“ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আবরণে একটি আর্থসামাজিক আন্দোলন”– উক্তিটি মূল্যায়ন কর

“ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আবরণে একটি আর্থসামাজিক আন্দোলন”– উক্তিটি মূল্যায়ন কর

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভাষা আন্দোলনই বাঙালি জাতীয়তাবাদ উন্মেষের ভিত্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম ধাপ।

ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আবরণে একটি আর্থসামাজিক আন্দোলন। এ আন্দোলন থেকেই বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং এর অনিবার্য চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম লাভ করে ।


ভাষা আন্দোলন : পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানি কুচক্রী মহল বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়য শুরু করে। কিন্তু বাঙালি জনগণ বিশেষ করে ভাষাপ্রেমিক নাগরিক এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনই ‘ভাষা আন্দোলন’ নামে পরিচিত।


ভাষা আন্দোলনের পটভূমি : ১৯৪৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ১৯৪৮ সালের সংগ্রাম পরিষদের ঘোষিত প্রতিবাদ দিবসে এ আন্দোলন প্রচণ্ড রূপ নেয় এবং ক্রমান্বয়ে তা বৈপ্লবিক আকার ধারণ করে। মূলত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষিত “একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা” এ বক্তব্যের কারণেই আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়ে উঠে।


পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অত্যন্ত সুকৌশলে একটিমাত্র রাষ্ট্র ভাষার মাধ্যমে পাকিস্তানি জাতিসত্তাকে সুদৃঢ় করার অজুহাতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে। পাকিস্তানের জনসাধারণের শতকরা ৫৬ ভাগের ভাষা ছিল বাংলা। তাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও রীতিনীতি অনুযায়ী বাংলা ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত ছিল। অথচ শতকরা মাত্র আটজনের ভাষা উর্দুকে বাঙালির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাদের নিজস্ব জাতিসত্তা বিকাশের পথ রুদ্ধ করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে । শুরু হয় মাতৃভাষার অধিকার আদায় ও বাঙালি জাতির জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে।

বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষার অধিকার স্বীকৃত হয়। এটাই ছিল বাঙালি জাতির প্রথম রাজনৈতিক বিজয়। নিম্নে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন বিবরণ দেওয়া হল :


সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আবরণে আর্থসামাজিক আন্দোলন : স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষা আন্দোলন শুধুমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনই নয়, ভাষা আন্দোলনের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যও যথেষ্ট। ভাষা আন্দোলনই বাঙালির প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলন, যার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী প্রেরণা বাঙালি জাতিকে ভাষা আন্দোলনোত্তর বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন ও সর্বোপরি স্বাধীনতা যুদ্ধের পথ নির্দেশ করে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হল ঃ


১. রাজনৈতিক বিবর্তন : ভাষা আন্দোলনের কারণেই বাঙালি জাতি ‘অধিকার সচেতন ও আত্মসচেতন হয়ে উঠে এবং একের পর এক দাবি আদায়ের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়। এ আন্দোলনের পথ ধরেই ছাত্রদের ১১ দফা, শেখ মুজিবের ছয় দফা ও ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়। এক পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানের সূত্র ধরে ‘৭১ সালের স্বাধীনতার পথ সুগম হয়।


১৯৫৪ সালে বাঙালি জাতি যুক্তফ্রন্টের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ৯৭% ভোট পেয়ে মোট ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৮টি আসন লাভ করে। এ নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভের পর ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৬৮-৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পেছনেও বাঙালির স্বাধীনতার দাবিই ছিল মুখ্য। ১৯৭০ সালের আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয় থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, বাঙালিরা পাকিস্তান শাসন হতে মুক্ত হয়ে নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়তে চায় এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা লাভ করে।


২. সামাজিক সচেতনতা : যদি ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বিজয় সম্ভব না হতো তাহলে হয়তোবা জাতীয়তাবোধের বিকাশ সম্ভব হতো না। জাতীয়তাবোধের বিকাশে ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এক মাইলফলক। এর প্রমাণ হল ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম।


আরো ও সাজেশন:-

৩. অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন : ১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষার অধিকার পাওয়া সম্ভব হয় তখন এ বলে বলীয়ান হয়ে পরবর্তীতে বাঙালিরা অধিকার সচেতন হয়ে উঠে। যার চূড়ান্ত পরিণতি হল স্বাধীনতা লাভ।


৪. ভাষা আন্দোলন ও অর্থনৈতিক সচেতনতা : খুব বেশি জোর দিয়ে যদি বলতে হয় তাহলে বলতে হবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনই স্বাধীনতা লাভের অন্যতম হাতিয়ার। কেননা এ আন্দোলনের ফলেই বাঙালি জাতি অধিকার সচেতন ও আত্মসচেতন হয়, বিভিন্ন ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে পারে, জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৬৬, ১৯৬৮-৬৯ ও ১৯৭০ এর আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে এবং অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করে।

আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : শত ভাষ দিয়ে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও শোষক এবং তাঁদের তরি বাহকদের বিরুদ্ধে বাঙালি মনের বিদ্রে প্রকাশ পায়। এ আন্দোলনে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সংঘবদ্ধ হয় এবং ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়ে আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ক্রমাগত আন্দোলন বাঙালিদের জন্য নিয়ে আসে সার্থক সংগ্রামের আস্বাদ। ঢাকার শহীদ মিনার তাই বাংলাদেশের জনগণের এক তীর্থস্থান।


ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই পূর্ব বাংলার জনগণ সর্বপ্রথম অধিকার । পূর্ব পাকিস্তানিরা যে পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে স্বতন্ত্র এবং তাদের দাবি যে স্বতন্ত্র খাতে প্রবাহিত হতে পারে এ শিক্ষা ভাষা আন্দোলন থেকে আহরিত হয়।

[ বি:দ্র: উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)]

ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার জনগণকে সর্বপ্রথম সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে। জ্ঞান ব্যতীত কে দাবি আদায় যে সম্ভব নয় এবং স্বৈরচারী সরকার শুধু যে সংগ্রামের ভাষা অনুধাবন করে তা এ আন্দোলনের ফল তাই দেখা যায় যে, ভাষা আন্দোলনের নেতৃবর্গই কালক্রমে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীতে রূপান্তরিত হন।

এ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শ্রেণীর জনসাধারণ কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, বুদ্ধিজীবী একই পঙতিতে দণ্ডায়মান হন এবং এ আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের (Linguistic Nationalism) জন হয়। এ জাতীয়তাবাদই বহু চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে একাত্তরের রক্তঝরা দিনগুলোতে পূর্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদের রূপ লাভ করে। এছাড়া ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রভাবশালী ভূমিকার সূচনা করে।


উপসংহার : ভাষা আন্দোলন পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে এক নতুন জাতীয় চেতনার উল্লেখ ঘটায়। এ চে ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটায়। ভাষা আন্দোলনই বাঙালিদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত করে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলাদেশের গণচেতনার প্রথম সুসংগঠিত বহিঃপ্রকাশ।

ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিদের মনে এক সংগ্রামী চেতনা ও ঐক্যের সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীতে শাসকচক্রের বিরুদ্ধে সকল আন্দোলনে অনুপ্রেরণা ও প্রাণশক্তি যোগায়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এলিটের মধ্যে এক প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বের সূচনা ঘটায়, জাতীয়তাবাদী শক্তি এতে ক্রমশ সংহত হতে থাকে এবং পূর্বাঞ্চলের জনগণের মধ্যে ঐক্য পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশি বৃদ্ধি পায় ও শক্তিশালী হয়।

আপনার জন্য আমাদের ক্যাটাগরি


প্রশ্ন সমাধান
সাজেশন
চাকরি
ধর্ম
মতামত
শিক্ষা
শিক্ষা সংবাদ
নিয়োগ পরীক্ষা
জানা অজানা
Writing Side
অনার্স ও মাস্টার্স
এইচ এস সি
এসএসসি
ডিগ্রি ও উন্মুক্ত
স্বাস্থ্য
উদ্ভিদ ও প্রাণী
ঔষধি গুন
গোপন সমস্যা
রূপচর্চা
রেসিপি
রোগ প্রতিরোধ
রচনা ,প্রবন্ধউত্তর লিংক ভাবসম্প্রসারণউত্তর লিংক Paragraphউত্তর লিংক
আবেদন পত্র ও Applicationউত্তর লিংক অনুচ্ছেদ রচনাউত্তর লিংক Compositionউত্তর লিংক
চিঠি Letterউত্তর লিংক প্রতিবেদনউত্তর লিংক CVউত্তর লিংক
ইমেলEmailউত্তর লিংক সারাংশ ও সারমর্মউত্তর লিংক Seen, Unseenউত্তর লিংক
Essayউত্তর লিংকCompleting Storyউত্তর লিংকDialog/সংলাপউত্তর লিংক
অনুবাদউত্তর লিংকShort Stories/Poems/খুদেগল্পউত্তর লিংকSentence Writingউত্তর লিংক

প্রশ্ন ও মতামত জানাতে পারেন আমাদের কে ইমেল : info@banglanewsexpress.com

আমরা আছি নিচের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুলোতে ও

Leave a Comment