সমাজকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিন
বৈশ্বিকভাবে ১৮৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ শতকের দিকে ইউরোপসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আধুনিক সমাজকলাণ বা সমাজকর্ম একটি ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে পঠিত হলেও বাংলাদেশে এর প্রসার ঘটে তারও অনেক পরে। বাংলাদেশে আধুনিক সমাজকলাণ বা পেশাদার সমাজকর্মের যাত্রা শুরু জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ সহায়তায়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগ পরবর্তীকালে সৃষ্ট পাকিস্তানে ভারত থেকে আসা অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। সৃষ্ট সমস্যার সমাধানের জন্য তত্কালীন সরকার জাতিসংঘের কাছে আবেদন করেন।
সে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের কারিগরি সাহায্য কর্মসূচির আওতায় ১৯৫২ সালে ড. জেমস্ আর ডুম্পসন -এর নেতৃত্বে জাতিসংঘের ছয় সদস্য বিশিষ্ট সমাজকর্ম বিশেষজ্ঞ দল এদেশে আগমন করেন। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দল এদেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার জরিপ ও পর্যালোচনা করে পেশাদার সমাজকর্মের প্রবর্তন এবং স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থার বিকাশের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
একাডেমিক শিক্ষা বিষয়ক লিখিত প্রশ্ন সমাধান পেতে ক্লিক করুন।
পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় তত্কালীন সরকারের উদ্যোগে ৯ মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু হয় এবং সেসময়েই ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স কোর্স চালু করার প্রস্তাব রাখা হয়। তারও পরে ঢাকায় দেশের প্রথম সমাজকর্মের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ‘কলেজ অব সোশাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয় যা ১৯৭৩ সালে রূপান্তরিত করা হয় ‘সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ’ নামে।
সমাজকর্মকে বাংলাদেশে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি
তখন থেকেই সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউট সমাজকর্মের উপর স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি দিয়ে আসছে। বর্তমানে দেশের অনেকগুলো প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সমাজকর্ম পড়ানো হয়।
উন্নত বিশ্বে সমাজকর্মের পেশা হিসেবে স্বীকৃতি থাকলেও বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষা প্রচলনের অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এর প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি বা পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
সমাজকর্ম পেশার মূল্যবোধ ও নীতিমালা
যদিও ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সরকারের সমাজসেবা বিভাগে ‘সমাজসেবা কর্মকর্তা’ পদটি সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্মের স্নাতকদের জন্য সংরক্ষিত ছিল,পরে তা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে সমাজকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি
যদি প্রশ্ন করা হয়, সমাজকর্মকে কেন পেশা বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। তবে উত্তরটি এমন হবে যে, আপনি কি কোথাও দেখেছেন যেকোনো হাসপাতালে মেডিক্যাল সায়েন্স না পড়ে কেউ ডাক্তার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অথবা আইন বিষয়ে পড়াশুনা না করেও কেউ ওকালতি করছে?।
আপনার নিরব উত্তর হবে ‘না’। তবে সমাজকর্মের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম কেন?
বিশ্বায়নের যুগে আমাদের দেশে সৃষ্টি হচ্ছে নানা আর্থ-সামাজিক সমস্যা যেমন- আত্মহত্যা, বিবাহ বিচ্ছেদ, শিশু-কিশোরদের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের সমস্যা, প্রবীণদের নিরাপত্তাহীনতা, অপরাধ প্রবণতাসহ ইত্যাদি। এসব আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মের জ্ঞান ও দক্ষতা খুবই কার্যকরী।
তাছাড়াও,দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থান, ক্ষুদ্রঋণের ব্যবহার; শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পুষ্টি, গণতন্ত্র-মানবাধিকার, অপরাধ-কিশোর অপরাধ, মানব পাচার, পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে সমাজকর্মের জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োগ অধিক ফলপ্রসূ।
সমাজকর্মকে পেশা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করুন
সর্বোপরি, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হলে জরাজীর্ণ এই সমাজ বা দেশের রোগ বা বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে এবং সমস্যাগুলোর সঠিক প্রতিকার এবং প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যা সমাজকর্ম শিক্ষার প্রতিপাদ্য বিষয়।
সমাজকর্ম শিক্ষার জ্ঞান, দক্ষতা ও কৌশলকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।
তাই উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোসহ অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও পেশাদার সমাজকর্মী নিয়োগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
সমাজকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানে সরকারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি ডাক্তার-আইনজীবীদের মতোই সমাজকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দেশ এবং সমাজের কল্যাণে সমাজকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়, তা দেশ এবং সমাজ উভয়ের জন্যই উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। গড়ে উঠবে এক মানবীয় সমাজ, এক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র, আজকের বাংলাদেশ হয়ে উঠবে তুলনামূলক সুখী বাংলাদেশ।
একাডেমিক শিক্ষা বিষয়ক লিখিত প্রশ্ন সমাধান পেতে ক্লিক করুন।