শিশুর কাশি ও ঠান্ডাজনিত রোগে করণীয়
শীতের প্রথমদিক থেকেই ঘরে ঘরে শিশুদের ঠান্ডাজনিত সর্দি-কাশির সমস্যা শুরু হয়। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এবং বড়দের তুলনায় শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার জন্য এ সময়ে খুব দ্রুতই তারা সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয়।
অনেক শিশু এ মৌসুমে বারবারই ঠান্ডাজনিত সমস্যায় ভোগে। কারো কারো ক্ষেত্রে সর্দি হলে শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়।
সর্দি হলেই আমরা নিউমোনিয়া ভেবে শিশুকে অহেতুক অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো শুরু করি। অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিকে শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
সর্দি-কাশির সমস্যা দেখা দিলে প্রাথমিক অবস্থাতেই কড়া কড়া অ্যান্টিবায়োটিক না দিয়ে সহজ কিছু ঘরোয়া চিকিৎসার মাধ্যমে শিশুকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করতে পারেন।
প্রাথমিক অবস্থায় ঘরেই শিশুর বাড়তি যত্ন নিলে এবং কিছু সতর্কতা মেনে চললে বড় কোনো ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কমানো যায়। এই আর্টিকেলে আমরা চেষ্টা করেছি শিশুর সর্দি-কাশির মতো ঠান্ডাজনিত সমস্যায় ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে। এতে শিশুকে বড় ধরনের রোগ বালাই থেকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব হবে।
সর্দি-কাশি থেকে শিশুকে মুক্তি দিতে যেসব ঘরোয়া চিকিৎসা
লক্ষণ
চলমান মৌসুমে সাধারণত শুষ্ক কাশি বেশি হয়। অনেক সময় কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হয়, দম বন্ধ হয়ে আসার মতো পরিস্থিতি হয়, যা শিশুদের জন্য বেশি কষ্টকর।
কিছু শিশুর ক্ষেত্রে ঠান্ডা লাগার পর ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়ে তা নিউমোনিয়ায় রূপান্তরিত হয়। তবে, সব শিশুর ক্ষেত্রে এটা হয় না।
যদি শুধু শুষ্ক কাশি থাকে, তাহলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল জানান, ‘ঠান্ডা লাগলে শিশুরা যদি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্রুত শ্বাস নেয়, শ্বাসকষ্ট হয়, শ্বাস নেওয়ার সময় শব্দ হয়, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয় বা খুব বেশি জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’
‘এক্ষেত্রে জ্বর থাকা না থাকার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জ্বর থাকাটা ইনফেকশনের সাইন। তবে যদি জ্বর না থেকে শুধু কাশি হয়, সেটা মূলত অ্যালার্জি ও আবহাওয়াজনিত কারণে হয়’, বলেন তিনি।
অ্যাডিনো ভাইরাস
অ্যাডিনো ভাইরাস বিষয়ে এই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, ‘মূলত শিশুরা এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়। এই ভাইরাস পৃথিবীর শুরু থেকে ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।
কখনো এর মাত্রা বাড়ে, কখনো কমে। এখনো এই ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট পাওয়ার কোনো তথ্য আসেনি। পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি ভাইরাসটির আউটব্রেক হওয়ায় সেখানে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তবে, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’
‘এই ভাইরাসের নেতিবাচক দিক হলো একবার হলে তা সারতে প্রচুর সময় লাগে। দীর্ঘমেয়াদি কাশি এবং অনেকদিন ধরে শ্বাসকষ্ট হয়। যখনই কাশি কমে না বা কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট থাকে, ওষুধ দিলে সাধারণত শ্বাসকষ্ট কমে যায়। কিন্তু যখন ওষুধ দেওয়ার পরেও শ্বাসকষ্ট কমে না এবং নিউমোনিয়ার লক্ষণও নেই, তখন আমরা বুঝি যে তা অ্যাডিনো ভাইরাসের সংক্রমণ।’
শিশুর ঠান্ডাজনিত সমস্যা প্রতিরোধ ও প্রতিকার
- শরীরকে উষ্ণ রাখার চেষ্টা করুন।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রামের ব্যবস্থা করুন।
- হালকা গরম পানি দিয়ে শরীর স্পঞ্জ করান।
- বুকের দুধ এবং তরল পানীয় পান করান।
- ১ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের স্যুপ খাওয়ান।
- ২ বছরের বেশি বয়সী বাচ্চাদের ১ থেকে ২ গ্লাস কমলালেবুর রস পান করান।
- গলা ব্যথা থাকলে লবণ মিশিয়ে কুসুম গরম পানি দিয়ে গার্গল করান। ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এই পরামর্শ প্রযোজ্য নয়।
- এক চিমটি শুকনো আদার সঙ্গে এক চামচ মধু মিশিয়ে খাওয়ান। শিশুর বয়স যদি এক বছরের কম হয়, তাহলে মধু দেবেন না।
- আধা চা চামচেরও কম পরিমাণ কালো জিরা, দুই কোয়া রসুন এবং এক কাপ সরিষার তেল গরম করে শিশুর বুক-পিঠ মালিশ করুন।
- মাঝারি মাপের পেঁয়াজ কুচি কুচি করে কেটে পানিতে ছয়-আট ঘণ্টা ভিজতে দিন। এর সঙ্গে দুই-তিন চামচ মধু মিশিয়ে দিনে দুইবার করে খাওয়ান। ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এই পরামর্শ প্রযোজ্য নয়।
- প্রতিদিন সকালে খালি পেটে দুই কোয়া কাঁচা রসুন চিবিয়ে খাওয়াতে পারলে ভালো।
- লেবু পানিতে এক চা চামচ মধু মিশিয়ে বাচ্চাকে খাওয়ান। মধু শ্বাসযন্ত্রের ব্যাকটিরিয়া ধ্বংস করে, বুক থেকে কফ দূর করে গলা পরিষ্কার রাখে।
- কাশি হলে গরম স্যুপ খাওয়াতে পারেন। এতে কাশি কমতে পারে এবং গলা ব্যথাও কমে যাবে।
- কাশি থেকে মুক্তি পেতে শিশুকে মিশ্রি দিতে পারেন। মিশ্রি গলার আর্দ্রতা বজায় রাখে, গলার জ্বালাপোড়া কমায়।
- আদা, তুলসী পাতা থেঁতো করে মধু মিশিয়েও খেতে পারেন।
- হলুদ মেশানো গরম দুধ সর্দি-কাশি, জমা কফের সমস্যা দূর করে।
সর্দি-কাশির সময় যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখবেন
- শিশুকে আলো-বাতাসপূর্ণ ঘরে রাখুন।
- খেয়াল রাখবেন যেন শিশুর শ্বাস নিতে কষ্ট না হয়।
- সব সময় শিশুর নাক পরিষ্কার রাখুন।
- পুষ্টিসম্পন্ন খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করুন।
- শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।
- রাতে ঘুমানোর সময় শিশুর মাথার নিচে অতিরিক্ত একটা বালিশ দিন যেন নাকের ভেতরে জমে থাকা শ্লেষ্মা বের হতে পারে।
- ঘরে এ সময় কোনো পোষা প্রাণী রাখবেন না।
- শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করুন।
সর্দি-কাশির সময় যেসব সতর্কতা মেনে চলবেন
- যেই পদ্ধতিই অবলম্বন করেন না কেন, খেয়াল রাখতে হবে যেন তা আপনার শিশুর বয়স অনুপাতে হয়। শিশুর বয়স যদি এক বছরের নিচে হয়, তবে তাকে গরম পানির ভাপ নেওয়াতে পারবেন না। এর পরিবর্তে গরম তেল মালিশ করলে কাজে দেবে।
- শিশুকে প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য রোদে রাখুন। এতে ভিটামিন ডি শরীরে ঢুকবে এবং শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে।
- পাতলা জ্যাকেট বা সোয়েটার পরিয়ে রাখুন, বিশেষ করে রাতে ও ভোরের সময়।
- এ সময় ঠান্ডা জাতীয় কোনো খাবার বা পানীয় দেবেন না।
কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে?
- শিশুর যদি খিঁচুনি উঠে।
- জ্বর ১০৪° ফারেনহাইট এর ওপরে চলে যায়।
- ঠোঁট ও মুখ নীল হয়ে গেলে।
- পানিশূন্যতা দেখা দিলে।
- সজাগ অবস্থাতেও পুরোপুরি সচেতন না থাকলে।
- দ্রুত শ্বাস নিলে অথবা শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে।
- শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে পাঁজরের হাড় ভেতরে ঢুকে গেলে।
শিশুর কাশি হলে কী করবেন
এসব কারণ ছাড়াও দীর্ঘমেয়াদী অন্যান্য রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ বেড়ে গেলে; জ্বর-কাশি কিছুটা কমার পরে যদি আবার ফিরে আসে অথবা হঠাৎ করেই উপরের লক্ষণগুলো বেশি বেড়ে গেলে দ্রুত শিশুকে ডাক্তার দেখাতে হবে। ঘরে বসেই এখন আপনি ভিডিও কলের মাধ্যমে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারবেন ডকটাইম অ্যাপে। যেকোনো সময়, যেকোনো মুহূর্তে ডাক্তারকে জানাতে পারেন শিশুর যেকোনো স্বাস্থ্য সমস্যার কথা। প্রাথমিক অবস্থাতেই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চললে, যেকোনো জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
আপনার শিশুর সর্দি-কাশি প্রতিরোধে করণীয়
সাধারণ সর্দি-কাশি ৭–১০ দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায়। তবে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কারণে অনেক সময় সাধারণ সর্দি-কাশি থেকেও নিউমোনিয়ার মতো জটিলতায় ভোগার সম্ভাবনা থাকে। এ কারণে ঠান্ডাজনিত সমস্যা থেকে দূরে রাখতে শিশুর জন্য নিতে হবে কিছু বাড়তি প্রতিরোধ। শিশুকে সর্দি-কাশির প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে যা করবেন-
কাশি মানেই শিশুর অসুস্থতা নয়
- শিশুকে সংক্রমণ প্রতিরোধের টিকা দিন।
- ঠান্ডা আবহাওয়ায় শিশুকে চাদর বা গরম জামাকাপড়ে ঢেকে রাখুন।
- নিয়মিত বিরতিতে হাত ধোয়ান।
- নাকে-মুখে যেন হাত না দেয়, খেয়াল রাখুন।
- ভিটামিন সি-জাতীয় খাবার বেশি খাওয়ান।
- ধুলোবালি থেকে শিশুকে দূরে রাখুন।
- শরীর ঘামলে সঙ্গে সঙ্গে মুছে দিন।
- ঘরে এসি চললে ২৬-২৮ ডিগ্রি সেন্টিমিটারের মধ্যে রাখুন।
নবজাতক শিশুর সর্দি কাশি হলে করণীয়
‘আতঙ্কিত না হয়ে সাবধানতা অবলম্বন করে এই রোগ প্রতিরোধ করতে হবে। জরুরি প্রয়োজনে বা উপরে উল্লেখিত লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে’, যোগ করেন এই চিকিৎসক।
পরিশেষে : শিশুর কাশি ও ঠান্ডাজনিত রোগে করণীয়,সর্দি-কাশি থেকে শিশুকে মুক্তি দিতে যেসব ঘরোয়া চিকিৎসা
আপনার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক আরো কিছু পোস্ট
স্বাস্থ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী ঔষধি গুন গোপন সমস্যা রূপচর্চা রোগ প্রতিরোধ