ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ক্রমবিকাশে সিপাহি বিদ্রোহের প্রভাব আলোচনা কর, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ বা বিপ্লব

ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ক্রমবিকাশে সিপাহি বিদ্রোহের প্রভাব আলোচনা কর, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ বা বিপ্লব


ভূমিকা : বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কসের দৃষ্টিতে সিপাহি যুদ্ধ ছিল প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। আর ইংরেজ ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে তা ছিল অনুন্নত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতের উন্নয়নে দ্রুপদী সভ্যতার অধিনায়ক ইংল্যান্ডের হস্তক্ষেপের ফলে রক্ষণশীল সমাজের বিদ্রোহ। বিতর্কিত বহুল আলোচিত ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি যুদ্ধ কেবলমাত্র ক্ষণকালের মধ্যে উত্থিত অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ নয় বরং শাসন ও শোষণের বলয়ে সৃষ্ট বিক্ষুদ্ধ ধাক্কা প্রলয়ংকরী আত্মপ্রকাশ।

R. C. মজুমদার সিপাহি যুদ্ধকে তুলে ধরেছেন, “The outbreak of 1857 world surely go down in history as the first great and direct challenge to the British rule in India on an extensive scale.” (The Sepoy Mutiny and Revolt of 1857 Page No-278) সিপাহি বিদ্রোহের পটভূমি : অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, সামাজিকভাবে অবমূল্যায়ন, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ভারতীয়দের ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাধ্য করে। 

জনগণের এ ফুঁসে উঠা ক্ষোভ যুদ্ধে রূপ নেয়। অনেকে এ যুদ্ধকে সিপাহি বিদ্রোহ, অনেকে শ্রেণী চরিত্রহীন জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ, অনেকে সিপাহি যুদ্ধ, আবার অনেকে একে (শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ) শ্রেণী যুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। পলাশী যুদ্ধের ফলে ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই এ যুদ্ধের পটভূমি তৈরি হতে শুরু করেছিল। ইংরেজ শাসন ভারতীয়রা কোনভাবেই বরদাস্ত করতে পারে নি। দূরদর্শী মেটকাফের বর্ণনায় আমরা এর স্পষ্ট প্রমাণ পাই। তিনি ১৮১৪ সালে লিখেছেন, “ভারত বটে আমাদের অবস্থা সবসময় ………। 

আমাদের এ দেশে শিকড় নেই। ঝড় এলে এখনই উড়িয়ে নিবে।” ১৮২০ সালে পিজারি ও মারাঠাদের পরাজয়ের পর তিনি লিখেছেন, “আমরা কি কখনো এদেশের লোকদেরকে আমাদের শাসনের অনুরাগী করতে পারবা উচ্চ শ্রেণীর স্বার্থের সাথে আমাদের স্বার্থ জড়িত করলে কি পাব? এর জবাব হল, না।” সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, নানান কারণে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে যে বিক্ষোভ ছিল তারই স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ১৮৫৭ সালের সিপাহি যুদ্ধ। সিপাহি যুদ্ধের পটভূমি সৃষ্টি হওয়ার পশ্চাতে রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সামরিক কারণগুলো দায়ী ছিল ।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ক্রমবিকাশে সিপাহি বিদ্রোহের প্রভাব : ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এ বিদ্রোহ এক সুদূরপ্রসারী ফল বহন করে নিয়ে আসে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ক্রমবিকাশে সিপাহি বিদ্রোহ এক যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। ‘Advance History of India’ এর লেখকদের মতে, “একাধিক কারণে বিপ্লব ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি যুগসন্ধিক্ষণের সূচনা করে।” 

নিম্নে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ক্রমবিকাশে সিপাহি বিদ্রোহের প্রভাব আলোচনা করা হল :

১. ব্রিটিশ সরকারের কর্তৃত্ব ও কোম্পানি শাসনের অবসান : সিপাহি বিদ্রোহ ভারতের রাষ্ট্র পরিচালকদের শাসন নীতি বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। স্বাধীনতা আন্দোলনের ফলে প্রতীয়মান হয় যে, ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ছিল খুবই দুর্বল। লন্ডনে ব্রিটিশ সরকার ও পার্লামেন্ট উপলব্ধি করে যে, ভারতবর্ষের মত বৃহৎ উপমহাদেশের শাসন একটি বাণিজ্যিক কোম্পানির উপর ন্যস্ত করা যুক্তিসম্মত নয়। এ কারণে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২ আগস্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতবর্ষের উন্নততর শাসনব্যবস্থা বা ‘At for the Better Government of India’ বিধান প্রণয়ন করে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করে। ভারতের বড় লাট ‘Govorn General Viceroy’ নামে অভিহিত হন। ভারতবর্ষের শাসন পরিচালনার জন্য একজন মন্ত্রী ভারত সচিব নিযুক্ত হলেন এবং তিনি ১৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত একটি কাউন্সিলের সাহায্যে ভারতের শাসনকার্য পরিচালনা করবেন এরূপ স্থির হয়। লর্ড ক্যানিং সর্বপ্রথম ভাইসর অর্থাৎ, রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত হন। এ ক্ষমতা হস্তান্তরকে Cuninghum’ বাস্তব পরিবর্তন অপেক্ষা আনুষ্ঠানিক মাত্র বলে বর্ণনা করেন। Cuninghum এর এ মন্তব্য খুবই সত্য। কেননা পিটের India Act বা ভারত আইন (১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে) চালু হওয়ার সময় হতে ভারত সম্পর্কিত সকল ক্ষমতা Board of controll এর সভাপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল এবং Director এর সভার ক্ষমতা ও দায়িত্ব বহুক্ষেত্রে হ্রাস করা হয়েছিল। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন পাস করা হলে কোম্পানির সিভিল প্রতিযোগিতামূলক করা হয়েছিল এবং এর ফলে Director এর সভার পৃষ্ঠপোষকতার অবসান হয়েছিল। এ আইনের দ্বারা Director দের সংখ্যা ২৩ হতে ১৮ করা হয়েছিল এবং এ ১৮ জনের মধ্যে ৬ জন ছিলেন ইংল্যান্ডের মনোনীত ব্যক্তি ।

২. রাজনৈতিক সচেতনতা : স্বাধীনতা আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে যে যুদ্ধ আরম্ভ হয় তা ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবাসীর স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। স্বাধীনতা আন্দোলনের আরম্ভ হতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি মুসলমানদের সুনজরে দেখে নি এবং তারা এজন্য মুসলমানদের দায়ী করে। এর ফলে মুসলমানদের উপর অবধি নির্যাতন ও অমানুষিক অত্যাচার চলতে থাকে। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ‘আম্বালা বিচার’, ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ‘মালদহ ও

রাজমহল বিচার’ এবং ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ‘পাটনা বিচারে’ ইংরেজ সরকার বহু মুসলমান রাজদ্রোহীকে যাবজ্জীবন কারাবাস ও দীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিত করে। রায় চৌধুরী, দত্ত ও মজুমদার বলেছেন, “One direct effect of the Mutiny is clearly seen in the birth and rise of extormism in Indian politics.” এ স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতবর্ষের দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ ও বিদ্বেষ তীব্রতর করে। এর ফলে ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভব হয়। এ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে পরবর্তী পর্যায়ে ভারতবর্ষ দুটি স্বাধীন রাজ্য হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান নামে বিভক্ত হয়ে যায়। অবশ্য এ আন্দোলনের মূলে সৈয়দ আহম্মদ খানের আলীগড় আন্দোলন, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা ও পাকিস্তান আন্দোলন বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অতএব এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ক্রমবিকাশে সিপাহি বিদ্রোহের প্রভাব অপরিসীম।

৩. মহিমান্বিত অধ্যায় : সিপাহি বিদ্রোহ ভারতের জাতীয়তাবাদের ক্রমবিকাশে এক মহিমান্বিত অধ্যায়। যদিও সনাতন পদ্ধতি ও চিরাচরিত নেতৃত্বের পরিচালনায় এ বিদ্রোহ ঘটেছিল, তথাপি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের এটিই হল প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। সিপাহি বিদ্রোহ আধুনিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা করে। এ বিদ্রোহের আদর্শ ও পরিকল্পনা পরবর্তীকালের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। বিদ্রোহী নেতা ও নেতাদের বীরত্ব, অদম্য সাহসিকতা ও দেশপ্রেম ভারতবাসীর মনে গভীর দাগ কেটেছিল এবং তাদের বীরত্বের কাহিনী আজও ভারতবাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকে।

সিপাহি বিদ্রোহের প্রভাব সম্পর্কে Sir Lepel Giriffen বলেছেন, “The Revolt of 1857 swept the Indian sky clear of many Clouels.” প্রকৃতপক্ষে, এ বিদ্রোহের ফলে বহু অনিশ্চয়তার অবসান হয় এবং ভারতের শাসনব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন ঘটে। গ্রিফিনের বক্তব্য মতে, “১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ পূর্ব ভারতের পক্ষে মঙ্গলময় এরূপ ঘটনা কখনও ঘটে নি।” সিপাহি বিদ্রোহের সৈনিকদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা সত্ত্বেও বিদেশী শাসন হতে দেশবাসীকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা ছিল তাদের দেশপ্রেম ও গতিশীলতার পরিচায়ক। তাই এ কারণে ১৮৫৭ সালের অভ্যুত্থানকে কোনক্রমেই ঐতিহাসিক বিপর্যয় বলে অভিহিত করা যায় না। ব্যর্থ হলেও এ অভ্যুত্থান এক মহান উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করে। তাই এ প্রসঙ্গে Bipan Chandra বলেছেন, “If the importance of a historical event is not limited it immediate achievements, the revolt of 1857 was not a pure historical tragedy. Even in failure it served grand purpose.” (India Struggle for Independance – Page No – 40)

৪. সেনাবাহিনী পুনর্গঠন : স্বাধীনতা সংগ্রামের অব্যবহিত পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন করা হয়। ব্রিটিশ সামরিক সংগঠনে বিভেদ এবং সমতার নীতি বিশেষভাবে কার্যকর করা হয়। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি বাহিনী পৃথক রাখা হয়। বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া ছিল বিবিধ। ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সিপাহিদের উপর আস্থা রাখতে ব্যর্থ হন এবং সেনাবাহিনীতে ইউরোপীয় সৈন্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় সৈন্য সংগঠন কমিশন মন্তব্য করেছেন যে, বিপ্লবের ফলস্বরূপ উদ্ভূত সমস্যা হতে দুটি নীতি পালনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। প্রথমত, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং সংরক্ষণ। দ্বিতীয়ত, গোলন্দাজ বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ ইউরোপীয়দের হাতে অর্পণ করা।

৫. সামাজিক অগ্রগতি : বিদ্রোহ দমনের পর ভারতের সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। এ প্রসঙ্গে H. P. Chaltterjee বলেছেন, “The sepoy Mutiny was a revolt of the old against the new.” প্রকৃতপক্ষে, ভারতবাসীর কুসংস্কারের উপর বিদ্রোহ চরম আঘাত হানে এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভারতীয় সমাজের পুনর্গঠন কার্য শুরু হয়। হিন্দুরা পাশ্চাত্য সাহিত্য ও বিজ্ঞান সর্বান্তকরণে গ্রহণ করে আধুনিকতার পথে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু ভারতীয় মুসলমানরা পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শিক্ষা সর্বতোভাবে বর্জন করে ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে থাকে ।

৬. মুঘল সাম্রাজ্যের পতন : সিপাহি বিদ্রোহের ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ বন্দি হয়ে রেঙ্গুনে প্রেরিত হলে এবং তাঁর পুত্র ও পৌত্রদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এভাবে নাম সর্বস্ব মুঘল শাসনের পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে। ব্রিটিশপন্থি ছিলেন না এমন সর্বশেষ ব্যক্তি, যিনি সমগ্র ভারত শাসন করার ঐতিহাসিক দাবি: ঘোষণা করতে পারেন, তাকে দৃশ্যপট হতে অপসারণ করা হয়।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমরা বলতে পারি যে, ইংরেজদের অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, সামাজিক ও ধর্মীয় অবক্ষয় মানুষদেরকে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে চরম ভাবাপন্ন করে তোলে । মানুষ এসব দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায়; যা স্পষ্ট ফুটে উঠে সিপাহি যুদ্ধের মাধ্যমে। অতএব, আমরা একে প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম বলতে পারি। যদিও বিভিন্ন সমস্যার কারণে সফল স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নিতে পারে নি। তবে প্রকৃতপক্ষে এ বিদ্রোহের ফলে বহু অনিশ্চয়তার অবসান হয় এবং ভারতের শাসনব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ক্রমবিকাশে সিপাহি বিদ্রোহের ব্যাপক প্রভাব আছে।

Leave a Comment