হারিয়ে যাচ্ছে জলের পাখি কালিম

কালিম। আবহমান বাংলার এক জলচর পাখি। অনেকে ডাকে কালেম বলে। এই পাখি খুবই দুঃসাহসী, লড়াকু ও মারকুটে স্বভাবের। তবে এদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একবার পোষ মানলে আর উড়ে যায় না। এরা জল এবং ডাঙ্গা দুই জায়গায়ই থাকে। এক সময় ভারতের মেঘালয় রাজ্য ঘেঁষা শেরপুরের নালিতাবাড়ী পাহাড়ি এলাকায় এদের অবাধ বিচরণ ছিল। কিন্তু এখন আর দেখা মিলে না।

অনেকের ধারণা, এরা অতিথি পাখি। এ ধারণাটি রটিয়ে দিয়েছে পাখি শিকারিরা। অতিথি  পাখির নাম শুনলে ভোজন শিকারিদের জিভে জল আসে। বিক্রি করতে সুবিধা হয়। দামেও বেশি পাওয়া যায়।

প্রকৃত তথ্যটি হচ্ছে, কালেম বা কালিম হলো জলাভূমির পাখি। এরা আমাদের দেশীয় জলচর পাখি। স্বভাবে বুনো হলেও পোষ মানে। মুক্ত অবস্থায় পাখিগুলো দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে। জলের ছোঁয়ায় এ পাখির রূপের ঝলক আরো বেড়ে যায়। এ সুন্দর প্রজাতির পাখিদের বছর পঁচিশ আগেও দেশের শেষ সীমান্তবর্তী উপজেলা নালিতাবাড়ী গারো পাহাড়ি অঞ্চলে প্রচুর সংখ্যায় দেখা যেতো। কিন্তু বর্তমানে এদের দেখা মেলে না। অবাধ শিকার, চারণ ভূমির দূষণ আর দখলে এখন এরা বেশ কোণঠাসা কয়েকটি হাওরাঞ্চলে।

১৯৮৮-৮৯ খ্রি. পর্যন্ত সীমান্তবর্তী উপজেলার বড়ডুবি, নয়াবিল, কালাকোমা, পৌড়াগাঁও, নুন্নী, সমচ্চুড়া, মায়াঘাষি, টাকিমারি, পানিহাতা, হাতিপাগাড়, পৌরশহরের গড়কান্দা নালিতাবাড়ীর বিভিন্ন হাটবাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি হতো কালিম পাখি। শিকারিরা পোষা কালিম দিয়ে কালিম শিকাড় করত। পোষা কালিম বিভিন্ন আবদ্ধ পানি যেমন- বিল, ডোবা প্রভৃতি স্থানে ছেড়ে দিতো। বন্য কালিম পেলে কালিমকে পেঁচিয়ে ডাক চিতকার করলে শিকারী গিয়ে কালিম ধরত।

    তথ্যনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার পাহাড়ী অঞ্চলে কালিম ধরা, মারা, বেচা-বিক্রি চলে আসছিল দীর্ঘদিন থেকে। অসাধু শিকারিদের জন্যই পাখিটি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। অথচ বন্যপ্রাণী আইনে দেশের যে কোনো পাখি ধরা মারা বিক্রি ও পোষা দণ্ডনীয় অপরাধ। এরপরেও এ বিরল প্রজাতির পাখিগুলো পাহাড়ী অঞ্চলে পোষতে দেখা যায়। সাধারণত ১০-১০০টির দলে দেখা যায়। তবে প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় অথবা ছোট দলে বিচরণ করে। এসব দলে বেশ কয়েকটি প্রজননক্ষম পুরুষ ও স্ত্রী সদস্য থাকে। এসব দলে অপ্রাপ্তবয়স্ক কালেমও থাকতে পারে।

    ভোরে ও সন্ধ্যায় কালিম পাখির ডাকাডাকি ও গতিবিধি বেড়ে যায়। অন্যসব জলচর পাখির সাথে মিলে এরা খাবার খুঁজে বেড়ায়। এরা উড়তে পছন্দ করে না। তবে উড়ে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে সক্ষম। এরা খুব ভাল সাঁতারও জানে। এদের পা লিপ্তপদ না হলেও এরা সেই তুলনায় চমৎকার সাঁতার কাটতে পারে।

    বর্ষাকালই হলো কালিম পাখির প্রধান প্রজনন ঋতু। ‘জোড়’ না মিললে বা ভালো সঙ্গী না পেলে এরা ডিম পাড়ে না। মজার বিষয় হচ্ছে, স্ত্রী কালিমের মন জয় করে তবেই পুরুষ কালিমকে মিলনে যেতে হয়। আর স্ত্রী কালিমের মন জয় করার জন্য পুরুষ কালিমকে শারীরিক কসরত দেখাতে হয়।

    প্রকৃতি ও কৃষি বান্ধব সামাজিক আন্দোলনের (প্রকৃবাসা) মহাসচিব লুতফর রহমান বলেন, কালিমের আকার মুরগির মতো। বেগুনি, নীল, সবুজ রঙের একটি পাখি। কালিম পাখির ইংরেজি নাম Purple Swamp Hen. বাংলা অর্থ দাড়ায় বেগুনি কাদার মুরগি। বৈজ্ঞানিক নাম Porphyrio porphyrio. বাংলায় অঞ্চল বেধে এর অনেকগুলো নাম – কালিম, কাযমী, করমা, কালেম, সুন্দরী পাখি (হাওর অঞ্চলে), কাম পাখি, কামিয়া পাখি, বুরি পাখি ইত্যাদি।

    এদের সাইজ কমবেশি দৈর্ঘ্য ৪৫ সেমি, ডানা ২৬ সেমি, ঠোঁট ৪.৫ সেমি, পা ১৯ সেমি, লেজ ১০ সেমি ও ওজন ৬৫০ গ্রাম।

    নালিতাবাড়ী উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা মতিউর রহমান বলেন, কালিম পাখি এখন তেমন চোখে পরে না। দেখত সুন্দর স্বাস্থ্যবান এই পাখিরা সব সময় যেমন সতর্ক থাকে, তেমনি যেন রেগেও থাকে। শিকারিদের বন্দুকের গুলি যদি পায়ে লাগে, তবু কাবু হয় না। পা মুখে কামড়ে ধরে উড়ে পালায়।

    তিনি আরো বলেন, জলজ সাপ, গিরগিটি, ছোট পাখি, পাখির ছানা, ডিম, মৃত দেহাবশেষ ইত্যাদি খাওয়ার কথাও জানা যায়। খাবার খাওয়ার সময় এরা লেজের নিচে সাদা অংশ প্রদর্শন করে এবং চাক চাক শব্দ করে ডাকে।

    ষাটোর্ধ্ব ইসমাইল হোসেন বলেন, এক সময় আমাদের গারো পাহাড়ে প্রায়ই কালিম পাওয়া যেত। শিকারিরা ধরে এনে নালিতাবাড়ী বাজার সহ আশপাশের বাজারে বিক্রি করত। বর্তমানে এর দেখা মিলে না।

    Leave a Comment