বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান আলোচনা কর
ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ, গভীর ও ঘনিষ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন ও সার্বিক সহযোগিতায় বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় প্রতিবেশী দেশ ভারত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারত মানবিক, সামরিক, আর্থিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক সমর্থন দান করেছিল যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান আলোচনা কর।
অথবা, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা বর্ণনা কর।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারত নির্বাচনে বিজয়ী বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন করে এবং হত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জনতাকে সামগ্রিক সহযোগিতা করতে তৎপর হয়। নিচে ভারতের অবদান উল্লেখ করা হলো :
১. যুব শিবির গঠন : ভারত তার সীমান্তবর্তী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচন করে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া ও যুদ্ধে পারদর্শী করতে অসংখ্য যুব শিবির গড়ে তোলে। যুব শিবির গঠনে ভারত সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করে।
২. প্রশিক্ষণ প্রদান : মুক্তিযুদ্ধে ভারত মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করে। সেক্টর কমান্ডারদের অধীনে নিয়মিত বাহিনীকে ট্রেনিং করানো, তরুণ সম্প্রদায়কে রিক্রুট করা ও প্রশিক্ষণ দান, বিভিন্ন গেরিলা সংগঠনকে প্রশিক্ষণ দান, বিভিন্ন গেরিলা সংগঠনকে প্রশিক্ষণ দান ইত্যাদির মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ।
৩. মুজিব বাহিনী গঠন : মুক্তিযুদ্ধে ভারত মুজিব বাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য সহযোগিতা করে। মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে নেতৃত্ব যেন কমিউনিস্ট বা চরমপন্থিদের হাতে চলে না যায় সে জন্য বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শে সজ্জিত একদল তরুণ ও যুবকদের নিয়ে মুজিব বাহিনী গঠন করে। শেখ ফজলুল হক মনির নিয়ন্ত্রণাধীনে গঠিত হয় মুজিব বাহিনী, এ বাহিনী গঠনে প্রশিক্ষণ প্রদান করে ভারত।
আরো ও সাজেশন:-
৪. বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন : মুক্তিযুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভের জন্য এবং দ্রুত বিজয় অর্জনের জন্য মে মাসে কলকাতায় ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়।
৫. সীমান্ত উন্মুক্ত : আতঙ্কগ্রস্ত বাঙালি শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভারত তার সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়। ফলে এ সকল মানুষ নিরাপদ আশ্রয় লাভ করে।
৬. শরণার্থীদের আশ্রয় দান : শরণার্থীদের আশ্রয় দান মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সহযোগিতার আর এক অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিদিন ২০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার অসহায় নিরস্ত্র বাঙালি ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। ভারতে এ সময় প্রায় ১ কোটি লোক শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং তাদের আশ্রয়, খাদ্য, নিরাপত্তা, চিকিৎসা, গৃহনির্মাণ প্রভৃতির জন্য ভারত সরকারের ব্যাপক প্রস্তুতি ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল।
৭. অস্ত্র প্রদান : মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবরাহ করত। পাকবাহিনীর মোকাবিলা করতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র আমদানি এবং তা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সরবরাহ করে ভারত মুক্তিবাহিনীকে শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলে।
[ বি:দ্র: নমুনা উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)]
৮. প্রবাসী সরকারকে সহায়তা করা : মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে মুজিবনগর সরকার ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। মুজিবনগর সরকার ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করে। শপথ গ্রহণের ২ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী মুজিবনগরে বোমা বর্ষণ করে এবং মেহেরপুর দখল করে নেয়। এ সময় মুজিবনগর সরকার ভারতে আশ্রয় নেয় এবং প্রধান কার্যালয় গঠন করে ভারতের কলকাতায়। এ প্রবাসী সরকারকে সর্বতোভাবে ভারত সহায়তা করেছিল ।
৯. স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের জন্য ট্র্যান্সমিটার প্রদান : মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকারের প্রচার প্রচারণা ও মুক্তিবাহিনীকে দিক নির্দেশনা প্রদানের জন্য প্রয়োজন ছিল একটি বেতারকেন্দ্রের। ভারত সরকার ৫০ কিলোওয়াটের একটি ট্র্যান্সমিটার যন্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র।
১০. সেক্টরে বিভক্ত করে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা : ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য ছয়টি সেক্টর প্রতিষ্ঠা করে। পশ্চিম বাংলার মূর্তি ক্যাম্পে আলাদা সেক্টর, পশ্চিম বাংলার রামগঞ্জে ব্রেভো সেক্টর, বিহারের চাকুলিয়ায় চার্লি সেক্টর, ত্রিপুরার দেউতামূরায় ডেলটা সেক্টর, আসামের সাসিমপুরে ইকো সেক্টর এবং মেঘালয়ের তুবায় ফক্সট্রট সেক্টর প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সকল সেক্টরগুলো মুক্তিযুদ্ধে সর্বতোভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১১. ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর : ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ২০ বছরের মৈত্রী চুক্তি করে যার মূল বিষয় ছিল দু’দেশের কেউ আক্রান্ত হলে একে অপরকে সাহায্য করবে। এর ফলে
মুক্তিকামী জনতার মনোবল বহুগুণে বেড়ে যায়। ভারত আরো দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে সক্ষম হয়।
১২. আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রচারণা : প্রথম দিকে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের কোনো মিশন ছিল না। ভারত বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা এবং নিরীহ বাঙালির বিরুদ্ধে পাকবাহিনীর অত্যাচার ও অন্যায় আক্রমণ ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষে তৎপরতা চালিয়েছিল। এক্ষেত্রে ভারতের সরকারবিরোধী দলীয় নেতারা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভারতের সংবাদপত্র, গণমাধ্যম, মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, শরণার্থী সমস্যা প্রচার করে বিশ্ব জনমত গঠনে সহায়তা করে।
Paragraph/Composition/Application/Email/Letter/Short Stories | উত্তর লিংক |
ভাবসম্প্রসারণ/প্রবন্ধ, অনুচ্ছেদ/ রচনা/আবেদন পত্র/প্রতিবেদন/ চিঠি ও ইমেল | উত্তর লিংক |
১৩. বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান : ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর ফলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃতি লাভ করে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত পরিণতি লাভে এগিয়ে যায়।
১৪. মিত্রবাহিনী গঠন এবং সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনী গঠন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। মাত্র ১৩ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে।
১৫. আত্মসমর্পণ ও বাংলাদেশের অভ্যুদয় : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি বাংলাদেশ ভারত যৌথবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ফলে জন্ম হয় নতুন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ত্যাগ স্বীকার ছিল অতুলনীয়। গণহত্যার বিরুদ্ধে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি শরণার্থী সমস্যা ও অন্যান্য আরো কিছু কারণে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছিল। ভারতই একমাত্র দেশ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিল।