগিয়ে আসে। এমনকি যে কংগ্রেস এতদিন অখণ্ড ভারতের দাবিতে অটল ছিল তারাও ধর্মের ভিত্তিতে বাংলার বিভক্তি মেনে নিয়ে তাদের ওয়ারকিং কমিটির সুপারিশে তা অন্তর্ভুক্ত করে।
অন্যদিকে ধর্মের ভিত্তিতে বাংলার বিভক্তি মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রতিফলন হওয়ায় তারাও এ দাবি মেনে নেয়। তবে বাংলার ভাগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বাংলার বেশ কিছু মুসলিম ও প্রগতিশীল নেতা। এদের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম অন্যতম। আবুল হাশিম বাংলাকে অখণ্ডিত রাখার প্রস্তাবে ৪৭ এর জানুয়ারিতে শরৎ বসুর সাথে সর্বপ্রথম বৈঠক করেন।
এরপর এপ্রিলে আনুষ্ঠানিকভাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবের দাবি জানায়। এপ্রিলে আনুষ্ঠানিক দাবির পর মে মাসে কলকাতায় শরৎ বসুর বাসভবনে বাংলার মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের নেতারা বৈঠক করে। পশ্চিমবঙ্গের শরৎ বসুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস নেতারা এই দাবির পক্ষে সমর্থন জানায়। কিন্তু মুসলিম লীগ বাংলার খাজা নাজিমুদ্দিন গ্রুপের সদস্যরা এই দাবির বিরোধিতা করে এবং এই আলোচনা থেকে বিরত থাকে। মে মাসেই বাংলার কংগ্রেস সভাপতি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসুর অখণ্ড বাংলার দাবিতে একমত হন।
অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাব ব্যর্থ হয় কেন?
মুসলিম লীগের পক্ষে আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের পক্ষে শরৎ বসু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলার অখণ্ডতা রক্ষার চুক্তি করে যা ‘বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি’ নামে পরিচিত। এই চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল যেকোনো উপায়েই বাংলার অখণ্ডতা রক্ষা করা। এই চুক্তিতে বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিম ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস লীগ নেতা কিরণ শংকর রায়ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
বাংলার অখণ্ডতা বজায় রেখে যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা
বর্তমানে বাংলা দুই ভাগে বিভক্ত। একটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আরেকটি বর্তমান বাংলাদেশ। তবে এই দুই বাংলার মানুষ ৪৭ সালে এতটাই বিভাজিত ছিল না যে একই বাংলাকে দুই ভাগে দুই দেশের মধ্যে ভাগ করে দেয়া যায়। এটা ছিল মূলত প্রধান দুই রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যকার রাজনৈতিক বোঝাপড়া। ৪৬ এর দাঙ্গার ফলে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল এটা সত্য।
অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি কী
তাই বলে বাংলা বিভক্তি কখনোই সমাধান ছিল না। কেননা এপার বাংলা ও ওপার বাংলার মানুষের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। দুই অঞ্চলের মানুষেরই মুখের ভাষাও ছিল এক। তাদের মধ্যেকার ধর্ম বাদে সংস্কৃতিগত মিলও রয়েছে প্রচুর। কলকাতা ইংরেজ আমলের রাজধানী হওয়ায় এপার বাংলার মানুষের ওপার বাংলায় যাতায়াত ছিল প্রচুর।
একইসাথে এপার বাংলায় যেমন ছিল বহু হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মানুষ, তেমনি ওপার বাংলার ছিল বহু মুসলমান ধর্মাবলম্বীর মানুষ। শুধু ধর্মের বাহানা দিয়ে বাংলাকে খণ্ডিত করার পরিকল্পনা ছিল বেমানান। তাই মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতাদের দলাদলি ও বোঝাপড়ার বাইরে এসে বাংলার স্থানীয় নেতাদের বাংলাকে অখণ্ডিত রাখার দাবি ছিল অনেকটাই যুক্তিযুক্ত।
ঐতিহাসিক কারণে অখণ্ড বাংলার যৌক্তিকতা
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলা ঐতিহাসিকভাবেই বহুকাল ধরে একটি আলাদা সত্তা হিসেবে টিকে আসছিল। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের থেকে তারা পৃথক এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হিসেবে প্রকাশ করেছে। এমনকি দীর্ঘ পাঁচশত বছরের পাল আমলেও বাংলা ছিল স্বাধীন সার্বভৌম এক অঞ্চল।
১৩৪২ থেকে ১৫৪৮ সাল পর্যন্তও ভারতবর্ষে বাংলা ছিল স্বাধীন এক সত্তা। এছাড়াও পরবর্তীতে মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে জাতীয়তার প্রশ্নে বাংলার হিন্দু মুসলমানের জাতীয় ঐক্যও প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ অর্থাৎ বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করাকেও অনেক বাঙ্গালি মন থেকে মেনে নিতে পারে নি। এমনকি হিন্দুদের এক বিরাট অংশ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে। যদিও এতে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিল। তবুও ঐতিহাসিকভাবে বাংলা ছিল এক সত্তা, তাই বাংলাকে অখণ্ডিত রেখে যুক্তবাংলা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ছিল যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত।
বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তির প্রতিক্রিয়া বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি কী
কংগ্রেসের মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সরদার বল্লবভাই প্যাটেল সহ কেন্দ্রীয় প্রায় সকল নেতাই বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তির বিরোধিতা করেছিল। এমনকি আবুল হাশিম, শরৎ বসু, সোহরাওয়ার্দী যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর কাছে গেলেও গান্ধী প্রস্তাবটি এড়িয়ে যান এবং পরবর্তীতে শরৎ বসুকে চিঠি লিখে যুক্ত বাংলার প্রস্তাব থেকে বিরত থাকতে বলেন। কেননা রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক উভয় কারণেই ভারতের পূর্বাঞ্চলে আলাদা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হোক সেটা তারা চান নি।
অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠন উদ্যোগের ব্যর্থতার কারণ
একইসাথে ব্রিটিশ আমলে কলকাতা ছিল ভারতবর্ষের রাজধানী। তাই অখণ্ড স্বাধীন বাংলা হলে ভারত কলকাতার মত গুরুত্বপূর্ণ নগরী হারাবে। অন্যদিকে আসাম যদি ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবে এর সাথে রেলপথে মূল ভূখণ্ডে যোগাযোগের কোনো ব্যাবস্থা থাকবে না এবং ভারতীয় ইউনিয়ন আসামের বিপুল পরিমান পেট্রোল ও খনিজ সম্পদ হারাবে। এমনকি কংগ্রেসের হাই কমান্ড এও ধারনা করেছিল যে, বাংলাকে বিভক্তি করলে পূর্ব বাংলা খুব বেশিদিন ভু-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে একা টিকে থাকতে পারবে না। তাই সুদূর ভবিষ্যতে পূর্ব বাংলা ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত হতেই বাধ্য হবে।
মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়া বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি কী
দ্বি-জাতি তত্ত্বের পরিপন্থী হওয়ায় মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ স্বাধীন যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তবে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে অখণ্ড বাংলা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তৎকালীন বঙ্গীয় মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা আকরাম খাঁ প্রথমে অখণ্ড বাংলার পক্ষে থাকলেও বসু-সোহরাওয়ার্দীর যুক্ত স্বাধীন বাংলার প্রতিষ্ঠার চুক্তির পর সে এর বিরোধিতা করতে থাকে। অন্যদিকে খাজা নাজিমুদ্দিন অখণ্ড বাংলাকে পাকিস্তানের অংশে যুক্ত করার দাবি জানায় এবং যুক্ত স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।
দ্বি-জাতি তত্ত্বের পরিপন্থী হওয়ায় মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ স্বাধীন যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তবে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে অখণ্ড বাংলা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তৎকালীন বঙ্গীয় মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা আকরাম খাঁ প্রথমে অখণ্ড বাংলার পক্ষে থাকলেও বসু-সোহরাওয়ার্দীর যুক্ত স্বাধীন বাংলার প্রতিষ্ঠার চুক্তির পর সে এর বিরোধিতা করতে থাকে। অন্যদিকে খাজা নাজিমুদ্দিন অখণ্ড বাংলাকে পাকিস্তানের অংশে যুক্ত করার দাবি জানায় এবং যুক্ত স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।
অখন্ড বাংলা আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল? বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি কী
যুক্ত স্বাধীন বাংলা গঠনে যে মানুষটা প্রথম থেকে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন তিনি হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সময় স্বল্পতা, সাংগঠনিক দুর্বলতা, দূরদর্শিতার অভাব, মুসলিম লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্ব, হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বসহ শত বাধা বিপত্তি অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকেও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চেষ্টা করেছিল ভারত পাকিস্তান বৃত্তের বাইরে যেয়ে তৃতীয় শক্তি হিসেবে বাঙ্গালীদের ঐক্যবদ্ধভাবে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে।
কিন্তু পারস্পরিক সহযোগিতার অভাব ও বহু রাজনৈতিক নেতার ব্যাক্তি স্বার্থ হাসিলের কারণে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের প্রস্তাব ভেস্তে যায়। তবে ভারত পাকিস্তান বিভক্তের আগ দিন পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী তার চেষ্টা চালিয়ে যান। হয়তো জটিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় সমীকরণের কারণে অখণ্ড বাংলাকে স্বাধীন করা যায় নি, কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার এই যুক্তিযুক্ত, যুগপোযুগী ও দুঃসাহসিক পদক্ষেপের কারণে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এপার ও ওপার বাংলার মানুষের মনে!