হিসাবচক্র কাকে বলে । হিসাবচক্র কত প্রকার ও কি কি । হিসাবচক্র সুবিধা ও অসুবিধা । হিসাবচক্র বৈশিষ্ট্য । হিসাবচক্র গুরুত্ব
হিসাবচক্র কাকে বলে । হিসাবচক্র কত প্রকার ও কি কি । হিসাবচক্র সুবিধা ও অসুবিধা । হিসাবচক্র বৈশিষ্ট্য । হিসাবচক্র গুরুত্ব
হিসাবচক্র কাকে বলে :-
যে চক্রের মাধ্যমে হিসাববিজ্ঞান প্রক্রিয়ার ধাপসমূহ আবর্তিত হয়, তাকে হিসাবচক্র বলে।
চলমান প্রতিষ্ঠান ধারণা (Going concern concept) অনুসারে একটি কারবার অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত চলতে থাকবে বলে বিশ্বাস করা হয়। ব্যবসার প্রতিষ্ঠানের ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা জানার জন্য এ অনির্দিষ্ট সময়কে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সময়কারে ভাগ করা হয়। এ সময়ে সকল হিসাবকাল একটি সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিক প্রত্রিকার মাধ্যমে আবর্তিত হয়। আবর্তিত এ ধারাবাহিক প্রক্রিয়াই হিসাব চক্র (Accounting cycle)।
হিসাব চক্র মূলত একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাব সংক্রান্ত কার্যাবলির পর্যায়ক্রমিক প্রকাশ। হিসাবচক্রের ধাপ নয়টি। তবে বিপরীত দাখিলা হিসাব চক্রের ঐচ্ছিক ধাপ হওয়া সত্ত্বেও অনেকের মতে হিসাবচক্রের ধাপ বিপরীত দাখিলাসহ মোট দশটি। বিষয়টিকে অন্যভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে।
দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতির নিয়মানুসারে হিসাববিজ্ঞানের যে বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক লেনদেনসমূহ ধারাবাহিকবাৰে লিপিবদ্ধ করণ, শ্রেণিবদ্ধকরণ, সংক্ষিপ্তকরণ ও আর্থিক বিবরণী কার্য সম্পন্নকরণ করা হয় তাকে হিসাবচক্র বলে।
এ ধারাবাহিক কার্যক্রম প্রথমে জাবেদা লিখন থেকে শুরু হয়। জাবেদা প্রস্তুত করার পরবর্তী পর্যায়ে লেনদেনের প্রকৃতি অনুসারে শ্রেণিবিন্যাসপূর্বক খতিয়ান হিসাব প্রস্তুত করা হয়। অতঃপর খতিয়ান উদ্বৃত্ত দ্বারা রেওয়ামিল প্রস্তুত করে হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করা হয়। এরপর চূড়ান্ত হিসাব প্রস্তুতের মাধ্যমে ব্যবসায়ের লাভ-লোকসান নির্ণয় এবং সঠিক আর্থিক অবস্থা নিরূপণ করা হয়। সর্বশেষ পর্যায়ে চূড়ান্ত হিসাবের বিশ্লেষণ করা হয়। এভাবে একটি নির্দিষ্ট হিসাবকাল শেষে আবার হিসাবরক্ষণের কাজ শুরু হয়।
অর্থাৎ পুনরায় লেনদেন থেকে জাবেদা, জাবেদা থেকে খতিয়ান, খতিয়ান উদ্বৃত্ত দ্বারা রেওয়ামিল এর দাখিলা দ্বারা আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত ও বিশ্লেষণ পর্যায়ক্রমে চলতে থাকে এবং বিপরীত দাখিলার মাধ্যম পরবর্তী বছরে আবার কাজ শুরু হয়।
হিসাব চক্রের সংজ্ঞা:-
Steven J. Skinner & Ivancevich) এর মতে হিসাবচক্র হলো বিশ্লেষণ, লিবিপদ্ধকরণ, খতিয়ানভুক্তকরণ এবং প্রতিবেদন প্রণয়নের ধাপ যার দ্বারা ব্যবসায়িক লেনদেনসমূহের ফলাফল জানা যায়।
হারম্যানসন (Hermanson) ও অন্যরা বলেন, হিসাবচক্র হলো ব্যবহার উপযোগী আর্থিক তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং প্রকাশের একটি পর্যায়ক্রমিক ধাপ বা পর্যায় যা একটি হিসাবকালে সম্পাদিত হয়।
উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, কোনো নির্দিষ্ট হিসাবকাল বা হিসাববর্ষকে কেন্দ্র করে হিসাব লিখন প্রক্রিয়ার যে ধাপ বা পর্বগুলো একটির পর একটি ধারাবাহিকবাবে অগ্রসর হতে থাকে, পরবর্তীকালের শুরুতে আবার সেই প্রথম ধাপে প্রবেশ করে তাকে হিসাবচক্র বলে এটি একটি পনরাবৃত্তিমূলক প্রক্রিয়া।
হিসাব চক্রের ধাপসমূহ :-
হিসাব চক্রের ধাপগুলি কী হবে তা নির্ভর করে কোনো প্রতিষ্ঠান কীভাবে তার হিসাবরক্ষণ প্রক্রিয়া পরিচালিত করবে তার ওপর। এজন্য প্রতিষ্ঠানের হিসাব চক্রের ধাপসমূহ বিভিন্ন রকম হতে পারে। সাধারণভাবে হিসাব চক্রের যে সকল ধাপ হতে পারে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো
১. লেনদেন সনাক্তকরণ (Identifying transactions) :-
প্রতিষ্ঠানে যে সকল ঘটনা ঘটে তার সবগুলো লেনদেন নয়। এজন্য হিসাব চক্রের প্রথম কাজ হবে সবগুলো ঘটনা থেকে যে ঘটনাগুলো লেনদেন সেগুলো বাছাই করা। যে সকল ঘটনা সম্পত্তি ও দায়ের পরিবর্তন ঘটায় এবং অর্থ দ্বারা পরিমাপ করা যায় সেগুলোই আর্থিক লেনদেন।
[ বি:দ্র: উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)]
২. লিপিবদ্ধকরণ (Recording) :-
হিসাব চক্রের প্রথম আনুষ্ঠানিক ধাপ হলো বাছাইকৃত লেনদেনগুলো দুতরফা দাখিলা পদ্ধতি মোতাবেক তারিখের ক্রমানুসারে জাবেদা ভুক্তকরণ। সর্ব প্রথম এ বইতে লেনদেনগুলোকে লিখা হয় বলে একে প্রাথমিক হিসাবের বইও বলা হয়।
৩. শ্রেণিবদ্ধকরণ (Classifying) :-
লিপিবদ্ধ লেনদেনগুলো তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী খতিয়ানভূক্তকরণ হচ্ছে হিসাব চক্রের তৃতীয় ধাপ। জাবেদায় লিপিবদ্ধকৃত প্রতিটি লেনদেনের আলাদা আলাদা হিসাব খুলে খতিয়ানভুক্ত করা হয়। হিসাবকাল শেষে প্রতিটি হিসাবের জের টানার মাধ্যমে প্রতিটি হিসাবের ফলাফল জানা যায়।
৪. সংক্ষিপ্তকরণ (Summarizing) :-
হিসাবচক্রের ৪র্থ ধাপে রেওয়ামিল তৈরি করা হয়। খতিয়ানের হিসাবগুলোর গাণিতিক নির্ভুলতা যাচাই করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট তারিখে একটি পৃথক পাতায় বা কাগজে হিসাবের জেরগুলোকে “ডেবিট” ও “ক্রেডিট” এ বিভক্ত করে যে বিবরণী তৈরি করা হয় তাকে রেওয়ামিল বলা হয়। আর্থিক বিবরণী তৈরির পূর্বে রেওয়ামিল তৈরি করা হয়।
৫. সমন্বয় প্রক্রিয়া (Adjustment process) :-
রেওয়ামিল তৈরি করার পর কিন্তু আর্থিক বিবরণী তৈরি করার পূর্বে অনেক সময় দেখা যায় আয়/ব্যয় অগ্রিম অথবা বকেয়া রয়েছে যা হিসাবভুক্ত হয়নি। যে জাবেদার মাধ্যমে বকেয়া অথবা অগ্রিম আয় ও ব্যয়কে Accrual concept অনুযায়ী হিসাবভুক্ত করা হয়, তাকে সমন্বয় দাখিলা বলা হয়।
৬. সমন্বিত রেওয়ামিল প্রস্তুতকরণ (Preparing the adjusted trial balance) :-
হিসাবচক্রের ৪র্থ ও ৫ম ধাপের সমন্বয়ে সমন্বিত রেওয়ামিল প্রস্তুত করা হয়। অর্থাৎ রেওয়ামিল প্রস্তুতের পর যে সমন্বয়গুলো অসমন্বিত ছিল। সেগুলোকে সমন্বয় করে যে রেওয়ামিল তৈরি করা হয় তাকে সমন্বিত রেওয়ামিল বলে।
৭. আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতকরণ (Preparing the financial statements) :-
এ পর্যায়ে সমন্বিত রেওয়ামিলের সাহায্যে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণী তৈরি করা হয়। এ আর্থিক বিবরণী থেকে প্রতিষ্ঠানের লাভ-ক্ষতি, সম্পত্তি ও দায়ের পরিমাণ জানা যায়। এ ধাপের অংশগুলো হলো Income statement, Owner’s equity statement and Balance sheet.
আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতের পর ব্যবসায়ের লাভ-ক্ষতি এবং সম্পদ ও দায়ের সঠিক চিত্র স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের নিকট তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া আর্থিক বিবরণীকে আরোও সুস্পষ্ট রূপে প্রকাশ করার জন্য হিসাববিজ্ঞান তুলনামূলক রেওয়ামিল ও উদ্বতপত্র, নগদ প্রবাহ বিবরণী, অনুপাত বিশ্লেষণ ও লেখচিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে।
৮. সমাপণী দাখিলা (Closing entry) :-
মুনাফা জাতীয় আয়ব্যয় হিসাব কাল শেষে সমাপনী দাখিলার মাধ্যমে বন্ধ করতে হয়। যে দাখিলার মাধ্যমে রেওয়ামিলের মুনাফা জাতীয় আয়ব্যয়গুলোকে আয় বিবরণীতে হস্তান্তর করে তাদের জের শূন্য করা হয়, তাকে সমাপনী দাখিলা বলা হয়
৯. সমাপনী উত্তর রেওয়ামিল (Preparing the post closing trial balance) :-
মুনাফা জাতীয় দফাগুলোর জের শূন্য করার পর বিভিন্ন সম্পত্তি ও দায়সমূহের জেরগুলো নিয়ে যে রেওয়ামিল তৈরি করা হয় তাকে Post closing trial balance বা সমাপনী পরবর্তী রেওয়ামিল বলে।
১০. বিপরীত দাখিলা (Reversing entries) :-
হিসাব চক্রের এ ধাপে পরবর্তী হিসাবকালের লেনদেনসমূহ লিপিবন্ধ করার সুবিধার্থে চূড়ান্ত হিসাব প্রস্তুত ও সকল হিসাব বই বন্ধ করার পর সমন্বয় দাখিলার বিপরীত দাখিলা দেওয়া হয়।
এটি বাধ্যতামূলক নয়, এটি ঐচ্ছিক। চলতি সালের বকেয়া আয়-ব্যয় ও অগ্রিম আয়-ব্যয় সমূহ লিখা হয়।
পরবর্তী হিসাব বছরের শুরুতে পূর্ববর্তী বছরের উদ্বর্তপত্রের সম্পত্তি ও দায়সমূহ চলতি বছরের হিসাবের খাতায় জাবেদা দাখিলার দেওয়ার মাধ্যমে নতুন বছরে কার্যক্রম শুরু হয়। এভাবে হিসাবচক্র পূর্ববর্তী বছরের সাথে বর্তমান বছরের বা বর্তমান বছরের সাথে পরবর্তী বছরের যোগসূত্র হিসাবে কাজ করে।