প্রতি বছর বিশ্বে ২৮ লাখেরও বেশি মানুষ স্থূলতা বা শরীরে অতিরিক্ত ওজন হওয়ার জন্য মৃত্যুবরণ করে। শরীরে অতিরিক্ত মেদ অনেক ক্রনিক রোগ যেমন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, যকৃতের রোগ, নানা ধরনের ক্যান্সারের কারণ। স্থূলতার ঝুঁকি ও করণীয় নিয়ে লিখেছেন প্রফেসর ডা. এইচ. এন. সরকার। ধারাবাহিক এ প্রতিবেদনটির প্রথম পর্বে স্থূলতার কারণ ও প্রাথমিক প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনা করা হলো।
লিপিড বা চর্বি শরীরের জন্য অপরিহার্য; তবে অতিরিক্ত চর্বি স্থূলত্ব সৃষ্টি করে। স্থূলত্ব মানে শরীরে অতিরিক্ত মেদ। যদি কোনো ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে ক্যালরি ব্যয়ের চেয়ে অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ করে, তবে সে মোটা হয়ে যায় অর্থাৎ স্থূলত্ব দেখা দেয়। এই অতিরিক্ত ক্যালরি শরীরে ফ্যাট হিসাবে জমা হয়।
স্থূলতা কতটা মারাত্মক,স্থূলতা একটি মারাত্মক রোগ,অতিস্থূলতা বর্তমানে এক মারাত্মক সমস্যা,স্থূলতা যখন কিডনি রোগের কারণ
স্থূলতা একটি শারীরিক ব্যাধি। স্থূলতা বিভিন্ন পরিমাপ দিয়ে যেমন বিএমআই (Body Mass Index-BMI), কোমর পরিধি, কোমর-নিতম্বের অনুপাত এবং চর্মের পুরুত্ব ইত্যাদি দ্বারা নির্ণয় করা যায়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থূলতার কারণ অজানা, যাকে আমরা ইডিওপ্যাথিক বা প্রাইমারি স্থূলতা বলি; তবে জেনেটিক ফ্যাক্টরটি এ ইডিয়োপ্যাথিক স্থূলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোনো একক জিনই এজন্য দায়ী নয়, স্থূলত্বার জন্য বহু জিন দায়ী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থূলতার জন্য হরমোনজনিত ব্যাধি এবং ওষুধ দায়ী, যা পরিবর্তনযোগ্য। এগুলো হলো-
হরমোনজনিত ব্যাধি
* হাইপোথাইরয়েডিজম
* কুশিং সিন্ড্রোম
* ক্রানিওফ্যারিঞ্জিওমা
ওষুধ : স্টেরয়েড, সোডিয়াম ভ্যালপ্রয়েট, বিটা ব্লকার, ইনসুলিন, সালফোনাইলইউরিয়া ও থায়াযলিডিডিয়ন।
স্থূলত্ব হলো কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (করোনারি আর্টারি ডিজিজ, স্ট্রোক এবং হাইপারটেনশন) এবং করোনারি হার্ট ডিজিজের জন্য একটি বড় ঝুঁকি। হৃদরোগ হলো স্থূল রোগীর মৃত্যুর প্রধান কারণ, তবে ক্যান্সারের হারও মাত্রাতিরিক্ত ওজন রোগীর বেশি, বিশেষত পুরুষদের বেলায় বৃহদ্রন্ত্রের (কালোরেক্টাল) ক্যান্সার এবং মহিলাদের বেলায় পিত্তথলি, পিত্তনালি, স্তন, জরায়ু মুখ এবং এন্ডোমেট্রিয়াম ক্যান্সার। স্থূলতা আয়ু হ্রাস করে। ৪০ বছর বয়সে স্থূলত্ব অধূমপায়ীদের আয়ু ৭ বছর এবং ধূমপায়ীদের আয়ু ১৩ বছর হ্রাস করতে পারে। স্থূলত্ব রোগীর জীবন এবং কর্মের ওপর একটি বড় প্রভাব ফেলে।
আরো পড়ুন: পুরুষাঙ্গের বড় করার ব্যায়াম
প্রতিরোধ
দীর্ঘ সময় ধরে প্রতি বছর একটু একটু করে ওজন বৃদ্ধির ফলে যে স্থূলতা তৈরি হয়, তা চিকিৎসা করা কঠিন। দৈনিক মাত্র ৫০-২০০ কিলোক্যালরি (মোট শক্তির <১০ শতাংশ) অতিরিক্ত শক্তি গ্রহণ করলে ৪-১০ বছরে ২-২০ কেজি ওজন বাড়বে। তাই প্রথম থেকেই ওজন বৃদ্ধি এড়ানো ভালো। খুব ছোটবেলা থেকেই মনোযোগ দেওয়া উচিত, তবে ওজন বাড়ার ঝুঁকিগ্রস্ত অল্প বয়সিদের মধ্যে এই প্রাথমিক প্রতিরোধ শুরু করাও খুব বেশি দেরি নয়।
অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলত্ব চিকিৎসা এবং পরবর্তী প্রতিরোধের চেয়ে প্রাথমিক প্রতিরোধই ভালো। কারণ একবার ওজন বৃদ্ধি পেলে তা হ্রাস করা কঠিন এবং যদিও অর্জন করা সম্ভব হয় তবে তা বজায় রাখা খুব কঠিন।
প্রাথমিক প্রতিরোধের লক্ষ্য হলো শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখা অর্থাৎ শক্তি ব্যয়ের সমান শক্তি গ্রহণ করা উচিত।
প্রাথমিক প্রতিরোধে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো অন্তর্ভুক্ত-
স্বাস্থ্য শিক্ষা : সন্তান, পিতামাতা, লক্ষ্য জনগোষ্ঠী ও সাধারণ জনগণকে স্থূলতার বিরূপ প্রভাব, সুস্থ খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্যশিক্ষা দিতে হবে।
আরো পড়ুন: সন্তান জন্মদানের পর সহবাস
জীবনযাত্রার পরিবর্তন : জীবনধারার পরিবর্তন স্থূলতা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য টেলিভিশন দেখা এবং কম্পিউটার ব্যবহারের সময় কমিয়ে আনতে হবে। নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম যেমন হাঁটাচলা, সাঁতার কাটা বা বাগানে কাজ ইত্যাদি করতে হবে। খাদ্যতালিকা পরিবর্তন যেমন উচ্চ চর্বিযুক্ত, উচ্চশক্তিঘন খাবার এবং চিনি পরিহার পরিহার করতে হবে।
শিশু এবং কৈশোরবস্থায় স্থূলত্ব প্রতিরোধের পদক্ষেপগুলো-
পিতামাতার তাদের বাচ্চাদের স্বাস্থ্য এবং ওজন সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত এবং অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলত্ব প্রতিরোধ করার জন্য ওজন বৃদ্ধি রোধে খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। একইসঙ্গে, তাদের অত্যধিক সতর্কতা অবলম্বন করে খাদ্যে গুরুতর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত নয়, যাতে অপুষ্টি দেখা দিতে পারে।
শৈশব এবং কৈশোরে অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলত্ব প্রতিরোধে বাবা-মায়েরা নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপগুলো নিতে পারেন।
* খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনধারা পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করুন।
* ওজনের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ না করে পারিবারিক খাদ্যাভ্যাস এবং ক্রিয়াকলাপের স্তর পরিবর্তন করতে ধীরে ধীরে কাজ করুন। অভ্যাস পরিবর্তন করুন এবং ওজন নিজে নিজের যত্ন নেবে।
* আপনি নিজেই আদর্শ দৃষ্টান্ত হন। যেসব পিতামাতা স্বাস্থ্যকর খাবার খান এবং শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকেন, তাদের বাচ্চারাও এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এগুলো আপনাকেও সুস্থ থাকতে এবং অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলত্ব প্রতিরোধ করতে সহায়তা করবে।
আরো পড়ুন: মাথা ব্যথার দোয়া,মাথা ব্যথা দূর করার দোয়া
খাদ্যাভ্যাস
* শিশুদের কেবল ক্ষুধার্ত হলেই খেতে এবং আস্তে আস্তে খেতে উৎসাহিত করুন।
* পুরস্কার হিসাবে খাবার দেওয়া বা শাস্তি হিসাবে খাদ্য রোধ করা এড়িয়ে চলুন।
* চিনি ও ফ্যাটসমৃদ্ধ কোমল পানীয় এবং স্ন্যাকসের পরিবর্তে ফ্রিজে চর্বিহীন বা স্বল্প চর্বিযুক্ত দুধ এবং তাজা ফল ও শাকসবজি রাখুন।
* প্রতিদিন মাঝারি আকারের কমপক্ষে পাঁচ টুকরো ফল বা আধা কাপ ফলের রস এবং এক কাপ কাঁচা শাকসবজি বা আধা কাপ রান্না করা শাকসবজি বাচ্চাকে পরিবেশন করুন।
* চিনিযুক্ত পানীয় যেমন সফট ড্রিঙ্কস, স্পোর্টস ড্রিঙ্কস এবং ফলের রসের চেয়ে শিশুদের জল খেতে উৎসাহিত করুন।
শারীরিক কার্যকলাপ
* শারীরিক ক্রিয়াকলাপকে উৎসাহিত করুন। বাচ্চাদের সপ্তাহের অধিকাংশ দিন এক ঘণ্টা করে মাঝারি ধরনের ব্যায়াম করা উচিত। এতে ওজন হ্রাস এবং পরবর্তীতে ওজন ঠিক রাখতে সহয়তা করে।
* মোটর গাড়ির পরিবর্তে হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দিন।
* খেলাধুলা এবং গৃহস্থালির কাজে বাচ্চাদের সংযুক্ত হতে উৎসাহিত করুন।
* টেলিভিশন ও কম্পিউটারের সামনে বসার সময় কমিয়ে দিনে দু’ঘণ্টার কম করুন।
প্রাপ্তবয়স্কদের স্থূলত্ব প্রতিরোধের পদক্ষেপ
* বেশ কয়েকটি কৌশল রয়েছে, যা সফলভাবে ওজন হ্রাস এবং রক্ষণাবেক্ষণ করে, যা স্থূলত্ব প্রতিরোধে সহায়তা করে। আপনার খাদ্যাভ্যাসের উন্নতি এবং অধিক শারীরিক ক্রিয়াকলাপ স্থূলত্ব প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
খাবারের অভ্যাস
* বেশি শক্তিঘন খাবারগুলো এড়িয়ে চলুন অর্থাৎ স্বল্প পরিমাণ খাদ্যে বেশি ক্যালরি যেমন বার্গার।
* পুরো শস্য জাতীয় খাবার যেমন ব্রাউন রাইস এবং গোটা গমের রুটি বেছে নিন। উচ্চ প্রক্রিয়াজাত খাবার যা সাদা চিনি, ময়দা এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট দিয়ে তৈরি, সেগুলো এড়িয়ে চলুন।
* প্রতিদিন মাঝারি আকারের কমপক্ষে পাঁচ টুকরো ফল বা আধা কাপ ফলের রস এবং এক কাপ কাঁচা শাকসবজি বা আধা কাপ রান্না করা শাকসবজি গ্রহণ করুন।
* ফাস্টফুড রেস্তোরাঁগুলোতে বড় আকারের মেনু আইটেমগুলো এড়িয়ে চলুন।
* খাবারের চেকবুক তৈরি করুন। শক্তির জন্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ক্যালরি খাওয়ার ফলে ওজন বাড়ে।
শারীরিক ক্রিয়াকলাপ
* সপ্তাহে অধিকাংশ দিন, সম্ভব হলে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট বা ততধিক মাঝারি ধরনের ব্যায়াম বা কাজ করুন যেমন ১৫ মিনিটে এক মাইল বেগে হাঁটা, বা বাগানের আগাছা নিড়ানো এবং মাটি কোপানো।
* দিনের বেলায় ক্যালোরি ব্যয় করে এমনকি কিছু কার্যকলাপ যেমন কর্মস্থলে ১০ বা ১৫ মিনিটের জন্য অফিস ব্লকের চারপাশে হাঁটা বা সিঁড়িতে ওঠানামা করার সুযোগ তৈরি করুন।
টেলিভিশন ও কম্পিউটারের সামনে এবং টেবিলে বসে কাজের সময় কমিয়ে দিনে দু’ঘণ্টার কম করুন।
* নিয়মিত নিজের ওজন করুন।
স্থূলতার শ্রেণিবিভাগ
বিএমআই (কেজি/ওজন, মিটার উচ্চতা)
১৮ অথবা তার নিচে — আন্ডার ওয়েট
১৮ থেকে ২৫ — স্বাভাবিক ওজন
২৫ থেকে ৩০ — অতিরিক্ত ওজন
৩০ থেকে ৩৫ — স্থূলতা-ক্যাটাগরি-১
৩৫ থেকে ৪০ — স্থূলতা-ক্যাটাগরি-২
৪০ বা তার বেশি — প্রাণঘাতী স্থূলতা
শ্রেণিবিন্যাস
স্বাভাবিক
মাত্রাতিরিক্ত ওজন
স্থূলতা
ক্লাস ওয়ান স্থূলতা
ক্লাস টু স্থূলতা
ক্লাস থ্রি স্থূলতা
সম্প্র্রতি এশিয়ানদের জন্য ডব্লউও (WHO) বিএমআই (BMI) ২৩.০ এর ওপরে মাত্রাতিরিক্ত ওজন এবং ২৫.০ এর ওপরে স্থূলকায় ধরার সুপারিশ করেছেন।
স্থূলতার ফলাফল ও জটিলতা
মেকানিক্যাল :
ষদুর্ঘটনার প্রবণতা
ষভেরিকোজ শিরা
ষমাঝা ব্যথা
ষহাঁটু এবং ঊরুসন্দ্বির প্রদাহ
ষঘুমের মাঝে শ্বাস বন্ধ
ষহায়টাস হার্নিয়া
কার্ডিওভাসকুলার :
ষউচ্চ রক্তচাপ
ষঅতিরিক্ত চর্বি
ষহৃদরোগ
ষস্ট্রোক
ষহার্ট ফেইলুর
মনস্তাত্ত্বিক :
ষসামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং হতাশা
ষখাওয়ার ব্যাধি (eating disorder)
এন্ডোক্রাইন :
* বহুমূত্র (ডায়াবেটিস মেলিটাস-টাইপ ২)
* মাসিকে অস্বাভাবিকতা
* পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম (মহিলা)
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল :
* হায়টাস হার্নিয়া
* গ্যাস্ট্রো-ওসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ
* অ্যালকোহলযুক্ত ফ্যাটি লিভার
* পিত্তথলির রোগ
* ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়
* রোগব্যাধি এবং মৃত্যুর হার বাড়ায়।
আপনার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক আরো কিছু পোস্ট