বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করো
বাংলাদেশের জনগণের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দাও
পৃথিবীর যেকোনো সমাজব্যবস্থয় নৃতাত্ত্বিক ধারণা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক ধারা।
জটিল প্রকৃতির। বাঙালি কোন একক নরগোষ্ঠী থেকে উৎপত্তি হয়নি। কতিপয় নরগোষ্ঠীর মিলিত ফল বাঙালি।
বাঙালির নু গোষ্ঠীরা ভিন্ন ভিন্ন চেহারা পরিলক্ষিত হয়। বাঙালির আকার মাঝারি, তবে ঝোঁক খাটোর দিকে, চুল কালো, চোখের মণি হালকা থেকে ঘন বাদামি।
বাংলা ভাষা মানুষকে নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায় বাঙালি জাতি ।
বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পটভূমি : বাংলাদেশের মানুষের মঞ্জ বসবাস কখন থেকে শুরু তা জানার কোনো সুস্পষ্ট ইতিহাস নেই। বাঙালি জাতি সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিকদের ধারণা এটি একটি মিশ্রিত জাতি এবং এ অঞ্চলে বসবাসকারী আদিমতম মানবগোষ্ঠীর অন্যতম।
পৃথিবীর বহু জাতি বাংলায় প্রবেশ করেছে এবং বসতি গড়ে তুলেছে। আবার এখান থেকে চলেও গেছে। ফলে বাঙালির রক্তে মিশছে বহু এবং বিচিত্র নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব।
সুনির্দিষ্ট মানবজীবনের অস্তিত্বহীনতা বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর বসবাস ও সংমিশ্রণে এবং বহিরাগতদের আগমনও প্রভাবের কারণে অতীতে এদেশের জনগোষ্ঠীর একটি কাঠামোগত নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি রূপায়ণ সম্ভব হয়নি।
১৯৪৭ সালে বঙ্গদেশের অধিবাসীদের মধ্যে যেসব নৃতাত্ত্বিক উপাদান চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে তা হলো : দীর্ঘ শিরস্ক উপাদান এ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত জনগণের রয়েছে নানা নৃজাতির রূপ ।
বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ও আর্য জনগোষ্ঠী
১. আদি অস্ট্রেলয়েড : বঙ্গদেশে আদি অস্ট্রেলয়েট এর নিকটতম প্রতিনিধি হিসেবে মুন্তা, মালে, খারিনা, ওরাও সাঁওতাল ও মাল পাহাড়িয়াদের চিহ্নিত করা যেতে পারে ।
২. দ্রাবিড়ে উপাদান : দ্রাবিড় উপাদান বাঙালি জাতির মধ্যে প্রতিনিধিত্বমূলক দ্রাবিড় জাতির বিশুদ্ধ কোনো পণগোষ্ঠী পাওয়া না ভালো গেলেও মধ্যম নাসাকৃতি, দীর্ঘ শিরস্কতা ও মোটামুটি নাসাকৃতি, দীর্ঘ শিরস্কতা ও মোটামুটি সুন্দর অবয়বের বৈশিষ্ট্যকে দ্রাবিড় হিসেবে গণ্য করা হয় ।
রিয়াল ও অন্যান্যদের সংগৃহীত উপাদান থেকে দেখা ( যায় যে, হিন্দু জাতির মধ্যে মাহিষ্য, মুচি, বাগদি, রাজবংশী ক্ষত্রিয় এবং মুসলমানদের মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যের আধিক্য দৃষ্ট হয়।
৩. আর্য উপাদান : ইন্দ্রো ভূমধ্য দীর্ঘ শিরস্ক উপাদানগুলো আমাদের মধ্যে দেখা যায়।
বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এ উপাদানগুলো গোয়ালা, মুচি, রাজবংশী ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণদের মধ্যে দেখা যায় ৷
৪. মোঙ্গলীয় উপাদান : বাঙালিদের মধ্যে দীর্ঘশিরাকৃতির সামান্য অবদান সম্ভবত দীর্ঘ শিরক মোঙ্গলীয় পণ থেকে এসেছে। এ উপাদানগুলো ময়মনসিংহবাসী গারো জনগণ, বগুড়া, ময়মনসিংহের কোচ ও হাজংদের মধ্যে এ ধরনের বৈশিষ্ট্যের কিছুটা ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়।
বিভিন্ন নৃগোষ্ঠার সাথে মিশে বাঙালি একটি সংকর জাতিতে পরিণত হয়েছে। আর্যদের সাথে সাঁওতাল, গারো মুক্তা ইত্যাদির সংমিশ্রণ ঘটেছে। পার্থীক, অক, তুর্কি, পাধান, ইরানি, আরবসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রভাব বাঙালিদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।
বহিরাগত জনগোষ্ঠী ব্যবসা- বাণিজ্যের জন্য বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনতাভিক ক্ষেত্রে নতুন নতুন সংমিশ্রণ ও সংযোজন হয় ।
বাঙালি জাতির নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় সম্পর্কে মনীষীদের উক্তি : বাঙালিদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় প্রদানে বিভিন্ন মনীষী | বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছেন। তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গি নিম্নে ) আলোচিত হলো :
বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় সম্পর্কে লেখো
১. হান্টারের অভিমত : হান্টার বাঙালি নৃগোষ্ঠীদের পরিচয় প্রদানে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিমত প্রদান করেছেন। হান্টার তার লেখা Annals of Rural Bangal এবং The Indian ( Musalman গ্রন্থদ্বয়ে বলার চেষ্টা করেছেন যে, এ দেশের মুসলমানরা উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং বাকি সব বৌদ্ধধর্ম থেকে ধর্মান্ত রিত হয়ে মুসলমান হয়েছে।
তার এ মতামত অনেকেই সমর্থন করেন না কারণ তাদের মতে, মুসলমানদের অধিকাংশ নিম্ন বর্ণের হিন্দু থেকে কনভার্ট হওয়া। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বিদেশি প্রভাব থাকলেও নৃতাত্ত্বিকভাবে তা প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি।
২. বিরাজ শঙ্কর : নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দানে সবচেয়ে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছেন বিরাজ শঙ্কর ।
তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীকে ছয়টি শ্রেণিকে বিভক্ত করেন। তার শ্রেণিবিভাগ অনুসারে বাঙালি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে দ্রাবিড়ীয়, আদি অস্ট্রেলীয়, মঙ্গোলীয় ও কাকেশীয় এ চার ভাগে ভাগ করেছেন।
দক্ষিণ ভারতে উৎপাদিত কতিপয় অনন্য উপাদানসহ ও বাংলা প্রধানত দ্রাবিড়ীয় শ্রেণির অন্ত র্ভুক্ত। এদের অধিকাংশ জনগণ সিলেট এলাকায় বসবাস করে।
প্রধানত আদি অস্ট্রেলীয় থেকে আগত সাঁওতাল ও খাসিয়ারা বর্তমানে বাংলাদেশের নাচোল, পোবশা হরিপুর ও বানিসানকাইল দেখতে . পাওয়া যায়। সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে খাসিয়াদের বসতি রয়েছে তাদের অধিকাংশই চা বাগানের শ্রমিক
৩. হটন-গুহের অভিমত : জে. এইচ. হটন ও বি. এস গুহ- এর মতে, ক্ষুদ্র ও প্রশস্ত মুখমণ্ডল, দীর্ঘ সুন্দরতর, বঙ্কিম বা কুঞ্জ নাক, বিবর্ণ শ্বেত থেকে তামাটে বাদামি গায়ের রং, চোখ হালকা বাদামি থেকে কাল চুল সোজা ও তরঙ্গায়িত জনগোষ্ঠী হচ্ছে বাঙালি, অসমীয়া, উড়িয়া, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটী। এরা আর্মেনীয় আলপাইন জনগোষ্ঠী। আর চাকমারা মঙ্গোলীয়া অনেকেই হটন- গুহের এ মতের সাথে একমত পোষণ করেননি।
৪. রমা প্রসাদের উক্তি : বিখ্যাত মনীষী রমা প্রসাদ চন্দ্র বলেন- “গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি বাঙালিদের মধ্যেও আলপাইন মানব ধারার প্রভাব রয়েছে। তিনি DR. S. Hutton এর সাথে ঐক্যমত পোষণ করে বলেন, বাঙালি ও আলপাইন মানব গোষ্ঠীর মধ্যে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের যথেষ্ট মিল ছিল । মূলত এখান থেকেই বুঝা যায় বাঙালি আলপাইন মানব গোষ্ঠীরই অংশ।
৫. হার্বাট রিজলের বক্তব্য : ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, এদের অধিকাংশ মাথা গোল নাক মধ্য আকৃতি থেকে চওড়া এবং উচ্চতা মাঝারি, বাঙালিদের গায়ের রং শ্যামলা কালো ও পীত বর্ণের। তিনি বাঙালিদের আকৃতি বৈশিষ্ট্যের মিল খুঁজে কিছুটা পেয়েছেন আলপাইনদের সাথে। তাইতো তিনি বলেছেন- Bengal itself was mustly mesatic ephalice and dolicho cepholism only appeus in some of dravian tribes.
৭. ফজলে রাব্বীর অভিমত : ফজলে রাব্বী তার বর্ণনায় বাঙালিদের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর পরিচয় খুব সুন্দরভাবে দিয়েছেন তিনি তার “হকিকাতে মুসলমান বাঙালি” গ্রন্থে মত পোষণ করেছেন যে বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীতে তুর্কি, আফগান, আরবি, আবিসিনীয় ও ইরানীদের প্রভাব রয়েছে। আট ও নয় শতকে এসব বহিরাগত মুসলিম ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম নোয়াখালী ও সিলেট অঞ্চলে প্রবেশ করে।
বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ব্যাখ্যা কর
৭. নীহার রঞ্জন রায় : বাঙলার ইতিহাসের অগ্রদূত ইতিহাসের প্রাণ পুরুষ নীহার রঞ্জন রায় বাঙালির নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর পরিচয় দিতে গিয়ে তার ‘বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থে হিন্দুধর্ম ও সাংস্কৃতির উৎপত্তি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য প্রদান করেন। তিনি বলেন অনেক রূপান্তর ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অস্ট্রেলীয় ও দ্রাবিড় নৃগোষ্ঠীর ধর্মীয় আচার বিশ্বাস হিন্দু সমাজে অনুপ্রবেশ করে। এতে বাঙালি হিন্দুদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় ফুটে উঠে। এদেশে নৃ-গোষ্ঠী গঠনে ঐসব আদি অস্ট্রেলীয় ও দ্রাবিড় প্রভাব বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ তবে আর্যদের প্রভাবও একেবারে অস্বীকার করা যায় না। তিনি বলেন, “বাঙালি জাতির গঠনে অস্ট্রেলীয় ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণ ছিল।”
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বিখ্যাত মনীষীদের বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পারি বাঙালি জাতি নৃগোষ্ঠীগত বহু জাতির সংমিশ্রণের ফলে গড়ে উঠেছে তারপরও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে মনীষীরা বর্ণনা করেছেন যে তাদের মাথা গোলাকৃতি, চুল কালো, চোখের মনি পাতলা থেকে ঘন বাদামি, মোটামুটি মাঝারি আকৃতির নাক পাতলা থেকে গাঢ় বাদামি চামড়া এবং মুখমণ্ডল মধ্য আকৃতির । এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে বাঙালি জাতিকে আলাদা নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে চেনা যায়। তবে বাঙালি জাতির মধ্যে আদি অস্ট্রেলীয় প্রভাব বিদ্যমান ছিল আর তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো পরিলক্ষিত হয় সাঁওতাল ও বাও উপজাতি এবং কিছু সমতলবাসীর মধ্যে।