বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ
একাডেমিক শিক্ষা বিষয়ক লিখিত প্রশ্ন সমাধান পেতে ক্লিক করুন।
একজন দক্ষ বিনিয়োগকারীকে বিনিয়োগ পরিবেশ সম্পর্কে সদা সচেতন থাকতে হয়। বিনিয়োগ পরিবেশের সাথে বিভিন্ন উপাদান জড়িত । এই উপাদানগুলো কম-বেশি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। সে জন্য বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের . সময় এই উপাদানগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ
১. অনিশ্চয়তা : বিনিয়োগকারীকে বিনিয়োগ করার পূর্বে ভবিষ্যত দর্শন করতে হয়। ভবিষ্যত সদাই অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ। একজন বিনিয়োগকারী বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সম্পদে বিনিয়োগ করে। এই আর্থিক সম্পদের বৈশিষ্ট্যগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। সে জন্য বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে এ অনিশ্চয়তার মাত্রা বিবেচনায় রাখতে হবে ।
অনেক সময় দেখা যায়, বিনিয়োগকারী অতীতের তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । কিন্তু এ প্রক্রিয়াটি ত্রুটিমুক্ত নয়। কারণ, সময়ের সাথে সাথে বিনিয়োগে পরিবেশের ভিন্নমুখিতা পরিলক্ষিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় ও নীতিমালায় পরিবর্তন সাধন করতে হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, অতীতের তথ্যের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে অনিশ্চয়তার মাত্রা বৃদ্ধি পায় ।
বিনিয়োগ পরিবেশের ভবিষ্যত সম্পর্কে মূল্যায়ন করা কষ্টসাধ্য। কারণ, ভবিষ্যত সবসময় অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ । সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আমাদেরকে প্রত্যাশিত ফলাফলের উপর নির্ভর করতে হয়। তবে প্রত্যাশায় বিচ্যুতি ঘটার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং এ বিচ্যুতি সৃষ্টি হয় অনিশ্চয়তা থেকে
২. বিনিয়োগের বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া : বর্তমান আধুনিক যুগে বিনিয়োগকারীদের বিশ্বায়ন সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। যদিও বিনিয়োগের বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া অনেক বছর আগে হতে চালু হয়েছে, কিন্তু আমেরিকার বিনিয়োগকারীরা ছাড়া অন্যরা এ. ক্ষেত্রে তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। কিন্তু বর্তমানে বিনিয়োগের বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া হতে দূরে থাকার কোনো সুযোগ নেই ।
বিনিয়োগের বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেক সুযোগ বিদ্যমান। সুযোগ-সন্ধানী বিনিয়োগকারীরা সে জন্য শুধুমাত্র ঘরোয়া পরিবেশে না থেকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ পরিবেশে বিচরণ করে। একজন বিনিয়োগকারী যদি ঘরোয়া পরিবেশের তুলনায় আন্তর্জাতিক পরিবেশে নতুন নতুন সুযোগের সন্ধান পায় এবং মুনাফার পরিমাণও বাড়াতে পারে তাহলে সে কেন বিনিয়োগের বিশ্বায়নকে মেনে নেবে না ।
আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারগুলো দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জাপানের আর্থিক বাজার অগ্রগণ্য। কারণ এ আর্থিক বাজার খুব দ্রুত নিচু স্তর হতে উচ্চ স্তরে প্রবেশ করেছে। পশ্চিম ইউরোপের আর্থিক বাজারসমূহ বিনিয়োগকারীদের নতুন নতুন বিনিয়োগ সুযোগের সন্ধান দেয়। বর্তমান দ্রুত বিকাশমান আর্থিক বাজারে উত্থান ঘটেছে। এসব বাজারে ঝুঁকির পরিমাণ বেশি এবং সেই সাথে মুনাফার হারও অধিক। এই দ্রুত বিকাশমান আর্থিক বাজার বিনিয়োগের বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে।
৩. আধুনিক অর্থনীতি বনাম প্রাচীন অর্থনীতি : আমরা দেখতে পাই যে, বিনিয়োগকারীদেরকে পরিবর্তনশীল বিনিয়োগ পরিবেশে খাপ খাওয়াতে হয়। অতীতে দেখা অতীতে দেখা যেত বড় আর্থিক বাজারে ছোট-বড় সব কোম্পানিই অন্তর্ভুক্ত থাকত। কিন্তু বর্তমান আর্থিক বাজারের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছে। আধুনিক আর্থিক বাজারে প্রাচীন আর্থিক বাজারের কৌশল প্রয়োগ করা সমীচীন নয়।
প্রাচীন আর্থিক বাজারে দেখা যেত কোম্পানিগুলো একটি নির্দিষ্ট গতিতে পণ্য উৎপাদন করত এবং তা বিক্রি করে নির্দিষ্ট মাত্রায় মুনাফা পেত। কিন্তু আধুনিক যুগে নতুন নতুন বিনিয়োগ কৌশলের আবির্ভাব ঘটেছে। এর ফলে ঝুঁকির মাত্রাও বেড়েছে এবং সেই সাথে মুনাফার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, বিনিয়োগকারীদেরকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিনিয়োগ পরিবেশে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেজন্য অবস্থান পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগকারীদেরকে তাদের কৌশল নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির অবদানে অনস্বীকার্য। আধুনিক বিনিয়োগ পরিবেশে যৌক্তিক বিনিয়োগ নীতিমালা অনুসরণ করতে হয় ।
অর্থনীতির আধুনিকায়নে নতুন নতুন মডেলের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রাচীন অর্থনীতিতে বাজার প্রতিযোগিতা অনেক কম ছিল । বর্তমানে একচেটিয়া অর্থনীতির পরিবর্তে প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি তথা বাজার অর্থনীতি বিরাজ করছে। বিনিয়োগকারীকে তার বিনিয়োগের তহবিল নিয়োগের পূর্বে বাজার । অর্থনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে হয়ে ।
৪. ইন্টারনেটের উন্নয়ন সাধন : বিনিয়োগের বিশ্বায়ন ” প্রক্রিয়ায় ইন্টারনেটের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে সাথে ইন্টারনেট ব্যবহারেও ভিন্নমুখিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ২০০৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বোর্ডের বিভিন্ন কার্যক্রম ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্পন্ন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
বর্তমানে আধুনিক ইন্টারনেট জগতে বিনিয়োগকারীরা দ্রুত ও কম খরচে বিনিয়োগ সম্পর্কিত তথ্যের আদান-প্রদান করতে পারে। একে রীতি তো একটি বিপ্লব বলা যায়। বিনিয়োগকারীরা তাদের ঘরে বসেই যে কোন সময় বিনিয়োগ ও ব্যবসা সংক্রান্ত তথ্যের আদান-প্রদান করতে হবে। বর্তমান এ সম্পর্কিত কার্যক্রম চালনার জন্য বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানের আমাদের দেশে ই-কমার্সের যথেষ্ট প্রসার ঘটেছে। সুতরাং একজন বিনিয়োগকারীকে আধুনিক বিনিয়োগ পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে তার বিনিয়োগ কৌশল নির্ধারণ করতে হয়।
৫. প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী : বিনিয়োগকারীদেরকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায়, ব্যক্তিক বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বিভিন্ন ধরনের, যেমন- ব্যাংক, বিমা, মিউচুয়্যাল ফান্ড ইত্যাদি। এ ধরনের বিনিয়োগকারীরা বড় আকারের আর্থিক সম্পদের পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগ করে ।
বর্তমান আধুনিক বিশ্বায়ন পরিবেশে এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কার্যক্রম অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। বর্তমান পরিবর্তনশীল বিনিয়োগ পরিবেশে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগ পরিবেশে যে অনিশ্চয়তা থাকে সে অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক হাতিয়ার থাকে। ব্যক্তিক বিনিয়োগকারীদের চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কার্যক্রম অধিক গতিশীল ।
৬. মূলধন খরচ : বিনিয়োগকৃত মূলধনের খরচ বেশি হলে মুনাফার্জন কমে যাবে। এমনকি লোকসানও হতে পারে। আবার মূলধন খরচ যদি আগের তুলনায় কম হয় তবে মুনাফার্জন বেড়ে যাবে। সেজন্য একজন বিনিয়োগকারীকে মূলধন খরচ বিবেচনা করে তার বিনিয়োগযোগ্য তহবিল সংগ্রহ ও বিনিয়োগ হতে প্রাপ্ত মুনাফা ।
৭. কোম্পানির প্রকৃতি : বিনিয়োগের সময় কোম্পানির প্রকৃতি একটি বিবেচনার বিষয় । অর্থাৎ ফার্মটি কি পাবলিক লিঃ কো, আবার ফার্মটি কি বর্ধনশীল ফার্ম না কি পতনশীল ফার্ম ইত্যাদি। কারণ ফার্মের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে বিনিয়োগ হতে প্রাপ্ত মুনাফা ।
৮. রাজনৈতিক : একটি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে উন্নত দেশগুলো বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তাছাড়া দেশীয় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ নিরাপত্তার জন্যও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে কোন ধরনের বিনিয়োগ ক্ষেত্রে অন্তরায় এবং হুমকিস্বরূপ।
৯. সরকারি নীতিমালা : একটি দেশের সরকার যদি বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন করতে সচেষ্টা হয় তাহলে বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক অদূরদর্শী শুল্ক নীতির কারণে দেশীয় বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই সরকারি সুষ্ঠু বিনিয়োগ নীতিমালার উপর দেশী বিদেশী প্রবাহ প্রভাবিত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বিনিয়োগ পরিবেশ সদা পরিবর্তনশীল। তাই বিনিয়োগকারীদের পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের সঠিক মূল্যায়ন করে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এতে করে অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করা সহজ হবে এবং বিনিয়োগ প্রক্রিয়া ও হবে সে সাথে গতিশীল ।
একাডেমিক শিক্ষা বিষয়ক লিখিত প্রশ্ন সমাধান পেতে ক্লিক করুন।