সমন্বয় দাখিলা কাকে বলে?, সমন্বয় দাখিলা কত প্রকার ও কি কি?,সমন্বয় দাখিলার প্রয়োজনীয়তা
সমন্বয় দাখিলা কাকে বলে :-
একটি হিসাবকালের সকল লেনদেন সংশ্লিষ্ট হিসাব বছরে শেষ না হয়ে একাধিক বছরে ব্যপ্ত হতে পারে। চূড়ান্ত আর্থিক বিবরণী প্রণয়ন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী হিসাবকালের যাবতীয় আয়ব্যয়কে সমন্বয় করতে হয় এবং সংশ্লিষ্ট হিসাবকালের যাবতীয় আয়ব্যয়কে হিসাবভুক্ত করে ঐ হিসাব সনের প্রকৃত আর্থিক ফলাফল অর্থাৎ নিট আয় বা নিট ক্ষতি নিরূপণ করা হয়। আর এরূপ নিট আয় বা নিট ক্ষতি নিরূপণের জন্য অসমন্বিত আইটেমগুলোকে বা দফাগুলোকে যে জাবেদা দাখিলার মাধ্যমে হিসাবভুক্ত করা হয় তাকে সমন্বয় দাখিলা বলা হয়।
আবার সহজ কথায় বলা যায়, বকেয়া আয়, বকেয়া ব্যয় বা খরচ, অগ্রিম প্রদত্ত খরচ, অনাদায়ি পাওনা সঞ্চিতি, অবচয় ইত্যাদি বিষয়সমূহকে সংশ্লিষ্ট হিসাবখাতের সাথে সমন্বয়সাধন (যোগ বা বিয়োগ) করার জন্য যে দাখিলা ব্যবহার করা হয় তাকে সমন্বয় দাখিলা বলা হয়।
হিসাবকাল শেষে হিসাবসমূহের ব্যালেন্সকে হালনাগাদ (Update) করার জন্য যে জাবেদা দাখিলা দেওয়া হয় তাকে সমন্বয় দাখিলা বলা হয়।
সমন্বয় দাখিলা সম্পর্কে প্রদত্ত বিভিন্ন লেখকের সংজ্ঞা নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
Weygandt, Kieso & Kimmel, “Adjusting entries are made at the end of an accounting period for the revenue recognition and matching principles” অর্থাৎ আয় স্বীকৃতির নীতি ও মিলকরণ নীতির অনুসরণ নিশ্চিত হওয়ার জন্য সমন্বয় দাখিলার প্রয়োজন হয়।
Pyle & Larson, “Adjusting entries are journal entries to assign revenues to the period in which earned and to match revenue and expenses.” অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের আয় নির্ধারণ এবং আয়ের সাথে ব্যয় সমন্বয়ের জন্য যে জাবেদার প্রয়োজন হয় তাকে সমন্বয় দাখিলা বলা হয়।
সমন্বয় দাখিলার প্রয়োজনীয়তা :-
প্রতিটি হিসাবকাল শেষে কারবারের ফলাফল নির্ণয় এবং আর্থিক অবস্থা প্রদর্শন করা হিসাববিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। আয় চিহ্নিতকরণ নীতি (Revenue Recognition Principle) ও আয়ব্যয় সংযোগ নীতি (Matching Principle) নিশ্চিত করণের জন্য সমন্বয় এন্ট্রির প্রয়োজন হয়।
কোনো প্রতিষ্ঠানের একটি আর্থিক বছরের সঠিক Financial reporting এর জন্যই Adjusting entries এর প্রয়োজন হয়। সমন্বয় এন্ট্রি দেয়ার ফলে প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট হিসাবকালের সঠিক মুনাফা বা ক্ষতি যেমন জানা যায় তেমনি প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি, দায় ও মালিকানা স্বত্ব সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা সম্ভব হয়।
হিসাবকালের অপরিশোধিত খরচ, অপ্রাপ্ত আয়, সম্পত্তির অবচয়, অগ্রিম প্রদত্ত খরচ, অগ্রিম প্রাপ্য আয়কে হিসাবে ধরা না হলে প্রতিষ্ঠানের সঠিক সম্পত্তি, দায়, মালিকানা স্বত্ব, মুনাফা বা ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হবে না।
রেওয়ামিলে অনেক সময় হালনাগাদ (Update) তথ্য নাও থাকতে পারে। বিশেষ করে অগ্রিম প্রদত্ত খরচ, বকেয়া খরচ, সম্পত্তির অবচয়, মেয়াদান্তিক বিল প্রাপ্তি, ব্যবহৃত সাপ্লাইজ, সম্পত্তির বাজারমূল্য বছর শেষে নির্ধারণ ইত্যাদি নানা কারণে সমন্বয় দাখিলা দিতে হয়। নিম্নে সমন্বয় দাখিলার গুরুত্ব বর্ণনা করা হলো:
১. হিসাবকালের সঠিক আয়ব্যয় নির্ণয় (Determination of accurate income expenditure in accounting period) :-
সংশ্লিষ্ট হিসাবকালের সঠিক আয়ব্যয়ের হিসাব রাখার জন্য সমন্বয় দাখিলার প্রয়োজন হয়।
২. বকেয়া ও অগ্রিম আয়ব্যয়ের সমন্বয়সাধন (Adjustment of accruals & advances) :-
বকেয়া (Accruals) অথবা অগ্রিম (Prepayments) আয়ব্যয় এর সঠিক হিসাবভুক্তির জন্য সমন্বয় দাখিলার গুরুত্ব রয়েছে।
৩. হিসাবনীতির বাস্তব প্রয়োগ (Implementation of real accounting principles) :-
হিসাবকাল নীতি, আয়ব্যয় সংযোগ নীতি, চলমান প্রতিষ্ঠান নীতি ও মুনাফা চিহ্নিতকরণ নীতির বাস্তব প্রয়োগের জন্য সমন্বয় দাখিলার গুরুত্ব রয়েছে।
৪. রেকর্ডবিহীন লেনদেন (Unrecorded transaction) :-
কারবারি প্রতিষ্ঠান সাপ্লাইজ এককালীন ক্রয় করে থাকে। হিসাবকালে এর কতটুকু অব্যবহৃত রয়েছে তা স্থির করা না হলে সঠিক মুনাফা নির্ণয় সম্ভব হয় না। ব্যবহৃত সাপ্লাইজকে খরচ ও অব্যবহৃত সাপ্লাইজ কে সম্পদ হিসেবে ধরে সমন্বয় দাখিলা প্রদানের মাধ্যমে আর্থিক বিবরণী তৈরি করতে হয়।
৫. বাদ পড়া লেনদেন (Omitted transaction) :-
বাদ পড়া লেনদেন অর্থাৎ যে সকল লেনদেন সংশ্লিষ্ট হিসাবকালের মধ্যে সংগঠিত হয় কিন্তু বিল পরিশোধের জন্য পাওয়া না গেলে যেমন- ইউটিলিটি বিল (বিদ্যুৎ বিল, পানি বিল, গ্যাস বিল) সেগুলি হিসাবভুক্ত করার জন্য সমন্বয় দাখিলার গুরুত্ব রয়েছে।
৬. স্থায়ী সম্পত্তির অবচয় হিসাবভুক্তকরণ (Recording depreciation of fixed assets) :-
সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে স্থায়ী সম্পদের অবচয়জনিত হিসাব প্রদর্শনের জন্য সমন্বয় দাখিলার গুরুত্ব অপরিহার্য।
৭. সঠিক লাভ-ক্ষতি নির্ণয় (To ascertain accurate Profit / loss) :-
সঠিক লাভ-ক্ষতি নির্ণয়ের জন্য সমন্বয় দাখিলার গুরুত্ব রয়েছে।
৮. সম্পদের ন্যায্য মূল্যায়ন (Reasonable valuation of assets) :-
কোনো প্রতিষ্ঠানের সম্পদসমূহের যথার্থ ও ন্যায্য মূল্যায়ন দেখাতে হলে উক্ত প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায়ের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয়সাধন প্রয়োজন হয়। সমন্বয় দাখিলা ছাড়া উদ্বতপত্র তৈরি করলে সম্পদের প্রকৃত মূল্য প্রতিফলিত হয় না। এ কারণেও সমন্বয় দাখিলার গুরুত্ব অপরিসীম।
৯. মজুদের মূল্যায়ন (Inventory valuation) :-
অব্যবহৃত মজুদ পণ্যের মূল্যায়নপূর্বক হিসাবে প্রদর্শনের জন্য সমন্বয় দাখিলার গুরুত্ব রয়েছে। উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটি প্রতীয়মান হয় যে, সমন্বয় দাখিলার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
সমন্বয় দাখিলা কত প্রকার ও কি কি :-
সমন্বয় দাখিলাকে প্রধানত অগ্রিম (Advances) ও বকেয়া (Payable Accruals, outstanding or unpaid) এ দু’ভাগে ভাগ করা হয়। এদের প্রত্যেককে আবার দু’ভাগে ভাগ করা হয়। নিচে সমন্বয় জাবেদার শ্রেণিবিভাগ আলোচনা করা হলো।
১. অগ্রিম দফাসমূহ :-
সকল অগ্রিম হিসাবের উদ্বৃত্ত হতে নির্দিষ্ট হিসাব কালের মুনাফাজাতীয় অংশটুকু আলাদা করে লিপিবদ্ধ করতে যে ডাবেদার প্রয়োজন হয় তাকে অগ্রিম সমন্বয় দাখিলা বলে। অগ্রিম সমন্বয় দাখিলা দুই প্রকার। যেমন- অগ্রিম খরচসমূহ ও অনুপার্জিত আয়সমূহ।
ক. অগ্রিম খরচসমূহ :-
যে সমস্ত খরচ নগদে প্রদান করা হয় এবং ব্যবহারের পূর্বে সম্পত্তি হিসাবে লিপিবদ্ধ করা হয় সে সমস্ত খরচকে অগ্রিম প্রদত্ত খরচ বলা হয়। সাধারণত বিমা, ভাড়া, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি বাবদ অগ্রিম অর্থ প্রদান করা হয়ে থাকে। যেমন বেতন ২,৫০০ টাকার মধ্যে ১০০ টাকার বেতন অগ্রিম প্রদান করা হয়েছে সমন্বয় জাবেদা হবে।
খ. অনুপার্জিত আয়সমূহ :-
কোন গ্রাহক যখন পণ্য বা সেবা প্রাপ্তির পূর্বেই বিক্রেতা কোম্পানিকে নগদ অর্থ অগ্রিম প্রদান করে থাকে এরূপ ক্ষেত্রে অগ্রিম আয় বা অনুপার্জিত আয় সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ কোন সম্পত্তি অর্জিত হওয়ার পূর্বেই যখন পাওয়া যায় তখন একটি দায় বা অগ্রিম আয় বা অনুপার্জিত আয় সৃষ্টি হয়। যেমন শিক্ষানবিশ সেলামি অগ্রিম পাওয়া গেছে ৮০০ টাকা।
২. বকেয়া দফাসমূহ :-
একটি নির্দিষ্ট আর্থিক বছরে যে সমস্ত লেনদেনের টাকা বকেয়া থাকে তাকে বকেয়া সমন্বয় দাখিলা বলে। বকেয়া সমন্বয় দাখিলাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—প্রদেয় খরচসমূহ ও প্রাপ্য আন্তসমূহ।
ক. প্রদেয় খরচসমূহ :-
খরচ সংঘটিত হয়েছে কিন্তু পরিশোধ করা হয়নি এরূপ রচসমূহকে বকেয়া খরচ বলে। যেমন – বেতন, ভাড়া, সুদ এবং কর বকেয়া হতে পারে। যেমন – ভাড়া বকেয়া রয়েছে ৫,০০০ টাকা।
খ. প্রাপ্য আয়সমূহ :-
প্রদত্ত সেবার বিনিময়ে অর্থ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে বকেয়া আয় বলে। যে অর্জিত আয় আদায় হয়নি, তাই বকেয়া। হিসাবকালের শেষে বকেয়া আয় হিসাবভুক্ত না হয়ে থাকলে আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতের পূর্বে সমন্বয় দাখিলার মাধ্যমে তা হিসাবভুক্ত করতে হয়।যেমন- আইনি সেবা প্রদান বাবদ ৫০০ টাকা এখনো পাওনা রয়েছে।
একাডেমিক শিক্ষা বিষয়ক লিখিত প্রশ্ন সমাধান পেতে ক্লিক করুন।