রুদ্র অয়ন এর কলাম – মানুষ মানুষের জন্যে

অতি সম্প্রতি একজন হিন্দু ব্যবসায়ীর মুখাগ্নি করেছেন এক মুসলিম কাউন্সিলর। ঘটনাটি ঘটেছে নারায়ণগঞ্জে।

করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা গিয়েছিলেন উক্ত ব্যবসায়ী। এমন মানবিক ঘটনায় বিবেকবান মানুষের কলিজা শীতল করে তবে এ ঘটনার পেছনে রয়েছে কত শত অমানবিক ঘটনাও, যা আমাদের বিবেককে প্রবলভাবে নাড়া দেয়


ঘটনার বিস্তারিত হচ্ছে, উক্ত ব্যবসায়ী ও তার ছয় বন্ধু কাছাকাছি থাকবেন তাই সবাই মিলে তৈরি করে নিয়েছেন সাততলা একটি ভবন। ওই ভবনের চতুর্থতলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন তিনি। ছয় বন্ধুর সঙ্গে সখ্যও ছিল খুব।

কিন্তু করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর থেকে সবকিছু বদলে যেতে থাকে। তার বা পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ায়নি সেই বন্ধুরা।

নিজেকে রক্ষার সীমাহীন দুশ্চিন্তা তাদের অন্ধ করে দেয়। ওই ব্যবসায়ীকে তার স্ত্রী আর দুই মেয়ে মিলে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা অবশ্য করেছিলেন কিন্তু তিনতলার সিঁড়ি পর্যন্ত নিতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। একটু পানি খেতে চেয়েছিলেন।

মৃত্যুর আগে সে পানিটুকু নিয়েও এগিয়ে আসেননি কেউ। তার লাশ কয়েক ঘণ্টা পড়েছিল সিঁড়িতেই।  খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার। একদল স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে ঐ ব্যবসায়ীর শেষকৃত্য করার প্রস্তুতি নেয় কেন্দ্রীয় শ্মশানে। কিন্তু সেখানেও উপস্থিত হননি মৃতের আত্মীয়স্বজনরা কেউ। ফলে সরকারি পুরোহিতের সহায়তায় শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন কাউন্সিলর।


মাকছুদুল আলম খন্দকারের স্বেচ্ছাসেবী দলে ১২ জন সদস্য। এ দুর্যোগে জীবনের ঝুঁকি জেনেও তারা মানুষের পাশে দাঁড়াতে একত্র হয়েছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা উপসর্গ নিয়ে এ পর্যন্ত মারা যাওয়া ৩৪টি মরদেহ দাফন ও সৎকার করেছে এ দলটি। যার মধ্যে ছয়জন ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। যাদের পরিবারের কেউ না আসায় এই কাউন্সিলর নিজেই তিনজনের মুখাগ্নি করেছেন।


আতঙ্ক নয়, সচেতনতাই করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির একমাত্র পথ। এমনটাই প্রচার চালাচ্ছে সরকার। তবু মানুষের ভেতর আতঙ্ক কমছে না। করোনা শনাক্ত হলেই ওই ব্যক্তি বা পরিবারের প্রতি নির্দয় হয়ে উঠছেন আশপাশের মানুষ।

সংক্রমিত কারুর মৃত্যু হলে ওই পরিবার হয়ে পড়ে আরও অসহায়। তাদের সাহায্যে কেউ এগিয়েও আসেন না। যে মানুষটি প্রিয়জনদের বিপদে নানাভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই মানুষটি করোনায় আক্রান্ত হলে বা মারা গেলে অবহেলার পাত্র হয়ে দাঁড়ান। সবাই মুখ ফিরিয়ে নেন। তার পরিবার নিদারুণ এক কষ্টের মুখে পড়ে।

 যারা এই আচরণগুলো করছেন তারা কি নিশ্চিত যে, তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবেন না? করোনার সংক্রমণ থেকে যদি বেঁচেও যান কিন্তু মনের ভেতরের এমন নির্দয়তা ও নির্মমতার ভাইরাস থেকে তারা মুক্ত হবেন কীভাবে?


 আর একটি ঘটনা। অতি সম্প্রতি এক নারী হাসপাতালকর্মীকে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তালপাতায় বানানো একটি ঝুপড়িঘরে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বাধ্য করার খবর প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। তার ঢাকা থেকে যাওয়ার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসী জড়ো হয়। উপজেলায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বাড়ির প্রায় ৪০০ মিটার দূরে পুকুরপাড়ে তালপাতা দিয়ে ঝুপড়িঘর তৈরি করে তাকে সেখানে থাকতে বাধ্য করেন স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা।

এক সপ্তাহ ধরে ওই নারী সেখানে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মানবেতর জীবনযাপন করেন। একজন হাসপাতালকর্মী হিসেবে তিনি সেবা দিয়েছেন অসংখ্য মানুষকে। অথচ শুধু ঢাকা ফেরত হওয়ার অপরাধে তাকেই নিজ গ্রামে হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে। এর চেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় আর কী হতে পারে!


টাঙ্গাইলের সখীপুরের ঘটনাও আমাদের বিবককে নাড়া দিয়ে যায়।‘মা, তুমি এই বনে একরাত থাকো। কাল এসে তোমাকে নিয়ে যাব’ এই কথা বলে ৫০ বছর বয়সী মাকে শাল গজারির বনে ফেলে যায় তার সন্তানরা! তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে তারা এমন ঘৃণিত কাজটি করে। পরে রাত দেড়টার দিকে উপজেলা প্রশাসন তাকে বন থেকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠায়।


  এসব সংবাদ পড়ে যে কোনও বিবেকবান মানুষের ভিত নাড়া দিয়ে যাবে প্রবলভাবে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু করোনায় আক্রান্তদের প্রতি আমাদের যে আচরণ, সেটা কি সত্যিকার অর্থে কোনো মানুষের আচরণ?


   সচেতনতার বালাই নেই। বরং নিজেকে বাঁচাতে হিংস্র হয়ে ওঠছে মানুষ। মানুষ হয়েও মানুষের প্রতি করা হচ্ছে নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ।


করোনায় আক্রান্তদের প্রতি আমাদের করণীয় বা আচরণ কেমন হবে? এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছন- ‘করোনা রোগী থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। তাই পাড়ায়, গলিতে, ওপরতলায় বা নিচতলায় কিংবা পাশের বাড়ি বা ফ্ল্যাটে করোনা রোগী থাকলে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

এ ক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব হলো রোগী ও তার পরিবারের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা, তাদের বিপদে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে আসা। একই সঙ্গে পাড়ার বা অ্যাপার্টমেন্টের অন্যরা যেন সুরক্ষিত থাকেন, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’


আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের আইসোলেশন মেনে চলা জরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী হিসেবে সবার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো, রোগীর পরিবারের প্রয়োজনীয় জিনিস বা বাজারের ব্যবস্থা করে দরজার সামনে রেখে আসা। এতে রোগীর পরিবারের কাউকে আর বাইরে বের হতে হবে না। ফলে সংক্রমণ হওয়ারও সুযোগ ঘটবে না।


আবার আক্রান্ত ব্যক্তি বা পরিবারের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকার মানসিকতা যেন তাদের একঘরে করে না ফেলে, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। নিয়মিত তাদের খোঁজখবর নেওয়া, আশ্বস্ত করা এবং সহযোগিতা করা উচিত। কেননা, আপনার এই মানবিক আচরণটিই করোনায় আক্রান্ত ও তার পরিবারের মনোবল বাড়িয়ে দেবে শত গুণ।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৃতব্যক্তির দেহ থেকে করোনা ছড়ায় না। কিন্তু সংক্রামক ব্যাধি আইন অনুসারে করোনা রোগীর মৃতদেহ বিশেষ নিয়মে সৎকার করতে হয়। যে কেউ দূরত্ব বজায় রেখে জানাজায় বা দাফনে অংশ নিতে পারবেন, কিন্তু দাফনের মূল কাজটুকু সুরক্ষা মেনে করতে হবে। তাই যদি দাফনে উপস্থিত নাও থাকেন, অন্তত মৃতব্যক্তির পরিবারের পাশে দাঁড়ান।


করোনায় আক্রান্ত ও তার পরিবারের প্রতি অমানবিক ও নির্মম আচরণের কারণেই এখন অনেকেই ভয়ে আক্রান্তের খবর গোপন রাখার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি শেরপুরের নকলায় করোনায় আক্রান্ত এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর চিকিৎসা করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ময়মনসিংহ মেডিকেলে কর্মরত ২৭ জন চিকিৎসক, ১৩ জন নার্স ও ৩২ জন স্টাফ। বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিন বাড়ছে কর্মরতদের আক্রান্তের সংখ্যাও।

এভাবে রোগীর তথ্য গোপনের চেষ্টা চলতে থাকলে বড় রকমের বিপদের মুখে পড়তে হবে। তাই এ বিষয়ে সতর্কতার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতার বিশেষ প্রয়োজন। করোনা আক্রান্তরা যেন স্ব-উদ্যোগে তা প্রকাশ করতে পারেনসেই সামাজিক পরিবেশটা তৈরি করতে হবে। এ কাজটি করতে হবে সবাই মিলে। গণমাধ্যমগুলোও এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করি। 


করোনায় আক্রান্ত হওয়া কোনো অপরাধ নয়। তাই সুরক্ষা মেনে ওই রোগী বা পরিবারের পাশে থাকা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের প্রতি অন্যদের দায়িত্বশীল আচরণ করার বিষয়েও রাষ্ট্রের উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়া উচিত।
 আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। নিরাপদ রাখুন।

পৃথিবী করোনামুক্ত, সুস্থ ও মানবিক হোক এই প্রার্থনা বিশ্ব অধিপতি আল্লাহর কাছে। ভাল থাকুক পৃথিবী, ভাল থাকুক বাংলাদেশ। 

লেখক: রুদ্র অয়ন

Leave a Comment