যে কারণে ক্ষতি হয় রেটিনার, কীভাবে বুঝবেন চোখের রেটিনায় সমস্যা?, চোখের রেটিনা নষ্টের কারণ যখন সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি

বিষয়:যে কারণে ক্ষতি হয় রেটিনার, কীভাবে বুঝবেন চোখের রেটিনায় সমস্যা?, চোখের রেটিনা নষ্টের কারণ যখন সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি

দ্য ওয়াল ব্যুরো: করোনার মধ্যেই আতঙ্কের আর এক কারণ হয়ে উঠেছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। মহারাষ্ট্র, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা সহ অনেক রাজ্যেই করোনা সারিয়ে ওঠা রোগীদের মধ্যে কালো ছত্রাকের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত কোমর্বিডিটির রোগীরাই এই সংক্রমণের শিকার। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। কালো ছত্রাকের রোগ সংক্রমিত করছে ফুসফুস, মস্তিষ্ক, চোখ, নাক-গলা সহ শরীরে নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে। তার মধ্যেই চোখের সংক্রমণ মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে কিছু রোগীর।

দিশা আই হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডক্টর দেবাশিস ভট্টাচার্য বলছেন, ঝাড়খণ্ড ও বিহারের চারজন রোগীর চোখে রেটিনার সংক্রমণজনিত অসুখ ধরা পড়েছে। তাঁদের চিকিৎসা চলছে। এই রোগীদের চোখে রক্ত জমেছে, চোখ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে, অনবরত জল পড়ছে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, চার জনেরই চোখে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ হয়েছে। আর সেই কারণে রেটিনা ক্ষতিগ্রস্থ। ডক্টর ভট্টাচার্য বলছেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণে রেটিনায় যে রোগ দেখা দিচ্ছে তার নাম ‘সেন্ট্রাল রেটিনাল আর্টারি অক্লুশন’ (CRAO) । এই রোগে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসে। অসুখ গুরুতর পর্যায়ে গেলে অন্ধও হয়ে যেতে পারে রোগী।

ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ কী? কাদের এই রোগ হচ্ছে?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হচ্ছে মিউকরমাইসিটিস গোত্রের কিছু ছত্রাক প্রজাতি যারা মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। এই ছত্রাকের সংক্রমণে যে রোগ হয় তার নাম মিউকরমাইকোসিস (Mucormycosis)। পচে যাওয়া গাছের পাতা, নোংরা-আবর্জনা, প্রাণীর মৃতদেহ বা মলমূত্র ইত্যাদি থেকে এই ছত্রাক জন্ম নেয়। এদের রেণু বাতাসে মিশে ভেসে বেড়ায়। শ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকে গেলে দেহকোষগুলিকে সংক্রামিত করে। নাক, মুখ, ত্বকের ছিদ্র দিয়েও সহজে ঢুকে পড়ে মানুষের শরীরে। শরীর যদি দুর্বল হয় ও রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমে আসে তাহলে এই ছত্রাকের রেণু শরীরে ঢুকলে তা মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। মূলত ফুসফুস, চোখ, কিডনি ও মস্তিষ্কে সংক্রমণ ছড়ায় এই ছত্রাক। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। সঠিক সময় চিকিৎসা না হলে রোগ প্রাণঘাতীও হতে পারে।

ডাক্তারবাবু বলছেন, এইচআইভি-র রোগী, ডায়াবেটিস মেলিটাস, ক্যানসার, কিডনির রোগে আক্রান্তদের এই ছত্রাকজনিত সংক্রমণের শঙ্কা বেশি। অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছে যাদের তেমন রোগী, দীর্ঘদিন সিরোসিসে ভুগছেন এমন রোগী, অপুষ্টিতে ভোগা রোগীদের মিউকরমাইকোসিসের সম্ভাবনা প্রবল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে ডায়াবেটিস রয়েছে এমন করোনা রোগী যাঁদের স্টেরয়েড, টোসিলিজুমাব ওষুধ দেওয়া হয়েছে বা প্লাজমা থেরাপি, অক্সিজেন থেরাপি হয়েছে, তাঁদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। দিশা আই হাসপাতালের বিভিন্ন শাখায় যে চারজন রোগীর চিকিৎসা চলছে দু’জনের ডায়াবেটিস আছে, একজনের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে। কারও স্টেরয়েড থেরাপি হয়নি, তবে একজনের অক্সিজেন থেরাপি হয়েছে। এই চার রোগীরই চোখে ‘সেন্ট্রাল রেটিনাল আর্টারি অক্লুশন’ রোগ ধরা পড়েছে।

রেটিনার কী অসুখ নিয়ে চিহ্নিত ডাক্তাররা?
চোখের রেটিনার মাধ্যমে ভিসুয়াল ইনফর্মেশন অপটিক নার্ভে গিয়ে পৌঁছয়। রক্তে সুগার বাড়লে রেটিনার সরু রক্তজালক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অনেক সময় সেই সরু রক্তজালক চিরে যায়। সেক্ষেত্রে রেটিনা থেকে তরল লিক করে কোষ ফুলে ওঠে, যাকে বলে রেটিনোপ্যাথি। ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণে রেটিনায় রক্তবাহী সরু রক্তজালকের মধ্যে ক্লট হয়ে যায়। রক্ত জমাট বেঁধে শিরা ফুলে ওঠে। তখন চোখে ব্যথা হয়, লাল হয়ে চোখ ফুলে যায়, জল পড়তে শুরু করে। এই রোগের নাম ‘সেন্ট্রাল রেটিনাল আর্টারি অক্লুশন’।

ডাক্তারবাবু বলছেন, রেটিনার সরু রক্তজালকে যদি রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে এবং সেটা মস্তিষ্কে চলে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রোক হবে। ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগীদের এই অসুখের ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে এর বাইরেও নানা কারণে রেটিনার এমন রোগ হতে পারে। যেমন ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণে এখন দেখা যাচ্ছে। ‘সেন্ট্রাল রেটিনাল আর্টারি অক্লুশন’ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে রোগীর দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি চলে যেতে পারে। অথবা দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যেতে পারে। গোড়া থেকে চিকিৎসা না করলে তখন রোগ সারানো মুশকিল হয়ে পড়ে।

বর্ষায় ঘরে ঘরে কনজাংটিভাইটিসে ভুগছে বাচ্চারা, কী করে সাবধান…

চড়া রোদে সোলার রেটিনোপ্যাথির ঝুঁকি বাড়ে, এই গরমে চোখ ভাল রাখার…

কী কী লক্ষণ দেখা দিতে পারে?
চোখে যন্ত্রণা, চোখ ফুলে লাল হয়ে যাওয়া, ক্রমাগত জল পড়তে থাকা।

মুখের এক পাশের পেশিতে ব্যথা।

অনেকেরই মিউকরমাইকোসিস হলে নাকের ওপরে কালচে ছোপ পড়ে, র‍্যাশ হতেও দেখা যায়।

কালো ছত্রাকের সংক্রমণের অন্যান্য উপসর্গগুলির মধ্যে আছে–জ্বর, শুকনো কাশি, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ঘন ঘন বমি হওয়া, রোগ বাড়াবাড়ি বলে রক্তবমি হতে পারে, দাঁত আলগা হয়ে আসতে পারে, মাড়িতে সংক্রমণ, মানসিক স্থিতি বিগড়ে যাওয়া ইত্যাদি।

সুরক্ষিত থাকতে কী করবেন?
করোনার সময় ডায়াবেটিসের রোগীরা বেটাডিন ০.২% মাউথওয়াশ ব্যবহার করুন। মুখের ভেতরে যাতে সংক্রমণ না ছড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

অক্সিজেন থেরাপির সময় পরিচ্ছন্ন, স্টেরিলাইজ করা জল ব্যবহার করতে হবে, সাধারণ কলের জল নয়।

রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। হাইপারগ্লাইসেমিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার।

কোভিড সেরে গেলেও গ্লুকোজ লেভেল নিয়মিত চেক করতে হবে।

স্টেরয়েডের ব্যবহার কম হওয়াই ভাল। টোসিলিজুমাবের থেরাপিতে আছেন যে রোগীরা তাদের সতর্ক থাকতে হবে। কোনওরকম অ্যান্টি-ফাঙ্গাল থেরাপি করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

প্রশ্ন : রেটিনার গুরুত্ব কী এবং এর কাজটা কী?

উত্তর : রেটিনা হলো চোখের একদম পিছনের একটি পর্দা। সিনেমার পর্দায় যেমন ছবি তৈরি হয়, ক্যামেরাতে ঠিক যেভাবে ছবি আসে, ফিল্মের ভিতরে, তেমনি রেটিনা হলো চোখের ফিল্ম। এখানে আমাদের ছবিটা আসলে তৈরি হয়।

প্রশ্ন : এটি চোখের কোন অংশে থাকে? আমরা কী এটি দেখতে পাই?

উত্তর : এটি বাইরে থেকে দেখা যায় না। চোখ তো গোল একটি বলের মতো। আমরা যদি কল্পনা করি, চোখের সামনে থেকে পেছনের দেয়াল, যদি কেটে ফেলি একদম, পেছনের যে দেয়াল,সেই দেয়ালের বরাবর পাতলা একটি পর্দা লাগানো থাকে,এটি হচ্ছে রেটিনা।রেটিনায় যেহেতু ছবিটা তৈরি হবে তাই এটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমরা দেখতে পাব না। সিনেমার পর্দা গুটে গেলে যেমন ছবি হবে না, রেটিনার ভেতরে যদি কোনো সমস্যা হয়, তাহলে ছবিটিই তৈরি হবে না।

প্রশ্ন : রেটিনায় সাধারণত কী ধরনের রোগ হয়ে থাকে?

উত্তর : রেটিনাতে দেশে সবচেয়ে প্রচলিত যে রোগটি হয়, ডায়াবেটিসের কারণে, সেটির নাম ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপের কারণে চোখের পর্দার ভিতরে কিছু সমস্যা হয়। এ ছাড়া জন্মগত কারণেও রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যারা মায়োপিক, যার মানে যাদের অনেক মাইনাস পাওয়ারের চশমা লাগে, তাদেরও অনেক সময় রেটিনার ভিতরে অনেক ধরনের সমস্যা থাকতে পারে। অথবা কখনো কখনো আঘাত লাগার কারণে, অথবা বয়সজনিত কারণে কিছু পরিবর্তন রেটিনার মধ্যে আসতে পারে।

প্রশ্ন : আমার রেটিনা ঠিক আছে কি না আমি বুঝব কী করে? বা কী ধরনের সমস্যা দেখলে আমার মনে করা উচিত হবে রেটিনায় সমস্যা হতে যাচ্ছে?

উত্তর : ঠিক এই জায়গাতে একটি সমস্যা। সমস্যা হলো রেটিনা যেহেতু চোখের গভীরে থাকে, একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে এটি বুঝে ওঠা কঠিন যে আমার রেটিনাতে কোনো সমস্যা আছে কি না? হ্যাঁ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন মানুষ তার রেটিনার সমস্যাকে ধরতে পারে। যেমন হঠাৎ করে সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠে মনে হলো চোখের ভেতর কালো মেঘের মতো ছায়া চলে এসেছে। আমি দেখতে পাচ্ছি না। আমার দৃষ্টির যে পরিসীমা তার কোনো একটি অংশে কালো একটি পর্দার মতো এসে পড়েছে। তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে রেটিনার সমস্যা। বয়স্ক মানুষ মাঝে মাঝে এটি বুঝতে পারে যে সাদা কোনো পর্দার দিকে তাকালে, ঠিক মাঝখানে কোথাও কালো একটি ছায়ার মতো বা ছোপের মতো দেখা যাচ্ছে। তাহলে মনে করতে হবে এটি রেটিনার কোনো একটি কারণে হয়ে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে যখনই এ রকম মনে হবে, চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, রেটিনা পরীক্ষা করার জন্য।

প্রশ্ন : পরীক্ষায় আপনারা কী করেন যা দিয়ে বোঝা যাবে রেটিনা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?

উত্তর : পরীক্ষার কতগুলো ধাপ রয়েছে। প্রথমত, আমরা একটি মানুষের দৃষ্টি কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটি সাধারণ কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে দেখি।কিছু বিশেষ পরীক্ষা যেগুলো আমরা সরাসরি নিজেরা করে থাকি,সেগুলো হলো চোখের মণিকে আমরা বড় করি। কারণ, আমরা জানি যে চোখের ভেতরটা আমাদের দেখতে হবে। সেই গভীরে দেখার জন্য ওষুধের মাধ্যমে সেই মণিকে আমরা বড় করে পরীক্ষা করি। এরপর আমরা আমাদের বিশেষ কিছু যন্ত্রপাতির মাধ্যমে চোখের ভেতরে রেটিনা পুরোপুরি চেক করে দেখি যে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু খালি চোখে দেখাটাই যথেষ্ট নয়। সেক্ষেত্রে আরো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা রয়েছে, যে রকম চোখের ভেতর একটি ছবি তোলা, ওসিটি, এর মানে হলো চোখের ভেতর স্ক্যান করা।

আমরা জানি রেটিনার ১০টি লেয়ার রয়েছে। একটি রেটিনার পুরত্ব হলো ২৭০ থেকে ৩০০ মাইক্রোন। এক মিলিমিটার থেকেও অনেক অনেক কম। তাই এর ভেতর কোনো সমস্যা আছে কি না এর জন্য আমরা ওসিটি করি। ওসিটি করলে এর প্রতিটি লেয়ারকে আমরা আলাদা আলাদা করে নির্দিষ্ট করতে পারি। ঠিক তখনই আমরা কোন লেয়ারে কতটুকু সমস্যা হয়েছে সেটা ধরে নিতে পারি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চোখের এনজিওগ্রাম রয়েছে, সেগুলো করি।

Leave a Comment