দেবর আর ভাবী, দুলাভাই আর শালী!
আমাদের সমাজে একটা প্রচলিত প্রবাদ আছেঃ “ভাবী হলো মায়ের মতো”। ভাবী তাই দেবরের সামনে পর্দার কোনো প্রয়জনীয়তাই মনে করে না! দেশে বহুল প্রচলিত আরেকটি প্রবাদ হলোঃ “স্বামী আমার যেমন-তেমন/ দেবর আমার মনের মতন” (আস্তাগফিরুল্লাহ)। এসব আশ্লীল ও নোংরা কথা আমরা প্রায়ই শুনতে পাই।
আর ভাবীকে এখানে-সেখানে নিয়ে যাওয়ার কাজটা দেবরই যেনো ভালো ভাবে করতে পারে। এমনকি শ্বশুর-শাশুড়িও মনে করে যে, বড় বউ একটু বাইরে যাবে তো এক্ষেত্রে আমার ছোটো ছেলেই নিয়ে যাক।
শুধু তাই নয়, দেবর-ভাবীর মধ্যে যতো ধরনের ইয়ার্কি-মস্করা, অশ্লীল ফাজলামি – এগুলো তো খুবই সাধারণ ব্যাপার!
দেবর-ভাবীর মতো আরেকটি খোলামেলা সম্পর্ক হলো দুলাভাই আর শালী (শ্যালিকা)। দেখা যায়, যত ইচ্ছা খুনসুটি আর শয়তানি চলতে থাকে দুলাভাই আর শালীর মধ্যে। সেইসাথে শালীর বড় বড় আবদার পূরণ করতে হয় দুলাভাইকে। শপিং-মলে শপিং থেকে শুরু করে প্রতি মাসে অন্তত একবার করে রেস্টুরেন্টে খাওয়ানোর দায়িত্ব দুলাভাইয়ের। অন্যদিকে বউয়ের অবর্তমানে ঘরের কাজগুলো করে দেওয়ার দায়িত্ব শালীর। এগুলো দেখে এমন প্রতীয়মান হয় যে, শালী যেনো দুলাভাইয়ের কাছে নিজের বউয়ের মতোই! আস্তাগফিরুল্লাহ!
অথচ দেবর এবং ভাবী, কিংবা দুলাভাই এবং শ্যালিকা – ইসলামী শারীয়াহ-তে এরা একে অপরের জন্য গায়ের-মাহরাম। অর্থাৎ আর পাঁচজন গায়ের-মাহরামের মতো এদের জন্যও একে অপরের সামনে পর্দা করা ফরজ।
শুধু তাই নয়, বরং অন্য গায়ের-মাহরামের তুলনায় এই সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে আরো বেশী দূরত্ব এবং সাবধানতা বজায় রাখা উচিত। কেননা এই সম্পর্কগুলো অন্যগুলোর চেয়ে আরো বেশী বিপজ্জনক।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “তোমরা নারীদের নিকট প্রবেশ করা থেকে সাবধান থেকো।” একথা শুনে আনসার গোত্রের এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলো, কিন্তু দেবর সম্পর্কে আপনার মত কী? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ “দেবর! দেবর তো মৃত্যুর সমতুল্য!” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৫২৩২ ও সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ২১৭২)
সুবহানআল্লাহ! আল্লাহর রাসূল এখানে দেবরকে মৃত্যুর সমতুল্য বলেছেন। অথচ আমাদের সমাজ দেবরকে যেনো “দ্বিতীয় বর” হিসেবে বানিয়ে রেখেছে! আস্তাগফিরুল্লাহ!
আল্লাহ যে জিনিসটাকে হারাম করেছেন সেখানে লোকেরা কিভাবে সেটাকে হালাল মনে করতে পারে? তাহলে কি সমাজের লোকেরা নিজেরাই বিধানদাতা হয়ে গেলো?
তাই ভাই ও বোনেরা! সাবধান হোন! সমাজের সমস্ত রকমের অশ্লীল ও বেহায়া প্রচলন থেকে বের হয়ে আসুন। এবং কেবলমাত্র কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবনযাপন করুন।
মনে রাখবেন, আপনার দেবর কিংবা আপনার দুলাভাই – এরা আপনার কাছে একজন গায়ের-মাহরাম। তাই এদের সামনে পরিপূর্ণ পর্দা করা আপনার জন্য ফরজ!
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “(হে নবী) মুমিন পুরুষদেরকে বলো, তারা যেনো তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গকে হেফাযতে রাখে; এটিই তাদের জন্য উত্তম। ওরা যা করে, আল্লাহ সে বিষয়ে অবহিত। আর মুমিন নারীদেরকে বলো, তারা যেনো নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে ও লজ্জাস্থান হিফাজত করে এবং যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, এবং তারা যেনো তাদের ‘খিমার’ (মাথার কাপড়, ওড়না, অথবা চাদর) দ্বারা তাদের ‘জুয়ুব’ (মুখমণ্ডল সহ গ্রীবা ও বক্ষদেশ) আবৃত করে রাখে।” (সুরাহ আন-নূর, আয়াত : ৩০-৩১)
যৌথ পরিবারের অজুহাতে কারনে-অকারনে দেবর-ভাবী কিংবা দুলাভাই-শালীর মেলামেশা করা, অহেতুক মস্করা-ফাজলামি করা পুরোপুরিভাবে হারাম। সেইসাথে একে অপরের গায়ে গায়ে স্পর্শ করে পাশাপাশি বসা, কিংবা হ্যান্ড সেইক করাও পুরোপুরিভাবে হারাম। অন্যথায় এগুলো সবই জিনার মধ্যে সামিল হবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “প্রত্যেক আদম সন্তানের উপর ব্যভিচারের কিছু অংশ লিপিবদ্ধ হয়েছে, সে অবশ্যই তার মধ্যে লিপ্ত হবে। দুই চোখের ব্যভিচার হলো দৃষ্টি, দুই কানের ব্যভিচার হলো শ্রবণ, মুখের ব্যাভিচার হলো কথা বলা, হাতের ব্যভিচার হলো স্পর্শ করা এবং পায়ের ব্যভিচার হলো অগ্রসর হওয়া। আর অন্তর আশা ও আকাঙ্ক্ষা করতে থাকে। লজ্জা স্থান তাকে বাস্তবায়ন করে অথবা মিথ্যায় পরিণত করে।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ২৬৫৭, ৬৫১৩)
তিনি (সা.) আরো বলেছেনঃ “প্রত্যেক চক্ষুই ব্যভিচারী। আর রমণী যদি সুগন্ধি ব্যবহার করে কোনো (পুরুষের) মজলিসের পাশ দিয়ে পার হয়ে যায় তাহলে সে এক বেশ্যা।’’ (সহীহ তিরমিযী, আল্লামা আলবানী, ২২৩৭)
তিনি (সা.) আরো বলেছেনঃ “কোনো ব্যক্তির মাথায় লৌহ সুচ দ্বারা খোঁচা যাওয়া ভালো, তবুও যে নারী তার জন্য অবৈধ তাকে স্পর্শ করা ভালো নয়।” (আস সিলসিলাতুস সহীহাহ, ২২৬)
তিনি (সা.) আরো বলেছেনঃ “কোনো নারীর উপর তোমার (অনিচ্ছাকৃত) দৃষ্টি পড়লে তার প্রতি বারবার দৃষ্টিপাত করো না, বরং নজর সত্ত্বর ফিরিয়ে নিও। কারণ প্রথমবারের জন্য তোমাকে ক্ষমা করা হলেও, দ্বিতীয়বার জন্য করা হবে না।” (আহমদ, হাদিস নং ১৩৬৯)
সেইসাথে অল্প সময়ের জন্য হলেও দু’জনের একসাথে কোনো কামরা বা স্থানে নির্জনতা অবলম্বন করা পুরোপুরিভাবে হারাম। সেইসাথে দেবরের সাথে একাকী বাপের বাড়ি যাওয়া, কিংবা দুলাভাইয়ের সাথে একাকী বোনের বাড়ি যাওয়া, অথবা অন্য কোনো প্রয়োজনে কিংবা নিছক বিলাস-বিহারে দু’জনে একাকী ঘুরতে যাওয়া – এগুলো সবই পুরোপুরিভাবে হারাম।
তবে এগুলো শুধু দেবর আর ভাবী, কিংবা দুলাভাই আর শালীর ক্ষেত্রেই নয়, বরং প্রত্যেক গায়ের-মাহরাম নারী-পুরুষের জন্যই এগুলো প্রযোজ্য। যেমন কাজিন ভাই-বোন, অর্থাৎ মামাতো, খালাতো, চাচাতো, ফুফাতো ভাই-বোনদের ক্ষেত্রেও এই সমস্ত ব্যাপারে আমাদেরকে সাবধান থাকা উচিত। সেইসাথে ছেলেদের ক্ষেত্রে আপন খালা, ফুফু ছাড়া সমস্ত রকমের খালা, ফুফুর বেলাতেও। এবং আপন চাচী কিংবা মামীর বেলাতেও। একইভাবে মেয়েদের ক্ষেত্রে আপন মামা, চাচা ছাড়া সমস্ত রকমের মামা, চাচার বেলাতেও। এবং নিজের খালু কিংবা ফুফার বেলাতেও।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘‘শুনে রাখো, কোনো পুরুষ যেনো কোনো মহিলার সঙ্গে নিভৃতে একত্রিত না হয়, অন্যথায় শয়তান অবশ্যই তৃতীয় জন হিসাবে হাযির থাকে।’’ (সুনান তিরমীযী ২১৬৮, ইবনু মাজাহ ২৩৬৩)
তিনি (সা.) আরো বলেছেনঃ ‘‘কোনো মহিলা যেনো মাহরাম পুরুষ ছাড়া একাকিনী সফর না করে।’’ (বুখারী ৫২৩৩, মুসলিম ১৩৪১)
তিনি (সা.) আরো বলেছেনঃ “তোমরা সেই মহিলাদের নিকট গমন করো না যাদের স্বামীরা বিদেশে আছে। কারণ, শয়তান তোমাদের রক্তশিরায় প্রবাহিত হয়।’’ (সহীহ তিরমিযী, ৯৩৫; সহীহ ইবনে মাজাহ, আল্লামা আলবানী, ১৭৭৯)
তিনি (সা.) আরো বলেছেনঃ “আমার (ইন্তেকালের) পরে আমার উম্মাতের পুরুষদের জন্য নারী অপেক্ষা অধিক ফিতনার শঙ্কা আর কিছুতেই রেখে যাইনি!’’ (বুখারী ৫০৯৬, মুসলিম ২৭৪০)
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সমস্ত রকমের ফিতনা থেকে বাঁচিয়ে রাখুন।