ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি রোজা। দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র মাহে রমজান। তাই রমজান মাসে সুস্থভাবে রোজা রাখতে পারাটা অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। করোনাভাইরাস মহামারির এই পরিস্থিতিতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রেখে রোজা রাখতে হবে।
কুরআন শরিফেও রোগাক্রান্তদের রোজা রাখা থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে (সূরা আল বাকারা : আয়াত ১৮৩-১৮৫) আর অন্য যে কোনো ধরনের অসুখের চেয়ে ডায়াবেটিস নিয়মিত ও পরিমিত খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। ডায়াবেটিস রোগীর বিপর্যস্ত বিপাকীয় তন্ত্রের কারণে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে শারীরিক নানাবিধ সমস্যা হতে পারে।
রোজা রাখার সময় ডায়াবেটিক রোগীর ঝুঁকিগুলো :
* রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) : খাদ্য গ্রহণে অনেকক্ষণ ধরে বিরত থাকলে রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ কমতে থাকে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখার সময় এতটাই কমে যেতে পারে যে, তাকে হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত করতে হতে পারে। টাইপ১ ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে এরূপ হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা ৪.৭ গুণ এবং টাইপ২ ডায়াবেটিকের ক্ষেত্রে ৭.৫ গুণ বেশি।
* রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া (হাইপারগ্লাইসেমিয়া) : রোজা রাখার কারণে টাইপ১ ও টাইপ২ উভয় ধরনের ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রেই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কিছুটা ঝুঁকি থাকে। টাইপ১ ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে তা মারাত্মক হতে পারে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এ থেকে জীবন নাশের ঘটনাও ঘটতে পারে। রমজান মাসের শেষের দিকে এ ঘটনাগুলো ঘটার আশঙ্কা বাড়তে থাকে।
* ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস : টাইপ১ ডায়াবেটিস রোগীরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে রক্তের গ্লুকোজ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়া বা এর ধারাবাহিকতায় কিটোনবডি বেড়ে যাওয়ার কারণে সংকটাপন্ন অবস্থায় নিপতিত হতে পারেন। বিশেষ করে যাদের রক্তের গ্লুকোজের নিয়ন্ত্রণ রোজা শুরুর আগে ভালো ছিল না। টাইপ২ ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রেও এরূপ হতে পারে।
* পানি শূন্যতা ও থ্রম্বোএম্বোলিজম : রোজা রেখে দীর্ঘ সময় পানি বা পানীয় খাদ্য গ্রহণে বিরত থাকার কারণে শরীরে পানি শূন্যতা (ডিহাইড্রেশন) দেখা দিতে পারে। গরম ও বেশি আর্দ্র আবহাওয়ায় পানি শূন্যতা আরও প্রকট হতে পারে। যাদেরকে রোজা রেখে কঠোর শারীরিক শ্রম দিতে হয় তাদেরও পানি শূন্যতা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাছাড়া রক্তে বেশি মাত্রায় গ্লুকোজ থাকলে শরীর থেকে পানি ও খনিজ পদার্থ বের হয়ে যাওয়ার হার অনেক বৃদ্ধি পায়।
এতে করে বসা বা শোয়া অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘুরে যেতে পারে। বিশেষত, যাদের ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ুবিক সমস্যা দেখা দিয়েছে, তাদের এ সময় সহসা জ্ঞান হারানো, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, আঘাত প্রাপ্ত হওয়া, হাড় ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। দেহের পানি শূন্যতার কারণে রক্ত জমাট বেধে চোখের রেটিনার কেন্দ্রীয় শিরা বন্ধ হয়ে দৃষ্টি শক্তি হারাবার ঘটনা ঘটেছে সৌদি আরবে ও অন্যান্য মরু অঞ্চলে।
করণীয় :
প্রত্যেক রোজাদার ডায়াবেটিক রোগীর অবস্থা তার স্বাতন্ত্রসহ বিবেচনা করতে হবে।
ঘন ঘন রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা দেখতে হবে [প্রতিদিন বেশ ক’বার (কম পক্ষে তিন বার) রক্তে গ্লুকোজ মাপতে হবে]। দিনের শেষ ভাগে অবশ্যই রক্তের গ্লুকোজ দেখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর টাইপ১ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সঙ্গে রক্তের গ্লুকোজ লক্ষ্য রাখতে হবে। রমজানের প্রথম দিকের দিনগুলোতে একটু বেশি সর্তক থাকতে হবে, পরে অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
প্রতিদিনের খাদ্যের পুষ্টিমান অন্যান্য সময়ের মতোই রাখার চেষ্টা করতে হবে, যদিও তা খুব সহজ নাও হতে পারে। স্বাভাবিক দৈহিক ওজন ধরে রাখার পদক্ষেপ নিতে হবে। রমজানে রোজা রেখে ২০-২৫ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর দৈহিক ওজন কমে বা বাড়ে। ইফতারে চর্বি সমৃদ্ধ খাদ্য এবং তেলে ভাজা খাবার গ্রহণ করা হতে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। কেননা, এসব খাবার হজম হতে সময় লাগবে।
কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীর ইফতারের পরপরই যত দ্রুত সম্ভব রক্তে গ্লুকোজ সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা জরুরি। সেজন্য জটিল শর্করা জাতীয় খাবার সেহরির সময় খেতে হবে। আর ইফতারিতে সহজ পাচ্য খাবার খেতে হবে। প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে। সেহরির খাবার নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ঠিক আগে খেতে হবে এবং তারপর প্রচুর পানি পান করা বাঞ্ছনীয়।
শারীরিক শ্রম বা ব্যায়ামসহ স্বাভাবিক শারীরিক কর্মকাণ্ড চালানো যেতে পারে এ সময়। তবে খুব বেশি কঠোর শ্রম বা ব্যায়াম না করাই ভালো। এতে করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। আর কঠোর শ্রম বিকাল বেলায় তো করা যাবেই না। তারাবি নামাজ পড়লে, তাকে শারীরিক শ্রমের বিকল্প হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। কিছু কিছু ডায়াবেটিস রোগী (বিশেষত টাইপ১) যাদের রক্তের গ্লুকোজ ঠিক মতো রাখা যাচ্ছে না তাদের ক্ষেত্রে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঘটনা প্রায়শ মারাত্মক হয়।
প্রতিটি ডায়াবেটিস রোজাদারকে একথাটি খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, যখনই হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কোনো লক্ষণ শরীরে দেখা দেয় তার পর যতটা সম্ভব দ্রুততর সময়ের মধ্যে গ্লুকোজ/চিনি/মিষ্টি কোনো খাদ্য, শরবত ইত্যাদি যে কোনো একটি খেয়ে নিতে হবে।
যাদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছে, তারা তো খুব সহজেই এর প্রাথমিক উপসর্গ চিনতে পারবেন। আর যাদের তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি, তাদের বুক ধড়ফড়ানি, মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগা, ঘাম হওয়া, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, চোখে অন্ধকার দেখা, মাথা ঘোরা ইত্যাদির এক বা একাধিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তখন হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তের গ্লুকোজ এ সময় সাধারণত ৩.৩ মিলিমোল/লিটার) হওয়ার কথা।
আবার দিন শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যদি রক্তের গ্লুকোজ ৩.৯ মিলিমোল/লিটার বা তার চেয়ে কমে যায় তাহলেও কিছু খেয়ে নেয়া জরুরি। আর যারা ইনসুলিন, সালফুনাইলইউরিয়া-মেগ্লিটিনাইড জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করছেন, তাদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটার আশঙ্কা বেশ বেশি। আবার রক্তের গ্লুকোজ ১৬.৭ মিলিমোল/ লিটারের বেশি হলেও রোজা রাখা সম্ভব হবে না।
ডায়াবেটিস রোগীরা কিছুটা উদ্বিগ্ন হলেও, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দেশনা মানলে তারাও রোজা রাখার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারবেন। বারডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার নাহিদ মহুয়া এ বিষয়ে বেশ কিছু পরার্মশ দিয়েছেন।
ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে প্রথমেই জেনে নিতে হবে, রোজা রাখার জন্য শারীরিক অবস্থা উপযুক্ত কিনা। কী ধরনের খাবার, কখন, কীভাবে ও কতটা খেতে হবে। জানতে হবে শারীরিক পরিশ্রম, ব্যায়ামের নিয়ম, ওষুধের সময় ও মাত্রা, পরিমাণ ও রক্ত পরীক্ষার সময়গুলো।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের তিনটি মূল বিষয় হলো- থ্রি ডি অর্থাৎ ডায়েট, ডিসিপ্লিন (শৃঙ্খলা) ও ড্রাগ (ওষুধ)।
ডায়েট
রোজায় ডায়াবেটিস রোগীদের খাবার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা মেনে চললে স্বাভাবিকভাবে সুস্থ ব্যক্তিদের মতোই রোজা রাখা সম্ভব। ধর্মীয় আচার অনুযায়ী রোজায় আমরা সাধারণত রাতে খাই, তাই খাদ্য তালিকা অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হাইপো/ হাইপারপ্লাসিয়া না হয় সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে।
ইফতারের খাবার
ইফতারের খাবারের পরিমাণ হতে হবে অন্যান্য সময়ের রাতের খাবারের সমপরিমাণ অর্থাৎ সারা দিনের মোট খাবারের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। পানি শূন্যতা আর শরীরের পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে শরবত, ডাবের পানি, ফলের জুস, লেবুর শরবত, ইসবগুলের ভুষি (চিনি, গুড়, মধু এবং মিষ্টি ছাড়া) ইত্যাদি খাওয়া যাবে।
ইফতারির খাবারগুলো নিজস্ব পছন্দমতো হতে পারে যেমন- ছোলা, চটপটি, হালীম, কাবাব, টিকিয়া, পিয়াজু, পাস্তা, নুডলস ইত্যাদি। কিন্তু তা হতে হবে অবশ্যই পরিমাণমতো। তবে বাদ দিতে হবে মিষ্টি জাতীয় খাবার।
সন্ধ্যা রাতের খাবার
এ বেলার খাবারের পরিমাণ হবে অন্যান্য সময়ের সকালের নাশতার পরিমানের সমান অর্থাৎ সবচেয়ে কম। যা সারা দিনের মোট খাবারের ১০-২০ শতাংশ। আর এই বেলায় খাবারের তালিকায় রাখতে হবে সুষম খাবার। যেমন- ভাত, রুটি, খিচুড়ি। সঙ্গে রাখা যেতে পারে মাছ, মাংস, সবজি, শাক, ডাল এবং দুধ।
সাহরি
সাহরির খাবারের পরিমাণ হবে অন্যান্য সময়ের দুপুরের খাবারের সমপরিমাণ অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি। যা মোট খাবারের ৪০-৪৫ শতাংশ। এ খাবারের সময় হতে হবে সাহরির শেষ সময়ে।
যাতে দিনের দীর্ঘ সময়ের মধ্যে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি তৈরি না হয়। অনেকেই এ বেলায় দুধ-ভাত, কলা বা অন্য ফল মিলিয়ে খেতে চান। তবে মনে রাখতে হবে, এই ৩টি খাবার একসঙ্গে খেলে ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। তাই এর মধ্য থেকে যে কোনো দুটি খাবার গ্রহণ করাই ভালো।
বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে সন্ধ্যারাত ও সাহরিতে কখনোই না খেয়ে রোজা রাখা যাবে না। এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। আর ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যসম্মত খাবারগুলোই খেতে হবে। বাদ দিতে হবে সব ধরনের ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড, প্রসেস ফুড, চিনি, মিষ্টি, গুড়, মধু ও অস্বাস্থ্যকর সব খাবার।
ডায়াবেটিসের সঙ্গে অন্য কোনো রোগ (কিডনির রোগ, গাউট, ইউরিক অ্যাসিড) বেশি থাকে তবে রোগের ধরন অনুযায়ী খাবারের ধরন এবং পরিমাণ নির্বাচন করতে হবে। যা অবশ্যই ব্যক্তিভিত্তিক পরিবর্তনযোগ্য।
ওষুধ
ডায়াবেটিস রোগীদের খাবারের পাশাপাশি ওষুধ/ইনসুলিনের ডোজ ও সময় সঠিকভাবে চিকিৎসকের কাছ থেকে রোজার আগে জেনে নিতে হবে।
শৃঙ্খলা
ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রেখে তারাবিহর নামাজ পড়লে আলাদা করে ব্যায়াম করার প্রয়োজন হয় না। সারা দিন রোজা রেখে বিকালে বিশ্রাম নিতে হবে। যাতে হাইপোগ্লাইসেমিয়া প্রতিরোধ করা যায়।
আর রোজা রেখে ইনসুলিন নেয়া এবং রক্ত পরীক্ষা করা যাবে। ওই রক্ত পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ওষুধের মাত্রা ঠিক করে নিতে হবে।
তবে বিশেষ ক্ষেত্রে রোজা ভাঙতে হবে যদি- হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ দেখা দেয় এবং রক্তের গ্লুকোজ ৩.৯ মিলিমোল/লি এর কম হয়, হাইপোগ্লাইসেমিয়া, রক্তের গ্লুকোজ ১৬.৭ মিলিমোল/লি এর বেশি হলে এবং অন্যান্য যে কোনো অসুস্থতায়।
যাদের জন্য রোজা রাখা শিথিল করা হয়েছে : ( ইসলামিক আইন অনুযায়ী, ও IDF মতে )
গর্ভকালীন সময়ে, প্রসূতি/Lacteting মায়ের ক্ষেত্রে, অসুস্থ/বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি (যেমন করোনা আক্রান্ত বা অন্য রোগে আক্রান্ত) এবং দীর্ঘপথ ভ্রমণকারী।
সূত্র/ আমাদের সময়
- সোয়াপ (SWAP) কাকে বলে? , সোয়াপ (SWAP) কতো প্রকার বিস্তারিত আলোচনা করো
- ব্যবসায়িক ঝুকি বলতে কি বুঝায় উদাহরণ সহ আলোচনা করো
- বিনিয়োগ ব্যাংকের ট্রেডিং ব্যবস্থা আলোচনা করো
- মাইগ্রেন ব্যথার কারণ, মাইগ্রেন ব্যথার উপসর্গ,মাইগ্রেন ব্যথার প্রতিকার ,মাইগ্রেন ব্যথার প্রতিরোধ – বিস্তারিত গাইড
- মাথাব্যথার কারণ ও প্রতিকার: একটি সম্পূর্ণ গাইড
1 thought on “রমজানে ডায়াবেটিস কমানোর উপায় ।। ডায়াবেটিস রোগীরা যেভাবে রোজা রাখবেন”