আজকের বিষয়: সূরা নাস কতো বার পাঠ করলে কোন আলম ও ফজিলত, সূরা নাস নাযিলের কারন গুলো কি কি ,কুরআন ১১৪ সূরা আল – নাস
আল-নাস শব্দের অর্থ মানব জাতি। সূরা নাস কোরআন শরীফের সর্বশেষ সূরা অর্থাৎ ১১৪ নং সূরা। এর আয়াত সংখ্যা ৬, রুকু সংখ্যা ১ এবং এই সূরায় ২০টি শব্দ এবং ৮০টি অক্ষর রয়েছে। এটি ৩০ পারার অন্তর্ভূক্ত একটি সূরা। এ সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই সূরার প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। এবং পরের তিনটি আয়াতে মানুষের আকারে জিন ও শয়তানের চক্রান্ত থেকে আল্লাহর আশ্রয় নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আজ আমরা সূরা নাস এর আরবি উচ্চারণসহ বাংলা অনুবাদ এবং সূরা নাস নাযিলের প্রেক্ষাপট ও এই সূরা পাঠের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সমূহ নিয়ে আপনাদেরকে কিছু জানানোর চেষ্টা করবো। তো চলুন শুরু করি-
এই সূরায় আল্লাহ তায়ালার তিনটি গুণাবলী মানুষের পালনকর্তা, মানুষের অধিপতি, মানুষের উপাস্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি তিনটি আয়াতে শয়তানের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
পূর্ববর্তী সূরা ফালাকের বিষয়বস্তুর মধ্যে এই সূরার যথেষ্ঠ মিল রয়েছে। হাদিসে সূরা নাস এবং সূরা ফালাক বারবার পড়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এই দুটি সূরাকে একত্রে মুআওবিযাতাইন বলা হয়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এই দুটি সূরা পাঠ করতে থাক। কারণ, এই দুটি সূরার মত কোন সুরা কখনোই পাবেন না। ‘(মুসলিম ৮১৪)
আল কোরআনের সূরা সমূহ বাংলা অনুবাদ, ফজিলত, আয়ত, রুকু আরবি ও বাংলা উচ্চারণ
সূরা নাস
আরবিঃ بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
উচ্চারণঃ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
অনুবাদঃ পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
আরবিঃ قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ
উচ্চারণঃ কুল আউযু বিরাব্বিন নাস
অনুবাদঃ বলুন, আমি আশ্রয় চাই মানুষের পালনকর্তার।
আরবিঃ مَلِكِ النَّاسِ
উচ্চারণঃ মালিকিন্ নাস
অনুবাদঃ মানুষের অধিপতির।
আরবিঃ إِلَهِ النَّاسِ
উচ্চারণঃ ইলাহিন্ নাস
অনুবাদঃ মানুষের মা’বুদের।
আরবিঃ مِن شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ
উচ্চারণঃ মিন্ শররিল ওয়াস্ ওয়াসিল খান্নাস
অনুবাদঃ তার অনিষ্ট থেকে, যে কুমন্ত্রণা দেয় ও আত্নগোপন করে।
আরবিঃ الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ
উচ্চারণঃ আল্লাযী ইউওযাসবিসু ফী ছুদুরিন্নাস
অনুবাদঃ যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে।
আরবিঃ مِنَ الْجِنَّةِ وَ النَّاسِ
উচ্চারণঃ মিনাল জিন্নাতি ওয়ান্নাস
অনুবাদঃ জ্বিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে।
সূরা নাস এর শানে নুযূল
এই সূরাটি অনুসরণ করে একজনকে যাদুকরী বা অন্যের মন্দ থেকে রক্ষা করা যায়। যে প্রেক্ষাপটে দুটি সূরা নাযিল হয়েছিল, তা হল হুদায়বিয়ার ঘটনার পর লাবীদ ইবনে আসাম এবং তার কন্যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে মুগ্ধ করে। ফলস্বরূপ, তিনি কিছুটা ব্যথা অনুভব করেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফেরেশতাদের মাধ্যমে, আল্লাহ জাদুকরের নাম প্রকাশ করেছেন এবং কোথায় এবং কিভাবে জাদু করা হয়েছিল তার বর্ননা দিয়ে দেন। জাদুটি একটি চিরুনি এবং চুলের সাহায্যে করা হয়েছিল, যা জারওয়ান কূপের নীচে একটি পাথরের নিচে চাপা দেওয়া হয়েছিল। এই অসুস্থতার সময় এই দুটি সূরা নাযিল হয়েছিল। দুটি সূরা নাযিল হওয়ার পর ফেরেশতাদের বর্ণনা অনুযায়ী এটিকে কূপ থেকে বের করে আনা হয়েছিল। তারপর সেই দুটি সূরা পাঠ করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুলের মধ্যে ফু দিলে চুলের গিটু খুলে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। এই দুটি সূরা পাঠের মাধ্যমে যে কেউ অনিষ্ট ও জাদু থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। হাদিস শরীফ অনুযায়ী প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তা পাঠ করা জরুরী। একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি সকাল -সন্ধ্যা সূরা ইখলাস পাঠ করবে এবং এই দুটি সূরা পাঠ করবে তবে সে সব বিপদ থেকে নিরাপদ থাকবে। [জামে তিরমিযী, হাদিস: ২৯০৩;
সূরা নাস পাঠের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
সূরা নাস ও সূরা ফালাক কোরআনের অন্যতম সেরা মু’জেযা। এতে আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের অমূল্য উৎস রয়েছে। যা আধুনিক পাশ্চাত্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এই সূরা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে মানুষ তার মানসিক প্রতিক্রিয়া দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। যা ভালো ও মন্দ উভয় উপায়েই পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, লাবিদ ইবনে আসামের দ্বারা সম্পাদিত যাদু রাসূল (সঃ) -এর উপর খারাপ প্রতিক্রিয়া করেছিল।
অন্যদিকে, সূরা ফালাক ও সূরা নাস তাঁর উপর ভালো প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। যাতে তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। এটি প্রমাণ করে যে মানসিক ওষুধ মানবদেহে শারীরিক ওষুধের চেয়ে দ্রুত কাজ করে। এমনকি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে কোন রোগের নিরাময় রোগীর মানসিক শক্তির উপর ৮০ ভাগ নির্ভর করে। এমনকি ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতেও রোগীর দৃঢ় মানসিক শক্তির কারনে ব্যথা উপশম হয়। ইউরোপ-আমেরিকায় এখন রোগীকে মানসিক ওষুধ দেওয়া হচ্ছে যে আপনি বারবার বলুন, ‘আমার কোন অসুস্থতা নেই, আমি সুস্থ আছি’। এতে প্রমানিত হয়েছে যে মানসিকভাবে শক্তিশালী লোকজন দ্রুত সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
কোরআন অনেক আগে থেকেই মনোরোগের পথ দেখিয়েছে। এর বিপরীতে, আল্লাহ পুরো কোরআনকে ‘শিফা’ এবং ‘রহমত’ অর্থাৎ ঈমানদারদের জন্য ‘নিরাময়’ এবং ‘অনুগ্রহ’ বলেছেন (বানু ইসরা’ল ১৭/৮২)। সূরা ফালাক এবং সূরা নাস এই দুটি পবিত্র কোরআনের এক অনন্য সূরা এই দুটি সুরা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি অদম্য গাইড এবং মানব কল্যাণের অক্ষয় উৎস হিসেবে বিবেচিত হবে। যদি না মানুষ আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাসী হয় এবং তাকে গভীরভাবে বিশ্বাস করে। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন-আমীন!
এক সময় এক ইহুদী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর উপর একটি মন্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। জিব্রাইল (আঃ) নবী (সাঃ) কে বলেছিলেন যে একজন ইহুদী তাকে জাদু করেছে এবং যে জিনিস দিয়ে তাকে মোহিত করা হয়েছে তা একটি কূপের একটি পাথরের নিচে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই জিনিসটি কূপ থেকে উদ্ধারের জন্য লোক পাঠিয়েছিলেন। সেখানে কয়েকটি গিঁট পাওয়া গেছে। তারপর তিনি একসাথে সূরা নাস এবং সূরা ফালাক পাঠ করলেন এবং ফুঁ দিলেন এবং সাথে সাথে গিঁট খুলে গেল এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বিছানা থেকে সেরে উঠলেন।
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রতি রাতে বিছানায় যেতেন, তখন তিনি তাঁর উভয় হাত একসাথে রাখতেন। তারপর তিনি দুই হাত দিয়ে ফুঁ দিতেন এবং সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক, সূরা নাস পড়তেন। তারপর যতটা সম্ভব তার শরীরে হাত বুলিয়ে দিতেন। তিনি মাথা, মুখমন্ডল এবং শরীরের সামনে থেকে শুরু করতেন। তিনি এরকম তিনবার করতেন। (সহীহ বুখারী)
ফজর ও মাগরিবে ফরজ নামাজের পর সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস তিনবার পাঠ করা সুন্নাত। অন্যান্য ফরজ নামাজ আদায়ের পর এই তিনটি সূরা একবার পাঠ করা উচিত। (আবু দাউদ হা: ১৩৬৩)
যদি সূরা নাস পাঠ করা হয়, তাহলে শয়তানের কুফল ও যাদু থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, “যে ব্যক্তি সূরা ইখলাস এবং এই দুটি সূরা (সূরা ফালাক ও সূরা নাস) সকাল-সন্ধ্যা পাঠ করবে সে সকল বিপদ থেকে নিরাপদ থাকবে।” (জামে তিরমিযী, হাদিস: ২৯০৩)
হযরত উকবা ইবনে আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তুমি কি জান না যে আজ রাতে আমার প্রতি নাযিল হওয়া আয়াতের মত আর কোন আয়াত দেখা বা শোনা হয়নি? আর তা হল কুল আইজু বি রাব্বিল ফালাক এবং কুল আইজু বি রাব্বিন নাস। (সহীহ মুসলিম: ৮১৪)
আমরা আজ এখানে সূরা আল নাসের আরবি উচ্চারণসহ বাংলা অনুবাদ নিয়ে আপনাদেরকে কিছু জানানোর চেষ্টা করেছি। আশা করি কিছু জানার সুযোগ হয়েছে। আপনাদের ভালো লাগাই আমাদের স্বর্থকতা। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে শুদ্ধ আমল করার তৌফিক দান করুক।