আজকের বিষয়: সুন্দর ব্যবহার এবং আচার-আচরণের জন্য হাদিসে বর্ণিত পুরস্কার এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা, সুন্দর ব্যবহার ও আচরণের বিনিময়ে জান্নাত
সুন্দর ব্যবহার, সুন্দর আচার-আচরণ মানবজীবনের সৌন্দর্য্যকে ফুটিয়ে তোলে। এ বিষয়ে ইসলাম বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। মার্জিত, উত্তম এবং সুন্দর আচার-আচরণের জন্য হাদিসে বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। দেয়া হয়েছে পুরস্কারপ্রাপ্তির ঘোষনা। আজ সে বিষয়েই সামান্য আলোকপাত করার ইচ্ছে-
এক. মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মুমিনের আমলনামায় সুন্দর আচরণের চেয়ে অধিক ভারী আমল আর কিছুই হবে না। যে ব্যক্তি অশ্লীল ও কটু কথা বলে বা অশোভন আচরণ করে, তাকে মহান আল্লাহ তায়ালা ঘৃণা করেন। আর যার ব্যবহার সুন্দর, সে তাঁর ব্যবহারের কারণে নফল রোযা ও তাহাজ্জুদের সাওয়াব লাভ করবে।’ [সুনানে তিরমিযী]
দুই. প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য এক হাদিসে বলেছেন, ‘সবচেয়ে বেশি যা মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে, তা হলো- মহান আল্লাহ্ তায়ালার ভয় এবং সুন্দর আচরণ। আর সবচেয়ে বেশি যা মানুষকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে, তা হলো- (মানুষের) মুখ এবং লজ্জাস্থান।” [সুনানে তিরমিযী, হাকিম আল মুসতাদরাক]
তিন. অারেক হাদিসে প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ”সুন্দর আচরণ্ই নেক আমল।” [সহীহ মুসলিম]
চার. অন্য একস্থানে প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার আচার-ব্যবহার সুন্দর, সে আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন সে আমার সবচেয়ে কাছে থাকবে।’ [সুনানে তিরমিযী]
পাঁচ. অাল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য এক হাদিসে বলেছেন, ‘অশোভন-অশ্লীল কথা ও আচরণের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। আর যার আচরণ যত সুন্দর তার ইসলাম তত সুন্দর।” [মুসনাদে আহমদ]
ছয়. প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য এক হাদিসে বলেছেন, ‘যার আচার-ব্যবহার সুন্দর, আমি তার জন্য সর্বোচ্চ জান্নাতে
একটি বাড়ির নিশ্চয়তা প্রদান করছি।” [আবু দাউদ]
সাত. প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য এক হাদিসে বলেছেন, ‘যদি কেউ বিনম্রতা ও নম্র আচরণ লাভ করে, তাহলে সে দুনিয়া ও আখেরাতের পাওনা সকল কল্যাণই লাভ করল। আর রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং সুন্দর আচরণ বাড়িঘর ও জনপদে বরকত দেয় এবং আয়ু বৃদ্ধি করে।” [আহমদ]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লা আমাদের সকলকে বর্ণিত হাদিসগুলোর উপর আমল করে সকলের সাথে উত্তম আচার-আচরণে অভ্যস্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন।
প্রশ্নোত্তরে প্রয়োজনীয় এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা যা জেনে রাখা ভালো:
প্রশ্ন এক. কেরোসিন তেল কি পবিত্র, না অপবিত্র? কাপড় বা গায়ে কেরোসিন লাগলে, তা সহ নামাজ পড়া যাবে কি?
উত্তর : কেরোসিন তেল মূলত: নাপাক নয়। কোনো অনুসঙ্গ (নাপাক পদার্থ) তাতে মিশ্রিত হলে কেরোসিন নাপাক হতে পারে। আর কেরোসিন তেল থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা হয় এটির দুর্গন্ধের জন্য। এই একই কারণে দ্রব্যটি মসজিদেও পরিত্যাজ্য। তবে, বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সতর্কতার সাথে মসজিদেও ব্যবহার করা যায়।
প্রশ্ন দুই: প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন কোন খাদ্য বেশি পছন্দ করতেন এবং কোন খাদ্যের গুণ, প্রাণশক্তি ও নিরাময় ক্ষমতা বেশি বলে বর্ণনা করতেন?
উত্তর : হযরত নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট সর্বাপেক্ষা পছন্দনীয় খাদ্যের মধ্যে ছারীদ উল্লেখযোগ্য। গোশতের তরকারিতে টুকরো রুটি মিলিয়ে যে খাদ্য তৈরি করা হয় তাকে ছারীদ বলা হয়। গোশতের মধ্যে হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি পছন্দ করতেন খাসীর সামনের রানের গোশত। তরি-তরকারির মধ্যে তাঁর নিকট সর্বাধিক পছন্দের ছিল লাউ। এছাড়া দুধ, মধু, খেজুর, সিরকা, পনির ইত্যাদি খাবার তিনি আগ্রহভরে খেয়েছেন। শ্রেষ্ঠ খাদ্য হিসেবে দুধের উল্লেখই বেশি পাওয়া যায়, যা একই সাথে খাদ্য এবং পানীয়। প্রিয়নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদ্য গ্রহনের তরিকা সম্পর্কে যেসব আদর্শ রেখে গিয়েছেন তন্মধ্যে মৌলিক কিছু প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে। হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘তোমরা ততক্ষণ খাদ্যগ্রহণ করবে না, যতক্ষণ না তোমরা ভালোরকম ক্ষুধিত হও। যখন খানা খাবে তখন পেটকে তিনভাগে বিভক্ত করে নিও। একটি অংশ খাদ্যের, একটি পানীয়ের, অপর একটি শূন্য রেখো আল্লাহর জিকিরের জন্য, স্বাচ্ছন্দে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য। খেতে বসলে কিছুটা বাকি থাকতেই উঠে পড়। একজনের খানা দু’জনের জন্য যথেষ্ট। দু’জনেরটা যথেষ্ট তিনজনের জন্য’ – হাদিসে বর্ণিত এসব গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা মেনে চললে একজন মানুষ সাধারণত: খাদ্যজনিত কোনো রোগব্যাধির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
প্রশ্ন তিন: কোনো মুসলমান অন্য ধর্মের লোককে সালাম দিতে পারবে কি? যদি পারে, তাহলে তার নিয়ম কি?
উত্তর : একজন মুসলমানের জন্য আল্লাহ তাআ’লার পক্ষ থেকে রহমত, বরকতপূর্ণ সালাম দেওয়ার যে বিধান ইসলামে রয়েছে, তা কেবল মুসলমানদের জন্যই। অমুসলিমকে সালাম দেওয়া যাবে, তবে তা ইসলামের সালাম নয়, সামাজিক ও মানবিক সালাম। এটি প্রচলিত নির্দোষ যে কোনো পন্থায় হতে পারে। বলা হয়, শান্তিপূর্ণ অবস্থায় অমুসলিমদের জন্য সালাম এরকম ‘আসসালামু আলা মানিত্তাবাআল হুদা’। অর্থাৎ, আল্লাহর দেখানো পথ গ্রহণকারী এ সালামের উপযুক্ত। কোনো অমুসলিম সম্ভাষন জানালে তার প্রতিউত্তর, গোনাহ হয় না এমন যে কোনো উপায়ে দেওয়া চলে। অমুসলিম যদি মুসলমানের মতো সালাম উচ্চারণ করে, তাহলে প্রতিউত্তরে সমভাবে সালামের জবাব দেওয়া যায়। তবে তাদের সাথে সালাম বিনিময়ের সময় হেদায়াতের শর্ত ও দুআ অবশ্যই মনে মনে পোষণ করতে হবে।
প্রশ্ন চার: অনেকেই মৃত ব্যক্তির জন্য চল্লিশা/কুলখানি করতে নিষেধ করেন, অবৈধ, বিদআত বলে থাকেন। তাহলে মৃত ব্যক্তিদের রূহে সওয়াব পৌঁছানোর উপায় কি?
উত্তর: মৃত ব্যক্তির রূহে সওয়াব পৌঁছানোর সবচেয়ে উত্তম উপায় তার জন্য দুআ করা। সর্বোত্তম দুআ, ‘হে আল্লাহ আপনি আমাকে, আমার বাবা-মা ও সকল ঈমানদার নারী পুরুষকে ক্ষমা করে দিন।’
কেবল পিতা-মাতার জন্য বলতে হয়, ‘হে আল্লাহ আমার বাবা-মাকে রহম করুন, যেমন তারা আমাকে ছোটবেলা লালন করেছিলেন।’
এছাড়া যতরকম নফল ইবাদত আছে যেমন, কুরআন পড়া, নফল নামাজ-রোজা, দুআ-দরুদ, দান-খয়রাত ইত্যাদি করে তাদের রূহে সওয়াব পৌঁছানোর জন্য আল্লাহ তাআ’লার কাছে দুআ করা যায়। এজন্য তিন দিন, চল্লিশ দিন বা বছর শেষে মৃত্যুর দিন ধার্য করে আমল করা জরুরী নয়। বরং এভাবে না করাই উত্তম। সওয়াব পৌঁছানোর এ প্রক্রিয়া বছরের প্রতিটি দিন নিজের অভ্যাসে পরিণত করে নেওয়াই সন্তান ও আত্মীয় স্বজনের কর্তব্য। যারা নিষেধ করেন, বিদআত বলেন, তারা মূলত: আনুষ্ঠানিকতাকে নিষেধ করেন, সওয়াব পৌঁছানোকে নয়। ইসলামে বিষয়টি এমনই।
প্রশ্ন পাঁচ: অনেকেরই এই বিষয়ে জানার ইচ্ছে যে, নানার আগে মা ইন্তেকাল করলে নাতি/ নাতনী মায়ের ওয়ারিশ পাবে কি না।
উত্তর : এটির উত্তর হচ্ছে, পাবে না। মা না থাকায় অর্থাৎ মা নিজে ওয়ারিশ না হওয়ায় নাতি/নাতনী নানার সম্পত্তি পাবে না। পাওয়ার একটিই উপায় রয়েছে, যদি মায়ের মৃত্যুর পর নানা তাদের নামে ওসিয়ত করে যান। ক্ষেত্রবিশেষে এমন ওসিয়ত করা শরীয়তে বাতলে দেয়া আছে। ওসিয়ত না করলে তারা হকদার হবে না।
সূত্র : জামেউল ফাতাওয়া, ইসলামী ফিক্হ ও ফাতাওয়া বিশ্বকোষ।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লা আমাদের প্রতিটি বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জনের তাওফিক দান করুন এবং কেবল সহি আমলগুলো সঠিক পদ্ধতিতে করার শক্তি দান করে ধন্য করুন।
সুন্দর আচরণ আমরা সবাই প্রত্যাশা করি। কিন্তু আমরা প্রায়ই অন্যের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করতে ভুলে যাই। সামান্য একটু অসতর্কতার কারণে আমাদের আচরণে একজন মানুষ অনেক কষ্ট পেতে পারে। তাই আমাদের সবসময় সচেতন থাকা উচিত; যাতে আমাদের আচরণে কেউ বিন্দুমাত্র কষ্ট না পায়।
যার আচরণ যত বেশি সুন্দর সবাই তাকে তত বেশি ভালোবাসে, সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। যার আচরণ ভালো নয় সবাই তাকে ঘৃণা করে ও এড়িয়ে চলে। সুন্দর ব্যবহার সুন্দরভাবে কথা বলা সুন্দর মনের পরিচয় বহন করে।
মানুষের একটি ভালো কথা যেমন একজনের মন জয় করে নিতে পারে, তেমনি একটু খারাপ বা অশোভন আচরণ মানুষের মনে কষ্ট আসে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসেবে আমাদের উচিৎ সর্বদা মানুষের সঙ্গে ভালো ও সুন্দরভাবে কথা বলা।
সুন্দর ব্যবহারের কারণে যে মুখটি প্রিয় হয়, বিপরীতভাবে অসুন্দর ব্যবহার করায় একই মুখটি অপ্রিয় হয়ে যায়। তাই সবার সঙ্গে সুন্দর আচরণ ও সুন্দর ব্যবহার করতে হবে। সুন্দর আচরণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়, পরকালে বিনিময় হিসেবে মেলে অনন্ত সুখের জান্নাত।
আল কোরআনের সূরা সমূহ বাংলা অনুবাদ, ফজিলত, আয়ত, রুকু আরবি ও বাংলা উচ্চারণ
এ প্রসঙ্গে হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মুমিনের আমলনামায় সুন্দর আচরণের চেয়ে অধিক ভারী আমল আর কিছুই হবে না। যে ব্যক্তি অশ্লীল ও কটু কথা বলে বা অশোভন আচরণ করে, তাকে আল্লাহতায়ালা ঘৃণা করেন। আর যার ব্যবহার সুন্দর, সে তার ব্যবহারের কারণে নফল রোজা ও তাহাজ্জুদের সওয়াব লাভ করবে। ’ -সুনানে তিরমিজি
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘সবচেয়ে বেশি যা মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে তা হলো- আল্লাহতায়ালার ভয় ও সুন্দর আচরণ। আর সবচেয়ে বেশি যা মানুষকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে তা হলো- (মানুষের) মুখ এবং লজ্জাস্থান। ’ -সুনানে তিরমিজি
হজরত রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সুন্দর আচরণই নেক আমল। ’ –সহিহ মুসলিম
হাদিসে রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার আচার-ব্যবহার সুন্দর, সে আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন সে আমার সবচেয়ে কাছে থাকবে। ’ -সুনানে তিরমিজি
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও ইরশাদ করেন, ‘অশোভন-অশ্লীল কথা ও আচরণের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। আর যার আচরণ যত সুন্দর তার ইসলাম তত সুন্দর। ’ -মুসনাদে আহমদ
আরেক হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার আচার-ব্যবহার সুন্দর, আমি তার জন্য সর্বোচ্চ জান্নাতে একটি বাড়ির নিশ্চয়তা প্রদান করছি। -সুনারে আবু দাউদ
হজরত রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যদি কেউ বিনম্রতা ও নম্র আচরণ লাভ করে, তাহলে সে দুনিয়া ও আখেরাতের পাওনা সব কল্যাণই লাভ করল। আর রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং সুন্দর আচরণ বাড়িঘর ও জনপদে বরকত দেয় এবং আয়ু বৃদ্ধি করে। ’ –আহমদ