প্রশ্ন সমাধান: ব্যাংক তারল্য কাকে বলে,ব্যাংকের তারল্য নীতি বলতে কি বুঝায়?, বাণিজ্যিক ব্যাংকের তারল্য নীতি কি, ইসলামিক ব্যাংকের তারল্য নীতি কি,অর্থনীতিতে বাজারের তারল্য সংকট (লিকুইডিটি) বলতে কী বোঝায়?,তারল্য ব্যবস্থাপনার তত্ত্ব কি?,অতিরিক্ত তারল্য সত্ত্বেও সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতিতে
প্রশ্ন সমাধান: ব্যাংকের তারল্য নীতি বলতে কী বুঝায়?
তারল্য হলাে কোনাে সম্পত্তির কম ক্ষতিতে দ্রুত নগদ অর্থে রূপান্তরযােগ্যতা। ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী ব্যাংক তার আমনতকারীর অর্থ চাহিবামাত্র ফেরৎ দিতে বাধ্য। যে নীতির আওতায় ব্যাংকসমূহ নিজের কাজে নগদ অর্থ ও তরল সম্পদ সংরক্ষণ করে অবশিষ্ট অংশ ঋণ দেয় ও বিনিয়ােগ করে তাকেই তারল্য নীতি বলা হয়।
[ বি:দ্র: নমুনা উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)]
প্রশ্ন সমাধান: তারল্য ব্যবস্থাপনার তত্ত্ব কি?
চাওয়া মাত্র জনগণের আমানতের দাবি নগদ অর্থে পূরণ করার ক্ষমতাকে তারল্য বলে। এজন্য প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে পর্যাপ্ত পরিমাণ নগদ অর্থ তরল আকারে সংরক্ষণ করা উচিত। কিন্তু তাই বলে যদি ব্যাংক আমানতের সব অর্থ নগদ অবস্থায় ধরে রাখে তাহলে ব্যাংকের তারল্য নীতি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয় সত্যি কিন্তু মুনাফা অর্জন নীতি ব্যাহত হয়। নগদ অবস্থায় সম্পদ ধরে রাখলে ব্যাংকের পক্ষে মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয় না, আবার অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য অধিক পরিমাণ ঋণ প্রদান করতে হয়। ফলে ব্যাংকের তারল্য অবস্থা বজায় রাখা সম্ভব হয় না। সুতরাং এ দুটি পরস্পর বিরোধী নীতির সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য তারল্য ব্যবস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে যুগে যুগে বিভিন্ন তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে। নিম্নে এরূপ কয়েকটি তত্ত্বের বর্ননা তুলে ধরা হলো-
১. বাণিজ্যিক ঋণ তত্ত্ব বা স্ব-তারল্য বা প্রকৃত বিল তত্ত্ব;
২. স্থানান্তরযোগ্য তত্ত্ব;
৩. প্রত্যাশিত আয় তত্ত্ব; ও
৪. দায় ব্যবস্থাপনা তত্ত্ব।
১. বাণিজ্যিক ঋণ তত্ত্ব বা অ-তারল্য বা প্রকৃত বিল তত্ত্ব (Commercial loan Theory/Self Liquidity or Real Bills Doctrine Theory)
১৮শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক ঋণ তত্ত্বের উদ্ভব হয়। এ তত্ত্ব অনুসারে, বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলােতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রদান করে যাতে তারা তাদের তারল্য চাহিদা মেটাতে পারে। এ সমস্ত ঋণ দ্বারা মানুষের বিভিন্ন ধরনের চাহিদা; যেমন- উৎপাদন, বন্টন, যাতায়াত ইত্যাদি মেটাতে পারে। অন্যভাবে বলতে গেলে, কোনাে ঋণকে তখনই স্ব-তাৱল্য বলা হবে যদি উক্ত ঋণের জামানত হিসেবে এমন সব দ্রব্য থাকে যা প্রস্তুত পর্যায়ে বা প্রস্তুতকৃত দ্রব্য চুড়ান্ত বিক্রয়ের জন্য রয়েছে। দ্রব্যগুলাে বিক্রয় করা হলেই ঋণ পরিশােধ করা হবে। এরূপ ঋণ ব্যাংকের অবিরত তারল্য (Continuous liquidity) ও আয়ের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। ফলে তারল্য ও আয় একই সাথে লাভ করা সম্ভব হয়। আর এটাই বাণিজ্যিক ব্যাংকের তারল্য ঋণ তত্ত্ব বা প্রকৃত বিল তত্ত্বের মূল ধারণা।
এ তত্ত্বে ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি ঋণ যেমন- স্থায়ী যন্ত্রপাতি, বাড়ি নির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অর্থায়ন করতে কম আগ্রহ প্রকাশ করে। এ মতবাদের মূল যুক্তি হলাে, স্বল্পমেয়াদি ঋণ দানের মাধ্যমে ব্যাংক লেনদেন করা খাতের ব্যাংক কখনােই কু-ঋণের প্রভাবে না পড়ে। ফলে আমানতকারীর চাহিদা মােতাবেক তারল্য রক্ষা করে ব্যাংক পরিচালনা সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত হয়।
২. স্থানান্তরযােগ্য তত্ত্ব (The shiftability theory)
১৯১৮ সালে আমেরিকার এইচ. জি. মৌলটন (H. G. Moultion) সর্বপ্রথম এ তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা দেন। এ তত্ত্বে ঋণের পরিপক্বতার চেয়ে বরং সম্পদের স্থানান্তরযোগ্যতাকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। ব্যাংক কত তাড়াতাড়ি তার সম্পদ স্থানান্তর করতে পারে তা এখানে দেখা হয়। এখানে লক্ষণীয় যে সম্পদ স্থানান্তরের সময় যাতে কোনাে মূলধন লােকসান না হয়। এ তত্ত্ব অনুযায়ী কোনাে সম্পদকে সম্পূর্ণরূপে স্থানান্তরযােগ্য হতে হলে তাৎক্ষণিকভাবে অন্য সম্পদে রূপান্তরিত হবাৱ বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে যাতে কোনাে মূলধন লােকসান ব্যতীত গ্রাহকদের তাৎক্ষণিক চাহিদা পূরণে সক্ষম।
যখন সব ব্যাংকিং সেক্টর তারল্য সমস্যার সখীন হবে তখন এ তত্ত্বটি প্রযােজ্য হবে না। কারণ এ সময় একটি ব্যাংক তারল্য রক্ষার জন্য এমন সম্পদ সংরক্ষণ করবে যার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে সাহায্য পেতে পারে। অবশ্য, কোনাে সম্পদ তরল সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করার পূর্বে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন উক্ত সম্পদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট তরল সম্পদ হিসেবে বিবেচ্য কিনা। সাধারণত মাধ্যমিক বাজারে বিক্রয়যোগ্য বিল, বন্ড, সিকিউরিটি ইত্যাদিকে বিনিয়ােগের কথা বলা হয়েছে।
৩. প্রত্যাশিত আয় তত্ত্ব (Anticipated income theory)
১৯৯৯ সালে হার্ভার্ট ভি. প্রোসনাও (Hervert V Prachnow) প্রত্যাশিত আয় তত্ত্বটির উদ্ভাবন করুন। এ তত্ত্ব অনুযায়ী ঋণ গ্রহণকারী তার ঋণ পরিশোধের তালিকাটি প্রতাশিত আয় অথবা নগদ অর্থ গ্রহণের সাথে সমন্বয় করে তৈরি করে। এ তত্ত্বে মেয়াদি ঋণের ওপর জাের দেয়া হয়। একজন ব্যবস্থাপক সেসব প্রকল্পের ওপর গুরুত্ব দেবে যেগুলো ভবিষ্যতে বেশি মুনাফা বা নিশ্চিত মুনাফা অর্জনে সক্ষম। সকল প্রকার ঋণ স্বল্প অথবা দীর্ঘমেয়াদি তরল ঋণ হিসেবে বিবেচিত হয় যদি তা ঋণ গ্রাহকের পরিশোধের ক্ষমতার ওপর বিবেচিত হয়ে প্রদান করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ঋণ গ্রহীতা ও বাংকের মধ্যে এমন একটি চুক্তি হবে যে তার ভবিষ্যতে কি পরিমাণ মেশিনারিজ বা মজুদ পণ্য বিরাজমান থাকবে। এক্ষেত্রে জামানতের ঊপর খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয় না।
অন্যভাবে বলতে গেলে, এই তত্ত্ব অনুসারে ব্যাংকাররা দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পোর্টফোলিওকে তারল্যের উৎস হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সাধারণত সমুদয় অর্থ (সুদ ও আসল) মেয়াদকাল শেষে পরিশােধ করতে হয় না বরং একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর কিস্তির (সুদ ও আসল) মাধ্যমে পরিশােধ করতে হয়। এই কিস্তির টাকাই ব্যাংকের তারল্যের উৎস।
৪. দায় ব্যবস্থাপনা তত্ত্ব (Liability management theory)
এটি তারল্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত তত্ত্বসমূহের সর্বশেষ সংযোজন। ১৯৬০ সালের দিকে এ তত্ত্বটি উদ্ভাবিত হয়। পূর্বের তত্ত্বগুলোতে সম্পদকে তরল সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু দায় ব্যবস্থাপনা তত্ত্বতে সম্পদকে তরল হিসেবে সংরক্ষণ না করে বরং অর্থ বাজার থেকে ঋণপত্র বা অন্যবিধ দলিল বিক্রয় করে দায় সৃষ্টির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করার ওপর গুরুত্বারােপ করা হয়েছে।
প্রশ্ন সমাধান: ব্যাংকের কথিত তারল্য সংকট এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
একটা কথা আমরা অনেক দিন থেকেই শুনে আসছি যে ব্যাংকে অর্থ নেই, বিশেষ করে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে। অর্থের ঘাটতি হওয়াকে অনেকে লিকুইডিটি শর্টেজ বা তারল্য সংকট বলে। তবে লিকুইডিটি শর্টেজ এবং লিকুইডিটি ক্রাইসিসের মধ্যে পার্থক্য আছে। কোনো ব্যাংক সাময়িকভাবে তারল্য ঘাটতিতে পড়তেই পারে। স্বল্পমেয়াদি ঘাটতি মেটানোর জন্য এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ করে। অথবা নিজের হিসাবে রক্ষিত ট্রেজারি বিলসও (টিবিএস) ভাঙাতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য ঘাটতি হলে সেটা কীভাবে মোকাবেলা করা যায়?
সেটাও করা যায়। ওইক্ষেত্রে যে সংস্থা আমাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যাংক, রিজার্ভ মুদ্রা বাজারে ছাড়ে, সেই সংস্থা বা ব্যাংককে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের অর্থনীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ মুদ্রা, যে মুদ্রা আমরা বাজারে প্রচলিত দেখি, তা নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র অধিকার দেয়া হয়েছে। সেজন্য ব্যাংকিং সেক্টরে বা মুদ্রাবাজারে কোনো রকমের ঘাটতি দেখা দিলে সেই ঘাটতি মেটানোর জন্য এই ব্যাংককেই এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু রিজার্ভ মুদ্রা ছাড়ার ক্ষেত্রে একমাত্র আইন দ্বারা কর্তৃত্বপূর্ণ সংস্থা নয়, পুরো অর্থনীতিকে মুদ্রা ব্যবহার দ্বারা ভিজিয়ে (লুব্রিকেটিং) রাখার দায়িত্বও এই ব্যাংকের।
মুদ্রা কী কাজ করে? মুদ্রার মূল কাজ লেনদেনকে সমাধা করা। তবে মুদ্রা নিজেও একটা সম্পদ। অনেক সময় লোকে মুদ্রাকে বিকল্প সম্পদ হিসেবে ধারণ করে। কোনো কারণে যদি অর্থনীতিতে অনেক লোক একই সঙ্গে নগদ অর্থকে ধারণ করতে থাকে, তাহলে তারল্য সংকট হতে পারে। তার পরও সেটা নির্ভর করবে কী ধরনের নগদ ধারণ করছে, তার ওপর।
এসব লোক যদি ঘরে নিয়ে নগদ অর্থ ধারণ করে বা সিস্টেম থেকে তুলে নিয়ে অর্থকে অলস করে বসিয়ে রাখে তাহলে অর্থবাজারে অর্থের ঘাটতি দেখা দেবে। কোনো কোনো অর্থনীতিতে এমন ঘটনা ঘটে, বিশেষ করে কালো টাকার প্রবাহ যখন বেড়ে যায়, অথবা লোকেরা যদি সংকট সম্পর্কে আগাম ধারণা করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে রিজার্ভ বা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মুদ্রা ছাড়ে, সেটি প্রকৃত অর্থে অর্থনীতিতে কত মুদ্রার কাজ করবে বা কত মুদ্রা সরবরাহ ঘটাবে, তা নির্ভর করে অর্থনীতিতে মুদ্রা ব্যবহারের ঘনত্ব ও গতির ওপর।
সহজ কথায় বোঝার জন্য বলা যায় এভাবে যে এক মুদ্রা একই দিন তিনটা লেনদেনেও ব্যবহার হতে পারে, আবার চারটা লেনদেনেও ব্যবহার হতে পারে। যে অর্থনীতি যত বেশি গতিশীল, সেই অর্থনীতিতে অর্থের ব্যবহার বেশি হয় এবং বলা চলে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাড়কৃত রিজার্ভ মুদ্রা থেকে অর্থনীতি অনেক বেশি মুদ্রা সরবরাহ পাবে। অর্থের পুনঃপুন ব্যবহারকে বা এক অর্থ কতবার ব্যবহার হবে, সেই গতিকে অর্থশাস্ত্রে ভেলোসিটি অব মানি বলে। সামগ্রিকভাবে মোট রিজার্ভ মুদ্রা অর্থনীতিতে এসে কত মুদ্রার কাজ করবে, তা নির্ভর করে মুদ্রা ব্যবহারের ঘনত্ব বা গুণকের (মাল্টিপ্লায়ার) মানের ওপর। মাল্টিপ্লায়ার ভ্যালু যদি বেশি হয়, তাহলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ মুদ্রা অর্থনীতিতে বেশি মুদ্রা সরবরাহ বাড়াবে। আর অর্থনীতি যদি ধীরে চলে, তাহলে রিজার্ভ মুদ্রা থেকে উৎপাদিত মুদ্রার মাল্টিপ্লায়ার ভ্যালুও কমে যাবে। সেজন্যই বাংলাদেশ ব্যাংককে সবসময় এটা হিসাবে নিতে হয় যে লেনদেনে বা সম্পদ ধারণে মুদ্রার ব্যবহারের গতিপ্রকৃতিতে কী পরিবর্তন আসছে? আজকে ব্যাংকিং সুবিধা ২৪ ঘণ্টা। ফলে মুদ্রার ব্যবহারের গতিও বাড়ছে। আগে লোকদের খরচের জন্য নগদ অর্থ ঘরে তুলে রেখে দিতে হতো। এখন ক্যাশ লেনদেন যেহেতু কমে যাচ্ছে, সেজন্যই ক্যাশ ধারণের পরিমাণও অনেক কমে যাচ্ছে। ব্যাংকিং সেক্টর থেকে অর্থ যখন বের হয়ে যায়, তখন সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি কম মুদ্রা সরবরাহ পাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক চোখ-কান খোলা রেখে আমাদের মুদ্রা সরবরাহকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে রাখে। আবার অর্থনীতি বড় হতে থাকলেও মোটের হিসাবে অর্থনীতিতে বেশি থেকে বেশি মুদ্রা ব্যবহার হতে থাকবে। সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তার মুদ্রানীতি প্রণয়নের সময় কয়েকটা বিষয়কে হিসাবে নেয়। তার মধ্যে আছে লেনদেনে অর্থ ব্যবহারের ঘনত্ব ও গতি, মানুষের ক্যাশ ধারণের প্রবণতা, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এবং ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহের বিষয়টা।
অন্যদিকে আমাদের অর্থনীতির এক্সটার্নাল সেক্টর বা আমদানি-রফতানি এবং সেসঙ্গে বাংলাদেশী মুদ্রা টাকার বিনিময় হারকেও হিসাবে নেয়া হয়। সুদের হার অর্থনীতির জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সুদের হার কম রাখতে হলে ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ যাতে বাড়ে, সেই লক্ষ্যে মুদ্রা সরবরাহকে বাড়াতে হবে। আর এটা বাংলাদেশ ব্যাংক করতে পারে বা করে তার ওপেন মার্কেট পলিসি অনুসরণ করে। মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক তার নিজস্ব সুদের হার বা রেপো এবং রিভার্স রেপো রেটকে সামান্য কমাতে পারে। অন্যদিকে ব্যাংকের এসএলআর অ্যান্ড সিআরআর (স্ট্যাচুটরি লিকুইডিটি রেশিও এবং ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) কম করলেও বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়বে। তাতে সুদের হার কমতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এডিআর (অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও) বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতেও বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বা অর্থপ্রবাহ বাড়বে। অর্থপ্রবাহ বাড়লে আশা করা যায় কথিত তারল্য সংকট অনেকটাই হালকা হয়ে যাবে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ারবাজারকে নীতিগত সমর্থন দেয়ার জন্য এডিআর বাড়তে দিয়েছে, কিন্তু সেই প্রজ্ঞাপিত বাড়তি অর্থ কতটা শেয়ারবাজারে যাবে, তা আরো অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে।
সব মিলিয়ে এটা বলা যায় যে বাংলাদেশ ব্যাংকই একমাত্র ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংস্থা, যেটা আমাদের অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ কমানো-বাড়ানোর কাজটি করে। এ ব্যাংক তারল্য ঘাটতির কারণে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা, তা তদারকি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে বর্তমানে মুদ্রাবাজারে কোনো রকম ঘাটতি নেই। সেটা অংকের হিসাব হতে পারে। তবে বাস্তব অবস্থা যদি এমন হয় যে কোনো কারণে কিছু লোক বড় অংকের অর্থ ব্যাংকিং বাজার থেকে তুলে নিয়ে ঘরের সিন্দুকে রেখে দিয়েছে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই অংক মিলবে না। সেজন্য মুদ্রানীতি থেকে ভালো ফল পেতে হলে অর্থনীতিকে কালো লেনদেনমুক্ত রাখতে হবে। আমাদের অর্থনীতিতে ঋণখেলাপির সংস্কৃতি এখন সর্বগ্রাসী হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলাপি ঋণের ফাঁদ থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করতে না পারলে সুদের হার যেমন কমানো যাবে না, তেমনি মুদ্রা তথা অর্থ পাচারও বন্ধ হবে না। আর সেই অবস্থায় একটা আদর্শ মুদ্রানীতিও কাঙ্ক্ষিত ফল দেবে না। কালো টাকার আকার বাড়তে থাকলে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের বাজারও স্থিতিশীল থাকবে না। কারণ হলো কালো টাকার ব্যবহার বেশি হয় অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে, যা বৈদেশিক মুদ্রায় ঘটে। অন্য বিষয়টি হলো আমাদের ব্যাংকিং ব্যবসার ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের মেয়াদি ঋণ দিয়ে ব্যবসা করার প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে। আজকে যে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণের বইয়ে যোগ হয়েছে, এর সিংহভাগই হলো টার্ম লোন বা মেয়াদি ঋণ। অন্য দেশে প্রজেক্ট অর্থায়নের জন্য মেয়াদি ঋণের ব্যবসা থেকে ব্যাংক সরে এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক ব্যাংক প্রতিযোগিতা করে একই গ্রাহককে টার্ম লোনসহ বিভিন্ন ঋণ দিয়ে চলেছে। ফলে ওই সব ব্যবসা বেশি ঋণের ফাঁদে আটকে গেছে। শেষ ফল হচ্ছে, এক সময়ের ভালো ব্যবসা শুধু বেশি ঋণ গ্রহণের কারণে দেউলিয়া হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে ব্যাংকিং স্থিতিপত্রও কুঋণের বোঝায় ভারী হচ্ছে।
প্রশ্ন সমাধান: বাংলাদেশে প্রচলিত এবং ইসলামী ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য কী
বাংলাদেশে এতদিন প্রচলিত ধারার ব্যাংকিং করছিল এমন একটি ব্যাংক তার নাম পরিবর্তন করে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে।
নতুন বছরের শুরু থেকে পূর্ণাঙ্গ শরীয়াহভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে এনআরবি গ্লোবাল নামের এই ব্যাংকটি। তাদের নতুন নাম হয়েছে ‘গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক।’
সম্প্রতি এরকম দু’টি ব্যাংক ইসলামী ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করায় বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে ১০-এ উঠেছে।
ইসলামী ব্যাংক এবং প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য কী?
বাংলাদেশে সম্প্রতি প্রচলিত ধারার বেশ কিছু ব্যাংকে ইসলামী ধারার ব্যাংকের একটি ‘উইণ্ডো’ খোলা হয়েছে।
এদের মূল পার্থক্যটা কী – জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক তাসনিমা খান বলছিলেন, মূল পার্থক্যের জায়গাটা হচ্ছে সুদ এবং মুনাফার হিসেবের ক্ষেত্রে।
তিনি বলছিলেন “মূল ধারার ব্যাংকিং এ সুদের বা ইন্টারেস্টের বিষয়টা থাকে। আমরা যখন ব্যাংকে টাকা জমা রাখি তখন একটা নির্দিষ্ট হারে সুদ দেয়াই হচ্ছে। সেখানে ব্যাংকের লাভ বা ক্ষতি হোক আমরা যারা টাকা জমা রাখছি আমাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় হয় না। কিন্তু ইসলামে যেহেতু সুদকে হারাম বলা হয়ে থাকে তাই এটা অনেকের কাছে অনেকটা গ্যাম্বলিং এর মত”।
মূল পার্থক্য সুদ ও লভ্যাংশের
তাসনিমা খান বলছিলেন “ইসলামের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে এটা একটা শেয়ারিং মেথড হবে। ‘প্রফিট-লস-শেয়ারিং’ অর্থাৎ ব্যাংক যেহেতু আমার কাছ থেকে আমানত রাখছে, ব্যাংকের যদি লাভ হয় তাহলে আমার আমানতের উপর আমি লভ্যাংশ পেতে পারি। কিন্তু ব্যাংকের যদি ক্ষতি হয় তাহলে আমি লভ্যাংশ পাওয়ার জন্য যোগ্য হব না। এটাই প্রচলিত এবং ইসলামী ধারা ব্যাংকের মধ্যে মূল পার্থক্য”।
ইসলামী ধারার ব্যাংক পিএলএস অর্থাৎ’প্রফিট-লস-শেয়ারিং’ এ চলে কিন্তু ট্র্যাডিশনাল ব্যাংক বা প্রচলিত ব্যাংকে এটা একটা স্টেটেড রেট থাকে।
একই ব্যবস্থা দেখা যায় ব্যাংক থেকে ঋণের ক্ষেত্রেও।
“ঋণ করলে সেই টাকা আমি লাভজনক ভাবে কোথাও ব্যবহার করতে পারছি কিনা সেটা কিন্তু প্রচলিত ব্যাংক দেখবে না। তারা একটা নির্দিষ্ট হারে সুদ কেটে নেবে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকগুলোতে সেই ব্যবস্থা নেই” বলছিলেন তিনি।
মূলধারার ব্যাংকে প্রফিট মেকিং বা মুনাফা করাই মূল উদ্দেশ্য।
কিন্তু ইসলামী ব্যাংকগুলোতে প্রফিটের বিষয়টা সেভাবে প্রাধান্য দেয়া হয় না।
বিশ্বের যেসব দেশে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা আছে তারা এভাবেই পরিচালনা করে।
ইসলামী ধারার ব্যাংকিংএর কয়েকটি দিক
মুদারাবা কনসেপ্ট- মুনাফার অংশীদারি
মুরাবাহা- লাভে বিক্রি (লোনের ক্ষেত্রে)
মুসারাকা- লাভ লোকসানের ভাগাভাগি
আর এই লাভ লোকসানের ভাগাভাগির ক্ষেত্রে ইসলামী ধারা মানা হয় না বলে মনে করেন অনেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি নুরুল আমিন বলছিলেন, দুই ধারার ব্যাংকের একটা মিল হল তাদের কর্তৃপক্ষ বা রেগুলেটরি এক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোথাও ইসলামী কোন উইং নেই।
মি. আমিন বলছিলেন, “ইসলামী ধারা ব্যাংকে লাভ বা ক্ষতির উপর মুনাফার অংশ হেরফের হতে পারে। আগে থেকে কোন কিছু নির্দিষ্ট থাকবে না। কিন্তু আমাদের দেশে ইসলামী ব্যাংকে আগে থেকেই জানা যায় রেট, যে আমানতকারী কত শতাংশ মুনাফা পাবে”।
কেন জনপ্রিয় হচ্ছে ইসলামী ধারার ব্যাংক
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে যেভাবে ইসলামী ব্যাংক পরিচালনা করা হয়ে থাকে সেটা উদ্বেগের।
বাংলাদেশে এগুলো যেভাবে পরিচালিত হয় সেখানে পূর্ণাঙ্গ ভাবে ইসলামী ধারায় পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে – বলছেন তারা।
আমাদের দেশের যারা ইসলামী চিন্তা ধারায় বিশ্বাস করেন, তাদের কাছ মনে হতে পারে ব্যাংকে টাকা রাখা হারাম।
তাসনিমা খান বলছিলেন “বেশির ভাগ মানুষের যে চিন্তাধারা সেটাতে তারা মনে করে এই টাকাটা বিনিয়োগ করা হচ্ছে এবং সেখান থেকে রিটার্ন পাচ্ছেন। অর্থাৎ তারা এটাকে গ্যাম্বলিং মনে করেন না। সেই অর্থটাকে তারা বৈধ হিসেবে মনে করে। “
:”এটাতে তাদের একটা স্বস্তির জায়গা তৈরি করে। এর ফলেই প্রচলিত ব্যাংকগুলো তাদের ইসলামী উইনডো ও শাখা রাখছে ইসলামী ব্যাংকের”।
বাংলাদেশে যে দশটি ইসলামী ব্যাংক রয়েছে
ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক। এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করেছে।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক নাম পরিবর্তন করে আজ থেকে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক করা হয়েছে।
নতুন বছরের শুরু থেকে পূর্ণাঙ্গ শরীয়াহভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করছে ব্যাংকটি।
পাশাপাশি ইসলামি ধারার সেবার জন্য প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ৮০টির মতো শাখা ও উইন্ডো রয়েছে।
আমরা আলোচনা হতে পরিস্কার দেখেছি যে ইসলামী ব্যাংক ‘মুদারাবা’ এবং ‘আল ওয়াদীয়াহ’ পদ্ধতিতে জনগণের নিকট হতে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে, যা সম্পূর্ণ শরীয়াহ মোতাবেক। এই তহবিল ইসলামী ব্যাংক বিনেয়োগকারীদের বিনিয়োগের জন্য প্রদান করে থাকে। এখন দেখতে হবে ইসলামী ব্যাংক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শরীয়াহ অনুসরণ করে কিনা? এক্ষেত্রে আলোচনায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটিড (IBBL) এর কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ ব্যাংকটি বাংলাদেশের প্রথম ইসলামী ব্যাংক, যা ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
(১) ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তি ছড়ান বিনিয়োগকারীরা। অবশ্য এই বিভ্রান্তি ছড়ানোর পিছনে অজ্ঞতা অনেকাংশে দায়ী রয়েছে। অনেকেই শতকরা হারকে সুদ মনে করেন। যেমন ইসলামী ব্যাংক বলল ১০% এবং অন্য ব্যাংক বলল ১০%। দুজনই শতকরা ১০ ভাগ এর কথা বলল। অতএব সোজা হিসাব দুজনেই সুদ খাচ্ছে! ধরুন একজন ১০০ টাকা দিয়ে বলল বছর শেষে আমাকে ১০ টাকা অতিরিক্তসহ ১১০ টাকা দিতে হবে। আর অন্যজন বলল, আমার এই ল্যাপটপটি এর ক্রয় মূল্য ১০০ টাকা। আপনি ১ বছর পর ১০% মুনাফা ধরে আমাকে দাম দেবেন ১১০ টাকা। বলুন-তো দুটিতে শতকরা ১০ টাকা অতিরিক্ত এসেছে। দুটিই কী সুদ? এজন্য আল্লাহপাক কোরআনে সূরা বাকারায় বলেছেন, “এরা বলে সুদ তো ব্যবসা-বাণিজ্যের মত। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।” রাসুল (সাঃ) হাদীস হতে স্পষ্ট যে সমজাতীয় পণ্যের ক্ষেত্রে কম-বেশি করা হলো সুদ। বিশেষ করে রাসুল (সাঃ) হাদীস “দুই সা (১ সা = ২ কেজি ৪০ গ্রাম হতে ৩ কেজি) মিশ্রিত খেজুরের বিনিময়ে এক সা উত্তম খেজুর ক্রয়-বিক্রয় করবে না। বরং মিশ্রিত খেজুর দিরহামের বিনিময়ে বিক্রয় করে দিরহাম দিয়ে উত্তম খেজুর ক্রয় করবে” (সহীহ বুখারী)। যদি রাসুল (সাঃ) এক সা উত্তম খেজুরে বিনিময়ে দুই সা মিশ্রিত খেজুর গ্রহণ করা বৈধ ঘোষণা করতেন, তবে একসময় ১০০ টাকা ঋণ দিয়ে ১১০ টাকা ফেরত আনা বৈধ হয়ে যেত, যা বর্তমান সুদী ব্যাংক করে থাকে।
রাসুল (সাঃ) এর হাদীস অনুযায়ী ইসলামী ব্যাংকসমূহ সরাসরি অর্থ ঋণ না দিয়ে ব্যাংক নিজে দ্রব্য ক্রয় করে এবং দ্রব্য মূল্যের সাথে মুনাফা যুক্ত করে গ্রাহকের কাছে বিক্রয় করে। প্রচলিত ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংকের এই কার্যক্রমের পার্থক্য যারা সাদা চোখে দেখেন, তারা তেমন কোন পার্থক্য খুঁজে পাবেন না। কিন্তু এই দুটি পদ্ধতির প্রয়োগ অর্থনীতিতে ভিন্ন ফলাফল নিয়ে আসে। এখানে প্রচলিত ব্যাংক গ্রাহককে ১০% সুদে নির্দিষ্ট মেয়াদে ১০০ টাকা প্রদান করে। গ্রাহক সেই ১০০ টাকা নিজের ভোগে ব্যয় করতে পারে অথবা অন্য যে কোন কাজে ব্যয় করতে পারে। কিন্তু মেয়াদ শেষে প্রচলিত সুদী ব্যাংককে ১১০ টাকা প্রদান করবে।
আবার ইসলামী ব্যাংক গ্রাহককে ১০০ টাকা নগদ না দিয়ে ১০০ টাকা দিয়ে একটি ল্যাপটপ ক্রয় করে গ্রাহকের নিকট ১১০ টাকায় বাকীতে বিক্রয় করে দিল। অর্থাৎ এখানে গ্রাহক কোন নগদ টাকা পেল না। সে পেল একটি ল্যাপটপ, যা তার ভবিষ্যত আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসাবে কাজ করছে। মেয়াদ শেষে গ্রাহক ইসলামী ব্যাংককে ১১০ টাকা প্রদান করল। এক্ষেত্রে দুটি ব্যাংকই অতিরিক্ত ১০ টাকা গ্রহণ করেছে।
কিন্তু একটি গ্রহণ করা হয়েছে নগদ টাকা প্রদানের মাধ্যমে এবং অপরটি গ্রহণ করা হয়েছে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে। ইসলামী শরীয়াহ একটিকে সুদ বলে নিষিদ্ধ করেছে এবং অন্যটিকে মুনাফা বলে বৈধ ঘোষণা করেছে। আর একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, নগদ টাকার প্রবাহ অপ্রয়োজনীয় ভোগের সৃষ্টি করে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ নীতিমালা অপ্রয়োজনীয় ভোগের সৃষ্টি করে না। তবে দুষ্ট লোকেরা বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগকে নগদে পরিণত করে, যার জন্য ব্যাংক দায়ী নয়। অবশ্য এ বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে।
(২) একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকের মুনাফার হার সুদী ব্যাংকের চেয়ে বেশি না কম সেটি এখানে আলোচনা করা হচ্ছে না। এখানে আলোচনা করা হচ্ছে কার্যক্রম শরীয়াহ ভিত্তিক কিনা ? যদি ইসলামী ব্যাংকের মুনাফার হার খুবই উচ্চ হয় তবে ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী এটি খুবই নিন্দনীয় কাজ হবে, কিন্তু হারাম নয়। তবে এতটুকু বলা যায়, ইসলামী ব্যাংকে তুলনামূলকভাবে মুনাফার হার কম হয়। তবে এই আলোচনা করতে হলে বিভিন্ন ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে।
(৩) ইসলামী ব্যাংক সবধরনের বিনিয়োগ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে না। আবার অংশগ্রহণ করলেও অতিরিক্ত প্রাপ্তির সবটুকু মুনাফায় অন্তর্ভূক্ত করতে পারে না। এই বিষয়টি পাঠকদের জানার প্রয়োজন রয়েছে। এই বিষয়টি জানতে পারলে সুদী ব্যাংকের সাথে ইসলামী ব্যাংকের পার্থক্য পাঠকদের চোখে ফুটে উঠবে।
(ক) বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে বাংলাদেশে ব্যাংকে প্রায় ১৮% অর্থ জমা রাখতে হয়। এর মধ্যে একটি অংশ ক্যাশ হিসাবে এবং বাকী টাকা বন্ডে রাখতে হয়। যেহেতু ইসলামী ব্যাংক শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক সেহেতু ইসলামী ব্যাংকসমূহ বাংলাদেশ ব্যাংকে বন্ডে টাকা জমা রাখে না। কারণ ইসলামী ব্যাংক বন্ড হতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রদত্ত সুদ গ্রহণ করে না।
তাই অন্যান্য সুদী ব্যাংক যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের বন্ডে টাকা রাখতে বাধ্য, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকসমূহকে বন্ডে টাকা রাখতে বাধ্য করে না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে সুদী ব্যাংকের বাধ্যতামূলক জমা প্রায় ১৮% হলেও ইসলামী ব্যাংকসমূহের বাধ্যতামূলক জমা হচ্ছে প্রায় ১২% বা ১৩%। যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকসমূহকে শরীয়াহভিত্তিক কার্যক্রমে সহযোগীতা করছে, সেখানে কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবি বলছেন, ‘ইসলামী ব্যাংক ঘুরিয়ে সুদ খায়’! এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ সরকার ইসলামী ব্যাংকিংকে সহযোগীতা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ইসলামী বন্ড চালু করার চেষ্টা করছে।
এরপরও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে ইসলামী ব্যাংকের কোন লেনদেনে সুদ থাকলে, ইসলামী ব্যাংক সেই সুদের অর্থ তাদের আয়ের সাথে যুক্ত না করে জনকল্যাণ তহবিলে পাঠিয়ে দেয়। তাই ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকরা নিশ্চিত থাকতে পারেন, তাদের মুনাফায় সুদ নেই, শেয়ার হোল্ডাররা নিশ্চিত থাকতে পারেন, তাদের ডিভিডেন্ডে সুদ নেই, ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিশ্চিত থাকতে পারেন, তাদের বেতন-ভাতায় সুদ নেই।
(খ) বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ধরনের ট্রেজারি বিল ও বন্ড আছে। বিভিন্ন সুদী ব্যাংকগুলো এ সমস্ত বন্ড এবং ট্রেজারি বিল ক্রয় করে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সরকারি বন্ড ও ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ একেবারেই ঝুঁকিমুক্ত ও খুব বেশি লাভজনক হওয়ায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ সমস্ত ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করছে। কিন্তু সুদ থাকার কারণে ইসলামী ব্যাংক এ সমস্ত বিনিয়োগে অংশগ্রহণ করতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ গ্রাহকের নিকট হতে ৯% এর অতিরিক্ত রাখতে পারবে না।
কিন্তু সেখানে বাংলাদেশ সরকারের স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিল ও বন্ডসমূহ ৯% এর বেশি সুদের হারে ক্রয়- বিক্রয় হচ্ছে। ফলে সুদী ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ঋণ প্রদানের চেয়ে সরকারি ট্রেজারি বিল বা বন্ডে বিনিয়োগ করাকে লাভজনক এবং নিরাপদ মনে করছে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক সুদের কারণে এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে না।
(গ) ইসলামী ব্যাংক কলমানি মার্কেটে বিনিয়োগ করতে পারে না। কলমানি মার্কেটে ব্যাংকসমূহ তাদের স্বল্পকালীন তারল্য ঘাটতি মেটানোর জন্য যাদের তারল্য বেশি, তাদের নিকট হতে স্বল্প সময়ের জন্য নির্দিষ্ট সুদে ঋণ গ্রহণ করে থাকে। ইসলামী ব্যাংকে (IBBL) সবচেয়ে বেশি তারল্য রয়েছে। আর কলমানি মার্কেটে ঋণ প্রদান করে স্বল্প সময়ে সুদের ভিত্তিতে খুব সহজেই অতিরিক্ত প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু ইসলামী শরীয়াহ সুদ নিষিদ্ধ করায় ইসলামী ব্যাংক কলমানি মার্কেটে অংশগ্রহণ করতে পারে না।
(ঘ) সুদী ব্যাংকের আয়ের অন্যতম উৎস হলো সি সি লোন (ক্রেডিট সিলিং)। ব্যাংক আপনার কোন সম্পদ জামানত রেখে একটি নতুন ঋণ একাউন্ট খুলে ৫০ লক্ষ (ধরে নেয়া হলো) টাকা প্রদান করল। আপনি এই একাউন্ট হতে সর্বোচ্চ ৫০ লক্ষ টাকা উঠাতে পারবেন। আপনি যে পরিমাণ অর্থ উঠাবেন এবং যতদিন পর্যন্ত হাতে রাখবেন, ততদিন এর সুদ প্রদান করতে হবে।
যেমন আপনি ২৫ লক্ষ টাকা ২০ দিনের জন্য উঠালেন। আপনাকে ২০ দিনের সুদ প্রদান করতে হবে। নির্দিষ্ট সমসয়ের মধ্যে সুদ প্রদান করতে না পারলে চক্রবৃদ্ধি হবে এবং ঋণ এবং সুদের পরিমাণ উভয়ই বৃদ্ধি পাবে। সি সি লোন সুদী ব্যাংকের জন্য খুবই লাভজনক। কারণ একাউন্টে ৫০ লক্ষ টাকা থাকলে মানুষের ব্যয় প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ফলে মানুষ অপ্রয়োজনীয় কাজের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় করতে পারে। উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় না করার কারণে সিসি লোনের টাকা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে এবং একসময় গ্রাহক ব্যাংকে রাখা তার জামানত হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক সুদ ভিত্তিক সি সি লোন এ বিনিয়োগ করতে পারে না। ফলে ইসলামী অর্থনীতিতে অপ্রয়োজনীয় ঋণের পরিমাণ হ্রাস পাবে।
(ঙ) গ্রাহক সময়মত অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে প্রত্যেকটি ব্যাংক গ্রাহককে জরিমানা করে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে সুদী ব্যাংকে জরিমানার অর্থ আসলে (মূলধন) যুক্ত হয়ে চক্রবৃৃদ্ধি হারে কাজ করে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকে চক্রবৃদ্ধি হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আবার জরিমানার অর্থ ইসলামী শরীয়াহ এর দৃষ্টিকোণ হতে সন্দেহযুক্ত অর্থ হিসেবে গণ্য হয়।
তাই জরিমানার অর্থ ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয়িত হয় না, শেয়ার হোল্ডার এবং ব্যাংকে অর্থ জমাকারীদের মুনাফায় যুক্ত হয় না। তাহলে জরিমানার অর্থ যায় কোথায় ? প্রতিটি ইসলামী ব্যাংকে একটি জনকল্যাণমূলক তহবিল আছে। এই তহবিলে জরিমানার অর্থসহ সন্দেহযুক্ত অর্থ প্রদান করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রা হতে প্রাপ্ত সুদও এই তহবিলে যুক্ত হয়। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো যে, ইসলামী ব্যাংকের এই কার্যক্রম তাদের অনেক গ্রাহকই জানেন না। তাই অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত সুদী ব্যাংকের সাথে ইসলামী ব্যাংকের পার্থক্য নির্ধারণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
(চ) ইসলামী ব্যাংক তার সম্পদ হতে যাকাত আদায় করে। তবে আমানতকারীদের সুষ্পষ্ট নির্দেশনা ছাড়া তাদের একাউন্ট হতে যাকাত আদায় করা হয় না।
(ছ) ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী যে সমস্ত ব্যবসা বৈধ নয়, সে সমস্ত ব্যাবসায় ইসলামী ব্যাংক বিনিয়োগ করতে পারে না।
(জ) ইসলামী ব্যাংক মুনাফা ছাড়াই গ্রাহকদের ঋণ (কর্জ) প্রদান করে থাকে। ২০১৯ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (IBBL) কোন ধরনের মুনাফা গ্রহণ ব্যতীত প্রায় ৩ হাজার ৩ শত ৫০ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করেছে (Annual Report -2019, Page-49)। সাধারণত গ্রাহকরা তাদের মেয়াদী আমানতের বিপরীতে এবং গ্রামীণ প্রকল্পের গ্রাহকরা নলকূপ, স্যানিটারি সিষ্টেম এর জন্য এ ধরনের ঋণ পায়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কিছু ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকদের যে ঋণ (কর্জ) প্রদান করে, সেখানে অতিরিক্ত ৩% গ্রহণ করে থাকে। এই অতিরিক্ত ৩% এর কোন শরীয়াহভিত্তিক ব্যাখ্যা নেই, বরং এটি সুদ হবে।
(৪) বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ কার্যক্রম ১০০% শরীয়াহ ভিত্তিক, এটি তারা নিজেরাই দাবী করে না। এজন্যই ইসলামী ব্যাংকসমূহে ‘জনকল্যাণমূলক তহবিল’ রাখা হয়েছে, যেখানে সন্দেহযুক্ত লেনদেনের অর্থ এবং শরীয়াহভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংক কর্মকর্তাদের দূর্বলতা এবং গ্রাহকের ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকার কারণে শরীয়াহ অডিট কর্তৃক প্রশ্নবিদ্ধ লেনদেনের অর্থ জমা হয়, যা ব্যাংকের আয় বা মুনাফায় আসে না। ইসলামী ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালিত করতে হলে ব্যাংক কর্মকর্তাকে যেমন শরীয়াহ আইন জানতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে গ্রাহককেও শরীয়াহ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তা না হলে ইসলামী ব্যাংকিং এবং সুদী ব্যাংকিং এর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না।
প্রশ্ন ও মতামত জানাতে পারেন আমাদের কে ইমেল : info@banglanewsexpress.com
আমরা আছি নিচের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুলোতে ও
- বিনিয়োগ ব্যাংকের ট্রেডিং ব্যবস্থা আলোচনা করো
- খিলাফত রাষ্ট্র ও আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র পার্থক্য । খিলাফত রাষ্ট্র vs আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র পার্থক্য
- What do you near by Business communication?, Explain the concept of business communication
- Describe the barriers to effective communication in business organization
- সমাজদর্শন ও রাষ্ট্র দর্শনের সম্পর্ক, সমাজদর্শ ও রাষ্ট্রদর্শনের সম্পর্ক, Relation between Social Philosophy & Political Philosophy
- দর্শনের বিষয়বস্তুকে প্রধানত কয় ভাগে ভাগ করা যায়?, দর্শনের বিষয়বস্তু হিসেবে অধিবিদ্যা আলোচনা করুন।