স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তাৎপর্য, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও তার তাৎপর্য
নিঃসন্দেহে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র একটি ঐতিহাসিক ও অনন্য দলিল। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল এই ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ প্রণীত হয়।
১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীন ও সাংবিধানিক সরকার গঠন করা হয়, যা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে প্রথম গণতান্ত্রিক ও আইনানুগ সরকার।
ঢাকায় পাকিস্তান পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার ও আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সমঝোতার নাটক ব্যর্থ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন।
ঐ কালরাতে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক ও কোর কমান্ডার লে. জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে জেনারেল রাও ফরমান আলির নেতৃত্বে ঢাকায় রাত ১১টা ৩০ মিনিটে শুরু হয়ে যায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্মম হত্যাযজ্ঞ।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কেন্ট ব্লাড ২৭ মার্চ ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টে একটি টেলিগ্রাম পাঠান, যার শিরোনাম ছিল ‘সিলেক্টিভ জেনোসাইড’।
৬ এপ্রিল দ্বিতীয় টেলিগ্রাম পাঠানো হয়, শিরোনাম ছিল ‘ব্লাড’। ২৫ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত যে নৃশংস গণহত্যা চালানো হয়, যেখানে মানবতা ও গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভূলণ্ঠিত করা হয়।
’৭১-এর ২৬ মার্চ ১২টা ২০ মিনিটে (প্রথম প্রহর) পাকিস্তান পার্লামেন্টের মেজরিটি পার্টির লিডার আওয়ামী লীগের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন।
আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছো, যাহার যাহা কিছু আছে, তাহাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো …….. (অনূদিত)’—শেখ মুজিবুর রহমান। অতঃপর রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। (সূত্র :উইটনেস অব স্যারেন্ডার, লেখক :ব্রিগেডিয়ার সালেক সিদ্দিক)।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তাটি তাত্ক্ষণিকভাবে মগবাজার ওয়্যারলেস স্টেশনে পাঠানো হয়। উক্ত স্বাধীনতার বার্তা ওয়্যারলেসের ডিএইচএফ চ্যানেলে মগবাজার থেকে ভোরে চট্টগ্রামের সলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনে পাঠানো হয়। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারকৃত অবস্হায় ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের লয়ালপুর জেলে স্হানান্তর করা হয়।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও তার তাৎপর্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইন্টিলিজেন্স স্পট রিপোর্ট ৪৩-এর ১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয় :পাকিস্তানের পূর্ব অংশকে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন।
১ এপ্রিল একটি সামরিক কার্গো বিমানে তাজউদ্দীন আহমেদ, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, বিএসএফের ডিজি কে এফ রুস্তমজী ও আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার দিল্লির উদ্দেশে কোলকাতা বিমান বন্দর ত্যাগ করেন। ৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত্ করেন। তাজউদ্দীন আহমদকে স্বাগত জানান এবং জানতে চান ‘হাউ ইজ শেখ মুজিব? ইজ হি অল রাইট?’
জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তার স্হান থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন (সূত্র :মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, লেখক :ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম)। উভয়ে প্রবাসী সরকার গঠনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছান।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট বলে বিবেচিত হয়। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপ্রধান এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মোতাবেক কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সব দায়িত্ব উপরাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র এখন সম্পূর্ণ আকারে বাংলাদেশের সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়। এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে ঘােষিত স্বাধীনতার সনদের তাৎপর্য উল্লেখ কর
একটি বিশেষ অধিবেশনে ’৭০-এর জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত ১৬৭ সদস্য এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ২৯৮ সদস্যের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়।
এই অধিবেশনে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ‘প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র) অনুমোদন করা হয়, যা অন্তবর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে গণ্য করা হলো। এই সংবিধান ৪০৪ জন গণপরিষদ সদস্য কতৃর্ক স্বাক্ষরিত হয়, যার মূল ভিত্তি হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার।
১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্হিতিতে মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়, যা মুজিবনগর সরকার হিসেবে পরিচিতি পায়।
গণপরিষদের হুইপ ইউসুফ আলী ‘প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র) পাঠ করেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রক্রিয়ায় আইনি দলিল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
২৬ মার্চ স্বাধীনাতা ঘোষণার পর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত জনপ্রতিরোধ শুরু হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়, উক্ত যুদ্ধে সহায়তাকারী বন্ধুপ্রতিম ভারত সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রে উক্ত সরকারের ভূমিকা ছিল অনন্য।
এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং এম এ রবকে চিফ অব আর্মি স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হয়। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় এবং ১১ জন সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯৭৬ সালের ৪ জুলাই ফিলাডেলফিয়ার দ্বিতীয় মহাদেশীয় কংগ্রেসে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয়। ১৭৭৬ সাল থেকে অদ্যাবধি ১২১টি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণাপত্রের আংশিক অনুকরণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কেবিনেটের সঙ্গে পরামর্শ-পূর্বক উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন এবং মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মানি সিংহ ও মোজাফ্ফর আহমেদকে সদস্য হিসাবে অন্তভুর্ক্ত করা হয়।
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল কোলকাতা পাকিস্তান মিশনের ডেপুটি হাইকমিশনারের নেতৃত্বে ৫০ জন কর্মকর্তা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। উক্ত হাইকমিশনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং কয়েক সপ্তাহ পর দিল্লি পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রথম সচিব রেজাউল করিম ও শাহাবুদ্দিন আহমেদ পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা
হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে চীন সফর করেন। চীন-মার্কিন সম্পর্ক উন্নয়নে পাকিস্তান মধ্যস্হতা করে। এ ঘটনায় ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। হিমালয়ের তুষার ও সোভিয়েটের বন্ধুত্ব—এ দুটি ছিল চীনের বিরুদ্ধে ভারতের রক্ষাকবচ। ফলশ্রুতিতে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিজয় ত্বরান্বিত করে।
পর্বতপ্রমাণ কফিনের নিচে অখণ্ড পাকিস্তানের কবর রচিত হয়। ৩০ লাখ শহিদের তপ্ত তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা উপাখ্যানের পশ্চাতে রয়েছে মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, বলিষ্ঠ নেতৃর্ত্ব এবং জাতীয় চার নেতা: সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানের কূটনৈতিক প্রজ্ঞা এবং অপরিসীম আত্মত্যাগ।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজির নেতৃত্বে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য অস্ত্রসহ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিত সিং আরোরা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান এ কে খন্দকারের উপস্হিতিতে বিকাল ৪া ৩১ মিনিটে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। উক্ত দলিলে জেনারেল অরোরা প্রতিস্বাক্ষর করেন। বিশ্বের মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।