ভূমিকা : বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের ২৩.০৫% বেশি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন করে। সরকারি পর্যায়ে দারিদ্র্যতা দূরীকরণের ঢাক-ঢোল বাজানো হলেও দারিদ্র্যতা ঊর্ধ্বমুখী।
বাংলাদেশে দারিদ্র্যের কারণসমূহ আলোচনা কর,বাংলাদেশে দারিদ্রোর জন্য কারণগুলো তুলে ধর।
বাংলাদেশে দারিদ্রোর জন্য দায়ী কারণগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:
১. অর্থনৈতিক অনুন্নতি বাংলাদেশে দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ হলো অর্থনীতির অনুন্নত অবস্থা। অনুন্নতির কারণেই জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে দৈনন্দিন জীবনের অতিপ্রয়োজনীয় অভাব পূরণ ছাড়াই জীবনযাপন করতে হয়।
২. সম্পদ ও আয় বণ্টনে অসাম্য এদেশে দারিদ্র্যের আরেকটি কারণ হলো আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে নিদারুণ বৈষম্য। সম্পদের মালিকানা দেশের মুষ্টিমেয় ধনী ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত। অন্যদিকে সিংহ ভাগ লোক অসহায় ও দরিদ্র। ফলে দারিদ্র্য দিন দিন প্রকটতর হচ্ছে।
৩. অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা : বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত। বিভিন্ন কারণে এদেশের কৃষি উৎপাদন ক্ষমতা অত্যন্ত কম। কৃষির এ স্বল্প উৎপাদন ক্ষমতা বাংলাদেশের জনসাধারণের দারিদ্র্য ও নীচু জীবনযাত্রার মানের জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
৪. উচ্চ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি : বর্তমানে বাংলাদেশে ১.৩৭% হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। এ কারণে জীবনযাত্রার মানের কাঙ্খিত উন্নয়ন অর্জিত হয়নি। ফলে দারিদ্র্য দিন দিন প্রকট রূপ লাভ করছে।
৫. শিল্পে অনগ্রসরতা : আধুনিক বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নতির অন্যতম উপায় হচ্ছে শিল্পায়ন। অথচ শিল্প ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুবই অনগ্রসর। শিল্প কারখানার অভাবে আমাদের কৃষি বহির্ভূত বেকারদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বেড়েই চলেছে।
৬. বেকারত্ব : সর্বশেষ লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১৬ অনুযায়ী বাংলাদেশে ২৬ লক্ষ লোক বেকার। দেশে বেকারদের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দারিদ্র্যাবস্থার অবনতি ঘটেছে। প্রতি বছরই বেকার, অর্ধ-বেকার এবং ছদ্মাবেশি বেকারদের সংখ্যাও স্ফীত হয়। ফলে জীবনযাত্রার মান নিচু হয় এবং দারিদ্র্য তীব্র
আকার ধারণ করে।
৭. প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণব্যবহার : বাংলাদেশের যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। কিন্তু মূলধনের অভাব, কারিগরি জ্ঞান ও উদ্যোক্তার অভাবে এসব প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের অভাবে বাংলাদেশে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।
৮. ভূমিহীনতা : ভূমিভিত্তিক অর্থনীতিতে ভূমিহীনতার সাথে দরিদ্র্যতার একটি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। এদেশের ভূমিহীনরাই চরমভাবে দরিদ্র।
৯. পল্লি উন্নয়নে অবহেলা : ১৯৮৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল শহরভিত্তিক। শহর উন্নয়নে বাজেটের ৯০% বরাদ্দ করা হত। আর গ্রাম উন্নয়নের জন্য ১০%। পরবর্তীতে গ্রাম-শহর উন্নয়নে সমতা আনার চেষ্টা চলছে। NGO দের হাতে পল্লি উন্নয়নের ভার ছেড়ে দিলে পল্লি উন্নয়ন সত্যিকারভাবে কোন দিন হবে না।
১০. শিক্ষা ও কারিগরি জ্ঞানের অভাব : বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুগে প্রায় সকল পেশার জন্য শিক্ষা ও কারিগরি জ্ঞান আবশ্যক। বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার মাত্র ৬৩.০৬%। এছাড়া দেশের অধিকাংশ লোকই কারিগরি দক্ষতা বর্জিত। ফলে কর্মসংস্থানের অভাবে তারা দরিত্র জীবন যাপন করে।
১১. দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব : বাংলাদেশে দক্ষ উদ্যোক্তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। পুঁজি বিনিয়োগ করে ঝুঁকি গ্রহণ করার মত উদ্যোক্তার সংখ্যা খুবই কম। দক্ষ, অভিজ্ঞতা সম্পন্ন উদ্যোক্তার স্বল্পতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
১২. মুদ্রাক্ষীতি : বর্তমান বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ৫.৩৫%। দামস্তরের অব্যাহত বৃদ্ধি এদেশে দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ। দামস্তরের ক্রমাগত বৃদ্ধির দরুণ অর্থের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির লোক কম পরিমাণ দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় করতে পারে। মাথাপিছু প্রকৃত আয় অনেক হ্রাস পায়। ফলে দরিদ্র লোকদের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৩. মূলধনের অভাব : বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক দরিদ্র এবং তাদের মাথাপিছু আয়ও খুব কম। এ কারণে এদেশের মূলধন গঠনের হার অত্যন্ত কম। পর্যাপ্ত মূলধনের অভাবে বাংলাদেশের প্রাপ্ত সম্পদ ও জনশক্তি সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
১৪. নিম্ন মানের প্রযুক্তি : উৎপাদন ক্ষেত্রে নিম্নমানের প্রযুক্তি ব্যবহার ও বাংলাদেশের দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। এদেশের কল-কারখানায় ও কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদনের যে কলাকৌশল ব্যবহৃত হয়, তা অনেক নিম্নমানের। নিম্নমানের প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মাথাপিছু উৎপাদনশীলতা নিম্ন পর্যায়েই থেকে গেছে। এজন্য অর্থনীতি দারিদ্র্য অবস্থায় রয়েছে।
১৫. স্বাধীনতা পূর্ব সরকারের অবহেলা : ব্রিটিশরা প্রায় দু’শ বছর এবং পাকিস্তানিরা প্রায় ২৩ বছর বাংলাদেশকে শোষণ করেছে। তাদের শোষণনীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা ও দারিদ্র্যের জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
১৬. সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কারণসমূহ : বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রচলিত সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কারণে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ। সামাজিক দায়দায়িত্ব পূরণ এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনের জন্য এদেশের সাধারণ মানুষেরা যথেচ্ছ ব্যয় করে। আর একবার ঋণ গ্রহণ করলে তারা ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং আজীবন তার শিকার হয় । ফলে দারিদ্র্য আরও বাড়ছে।
১৭. সামাজিক নিরাপত্তার অভাব শারীরিক පි মানসিকভাবে অক্ষম, অসহায় লোকদের জন্য প্রয়োজনীয় ও কার্যকর সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর দারিদ্র্যের সংখ্যা বাড়ছে।
১৮. দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলা ১১৭৬ সালে এদেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল যা দরিদ্রতা বাড়িয়েছিল। এরপর ১৯৪৩ সালে ও ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। এ সময় অনেক ধনী পরিবার জমি জমা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে এবং দরিদ্র হয়েছে। ১৯৮৮ ও ১৯৯১ সালে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস আমাদের দারিদ্র্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে।
১৯. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার : স্বাধীনতা লাভের পর ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের ফলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে উঠেনি। বস্তুত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং দক্ষ প্রশাসনিক অবকাঠামোর অভাব বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের জন্য বিশেষভাবে দায়ী ।
২০. বাণিজ্য শর্তে অবনতি : শহর ও গ্রামের মধ্যে বাণিজ্য শর্তের মধ্যে অবনতি লক্ষ করা যায় যা দারিদ্র্যতা বাড়িয়েছে । গ্রামগুলো কৃষি পণ্য উৎপাদন ও শহরগুলো শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন করে। কৃষি পণ্যের মূল্য অস্থিতিশীল কিন্তু শিল্প পণ্য স্থিতিশীল। ফলে গ্রাম ও শহরের বৈষম্য দ্রুত বাড়ছে। গ্রামীণ দারিদ্র্য কমছে না।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনায় বলা যায় যে, বাংলাদেশের দারিদ্র্যের জন্য কোনো একটি কারণ এককভাবে দায়ী নয়; বরং বিভিন্ন কারণ পরিবেশ ও পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশ অধিক দরিদ্র।
একাডেমিক শিক্ষা বিষয়ক লিখিত প্রশ্ন সমাধান পেতে ক্লিক করুন।