১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর,সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ,১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ
পৃথিবীতে চিরন্তন / চিরস্থায়ী বলতে কিছু নেই। সবকিছুই পরিবর্তনশীল। তবে সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ভারতবর্ষের ‘ইতিহাসে দেখা যায়, সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি ইংরেজ বেনিয়ারাও ভারতে আসেন অজুহাতে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে তারা প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে ভারতের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হাতে নিতে সক্ষম হন।
আবার সময়ের প্রেক্ষিতে যখন তারা বুঝতে পারলেন যে, এ উপমহাদেশে সন্তোষজনকভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তখন তারা বিদায়ও নিয়ে যান। এ ধরনের নিয়মের প্রেক্ষিতে দেখা যায়, পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হাতে পান তা কাজে লাগিয়ে তারা ভারতবর্ষে শোষণ ও নির্যাতন চালাতে থাকেন। তবে এ শোষণ ও নির্যাতন স্থায়ী হয় নি। বাংলার চেতনাবোধসম্পন্ন জনসাধারণ দীর্ঘ একশ বছরের অসন্তোষের অবসানের জন্য ১৮৫৭ সালে রাস্তায় নেমে আসতে পিছপা হন নি। ফলে সংঘটিত হয় ইতিহাসের অন্যতম কাহিনী মহাবিদ্রোহ।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের কারণ : ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একক কোন কারণ ছিল না। তবে দীর্ঘদিন কোম্পানি শাসনের অত্যাচার, নির্যাতন ও ক্ষোভ এ বিদ্রোহের মূল কারণ হিসেবে পরিগণিত হয়। তাই এসবের অবসানের জন্য ভারতীয় চেতনাসম্পন্ন জনসাধারণ রাস্তায় নেমে আসেন। নিম্নে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের কারণসমূহের সংক্ষেপে বিবরণ দেওয়া হল :
১. রাজনৈতিক কারণ : ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ভারতীয় শাসকবর্গের তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব।
১৭৫৭ সালের পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একের পর এক ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। এর ফলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব দেখা দেয়। এছাড়া কোম্পানি শাসনের মোড়ল হিসেবে ভারতবর্ষে অনেকের আবির্ভাব হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন ভারতবাসীর প্রতি নামমাত্র উদার, কেউ কঠোর, কেউ সামাজ্যবাদী প্রভৃতি প্রকৃতির। এ ধরনের একজন হলেন লর্ড ডালহৌসি। লর্ড -ডালহৌসি তার স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে সাতারা, ঝাঁসি, নাগপুর, সম্বলপুর প্রভৃতি রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। ১৮৫৪ সালে কর্নাটের নবাব পদ বিলোপ করেন ।
পেশবা দ্বিতীয় বাজীরা ও এর দত্তক পুত্র নানা সাহেবের ভাতা বন্ধ করে দেন। ১৮৫৬ সালে অপশাসনের অভিযোগে অযোধ্যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। অযোধ্যা বহু পূর্ব থেকে কোম্পানির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলত । এ প্রসঙ্গে জন. কে বলেছেন, False to the people- False to the manhood. They were true to the British government. কিন্তু এসব সত্ত্বেও ডালহৌসির ভয়ংকর থাবা থেকে অযোধ্যা রক্ষা পায় নি। অযোধ্যা দখল করেও ডালহৌসি ক্ষান্ত হন নি। নির্লজ্জভাবে অযোধ্যার কোষাগার লুণ্ঠন করেন এবং নবাবকে কলকাতায় নির্বাসন দেন। নবাবের রাজ্য চ্যুতির ফলে বহু পোষ্য পরিবার একবারে সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়েন। এছাড়া কোম্পানি অযোধ্যা দখল করার পর যে রাজস্ব ব্যবস্থার প্রচলন করেন তা জনসাধারণের সাধ্যের বাইরে ছিল। এভাবে দেখা যায়, দেশীয় রাজা, দেশীয় সিপাহি ও জনসাধারণ ব্রিটিশ সরকারের শাসনের অবসানের জন্য একই জায়গায় এসে সমবেত হন। ফলে সংঘটিত হয় ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ।
২. অর্থনৈতিক কারণ : ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের জন্য জনসাধারণের অর্থনৈতিক অসন্তোষ ছিল সর্বাগ্রে। ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে এদেশ ছিল কৃষি ও শিল্পে সমৃদ্ধ। কিন্তু কোম্পানির শাসনে এদেশে শুরু হয় লাগামহীন শোষণের পালা। ফলে ভারতীয়দের জীবনে চরম দারিদ্র্য নেমে আসে। কোম্পানির অন্যায়মূলক রাজস্ব নীতির ফলে এদেশের সমৃদ্ধ কৃষককুল সহায়সম্বল হারিয়ে পথে বসেন। বিখ্যাত সমাজতান্ত্রিক কার্ল মার্কস ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে বলেন-
ক. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভারতীয় দরিদ্র কৃষককুলের উপর জমিদার ও রাজস্ব আদায়কারী শক্তির যুগ্ম শোষণ ।
খ. কৃষকদের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপানো ।
গ. আদায়কৃত রাজস্বের সামান্যতম অংশ কৃষির উন্নয়নে ব্যয় না হওয়ায় সেচ ব্যবস্থা ধ্বংস। ঘ. স্থানীয় শিল্পের ধ্বংস এবং ব্রিটিশ পণ্যের ভারতীয় বাজার দখল এবং ঙ. কৃষকদের উপর বিবিধ অত্যাচারমূলক আইন । এসব অসন্তোষের ফলে বিদ্রোহ যে হবে তা স্বাভাবিক ব্যাপার।
এছাড়াও দেখা যায়, কোম্পানি শাসনামলে ভারতীয় জনসাধারণের অর্থনৈতিক অসন্তোষের পাশাপাশি ভারতীয় শিল্প বাণিজ্যের ধ্বংস সাধন করা হয়। আর শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস হওয়ার ফলে ভারতীয় জনসাধারণকে আর শোষিত ও ি করে রাখা যায় নি। ফলে সংঘটিত হয় ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ।
৩. সামাজিক কারণ : ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে সামাজিক অসন্তোষও দায়ী ছিল। এ প্রসঙ্গে রামেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ভারতের সকল শ্রেণীর মানুষ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভীষণভাবে অসম্ভাষ্ট ছিল। কারণ, বিজিত ভারতবাসীর প্রতি বিজেতা ব্রিটিশদের ঘৃণার মনোভাব ভারতীয়দের মনে বেদনার সৃষ্টি করেছিল। সামাজিক দিক থেকে কখনও ভারতীয়দের সাথে কোম্পানির কোন ঐক্যভাব গড়ে উঠে নি। ইংরেজরা ভারতবাসীকে বর্বর বলে অভিহিত করত এবং ধর্মযাজকগণ প্রকাশ্যে হিন্দুদের মূর্তিপূজা ও সামাজিক সংস্কারাদির নিন্দা করত।
এ অত্যাচারের কথা পার্ট ওয় হেস্টিংস স্বীকার করেছেন । তাঁর মতে, “A Few years ago, most of the English regarded the Indian almost as barbarians.” তবে সামাজিক ক্ষেত্রে ইংরেজরা যে একবারে সংস্কার বিমুখ ছিলেন তা নয়। তারা যে সংস্কারকার্য সম্পন্ন করেন তা ছিল ব্রিটিশ স্বার্থে। সুতরাং, বিজেতা ও বিজিতদের মধ্যে ব্যবহারের ও আচরণের বৈষম্য বিদ্রোহের অনুকুলে ছিল।
৪. ধর্মীয় কারণ ঃ ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের জন্য ভারতীয়দের ধর্মীয় অসন্তোষও দায়ী ছিল। ভারতে খ্রিস্টান মিশনারিদের তৎপরতায় ভারতীয়দের মনে এ আশঙ্কা জন্মায় যে, ইংরেজ শাসনে তারা ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য। খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রকাশ্য ধর্মপ্রচার, হিন্দু-মুসলমানদেরকে ‘ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টা চালায়। বিদ্যালয়, হাসপাতাল, জেলখানায় খ্রিস্টান পাদ্রিদের অবাধ যাতায়াত হিন্দু-মুসলমানদের মনে দারুণ আশঙ্কার সৃষ্টি করেছিল।
এছাড়া মন্দির বা মসজিদ পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট ভূমি এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর করারোপের সরকারি নীতি ভারতীয় জনগণের ধর্মীয় চেতনায় চরম আঘাত হানে। ১৮৫০ সালে ভারত সরকার এমন একটি আইন বিধিবদ্ধ করেন যার মর্ম ছিল খ্রিস্টধর্ম অবলম্বনকারীকে তার পৈত্রিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এর ফলে হিন্দু-মুসলমান উভয়েই নিজ নিজ ধর্মের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রমোদ গুণে।
১৯৫৭ সালে R.D Mangales ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের এক ভাষণে বলেন যে, খ্রিস্টধর্মের বিজয় পতাকা ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সগৌরবে উড্ডীন রাখার জন্যই ভাগ্যবিধাতা হিন্দুস্থানের বিস্তৃত সাম্রাজ্য ইংল্যান্ডের হাতে তুলে দিয়েছে। সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার কাজে প্রত্যেককেই আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ ধরনের বক্তব্য শোনার পর ভারতীয়রা আর চুপ করে বসে থাকতে পারেন নি।
৫. সামরিক কারণ : পূর্বে ভারতীয়দের মধ্য থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হতো। কিন্তু সেনাবাহিনীতে ছিল চরম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা। সেনাবাহিনীতে শ্বেতাঙ্গ ও ভারতীয়দের মধ্যে চেতনাগত দিক থেকে পার্থক্য ছিল। জানা যায় যে, ৩ লক্ষ ১৫ হাজার ৫০০ জন ভারতীয় সৈনিকের জন্য বার্ষিক ব্যয় হতো ৯৮ লক্ষ পাউন্ড। অথচ ৫১ হাজার ৩১৬ জন ইউরোপীয় অফিসার ও সৈনিকদের জন্য খরচ হতো ৫৬ লক্ষ ৬০ হাজার পাউন্ড। এছাড়া সেনাবাহিনীতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ছিল বিশাল ব্যবধান। সামরিক বাহিনীতে দেশীয় সিপাহিদের নিকৃষ্ট শ্রেণীর জীব বলে গণ্য করা হতো।
তাদেরকে নিগার, শুয়োর ইত্যাদি বলে গালিগালাজ করত। এভাবে কোম্পানির ব্যবহারে ভারতীয় সিপাহিদের মধ্যে যখন চরম অসন্তোষ বিরাজমান তখন কোম্পানি সরকারের কয়েকটি সামরিক সংস্কার সিপাহিদের ধর্মানুভূতিতে প্রচণ্ড আঘাত হানতে শুরু করেছিল। তাই এক পর্যায়ে সিপাহিদের কপালে তিলককাটা নিষিদ্ধকরণ, দাঁড়ি কামানো, পুরানো পাগড়ির ব্যবহারের জন্য চাপ প্রয়োগ ইত্যাদি ভারতীয় সিপাহিদের মনে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল। এভাবে সিপাহিদের মনে যখন রাজনৈতিক অসন্তোষ বিরাজমান তখন ব্রিটিশ সরকার এনফিল্ড নামক এক প্রকার রাইফেল এর ব্যবহার শুরু করেন। এতে এক প্রকার গুজব উঠল যে, এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজে গরু ও শূকরের চর্বি মাখানো আছে; এ চর্বি দাঁত দিয়ে কেটে বন্দুকে পুরতে হতো। তাই সিপাহিরা এ প্রত্যক্ষ কারণে আর বসে থাকতে পারলেন না। বিধায় সংঘটিত হয় ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের ফলাফল/গুরুত্ব : ১৮৫৭ সালে যে বিদ্রোহ সংঘটিত হয় তা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যথা :
১. ভারতবাসীর প্রথম গৌরবময় বিদ্রোহ : ভারতবর্ষের এ বিদ্রোহ ছিল এক গৌরবময় অধ্যায়। এ বিদ্রোহের দুর্বলতা যাই থাক না কেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গ্রাস থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য ভারতীয় জনগণের এটাই ছিল প্রথম মুক্তিসংগ্রাম। এ বিদ্রোহ আধুনিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথ পরিষ্কার করে দিয়েছিল। এ বিদ্রোহের আদর্শ ও পরিকল্পনা পরবর্তীকালে মুক্তির সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
২. কোম্পানি শাসনের অবসান। এ বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার অনুধাবন করেন যে, ভারতের মত বিশাল দেশের শাসনভার একটি বণিক কোম্পানির হাতে থাকা নিরাপদ নয়। এ কারণে ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৮ সালে ভারত শাসন আইন প্রণয়ন করে ভারতে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটান, এবং ভারতের শাসনভার সরাসরি নিজ হাতে গ্রহণ করেন। ভারত শাসনব্যাপারে মহারাণীকে সাহায্য করার জন্য বিটিশ মন্ত্রিসভার একজন সদস্যকে ভারত সচিব নিযুক্ত করা হয়। স্যার চার্লস উচ প্রথম ভারত সচিবের পদ অলংকৃত করেন। তাকে সাহায্য করার জন্য ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কাউন্সিল গঠন করা হয়। ভারতের বড়লাট ভাইসরয় বলে অভিহিত হন।
৩. মহারাণীর ঘোষণাপত্র প্রকাশ। ১৮৫৮ সালে ১ নভেম্বর ইংল্যান্ডের মহারাণী এক ঘোষণাপত্র জারি করেন। এ ঘোষণাপত্রে স্বত্ববিলোপ নীতি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় ।
খ. দেশীয় রাজন্যবর্গের দত্তকপুত্র গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয় এবং তাদের সাথে স্বাক্ষরিত কোম্পানির সকল চুক্তি রক্ষা করা হবে, এ নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
গ. ব্রিটিশ সরকার রাজ্যবিস্তার নীতি পরিত্যাগ করবেন। যোগ্যতা অনুযায়ী সকল ভারতীয়কে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করা হবে। ভারতীয়দের ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
চ. ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যেসব ভারতীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তাদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করা হয়।
৪. ১৮৬১ সালের আইন পাস। ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহ অবলোকন করে ব্রিটিশ সরকার ভারতে প্রত্যক্ষ শাসন কায়ে করেন এবং ভারতের শাসনব্যবস্থায় ভারতীয়দের অধিকতর সংযুক্ত করার জন্য ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় পরিষদ আইন পাস করেন। এ আইনের মাধ্যমে প্রথমবারের মত ভারতীয় আইন পরিষদে ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৫. বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির আইন প্রণয়ন ক্ষমতা পুনর্বহাল : ১৮৩৩ সালের সনদ আইনে গভর্নর জেনারেল ও পরিষদের হাতে মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সির আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছিল। ১৮৬১ সালের আইনে মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সির আইন প্রণয়নের সে ক্ষমতা পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
৬. সামরিক নীতি: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে পরিবর্তন সাধন করা হয়। অযোধ্যায় অবস্থিত বেঙ্গল আর্মির পরিবর্তে ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয় ও আঞ্চলিক জাতিগোষ্ঠী থেকে সিপাহি নিয়োগের নীতি গ্রহণ করা হয়। ইউরোপীয় সেনা বৃদ্ধি করা হয় এবং গোলন্দাজ বাহিনীতে ভারতীয়দের নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়। ইংরেজ সেনাবাহিনীর হাতে মারণাস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। অন্যদিকে ভারতীয়দের হাতে নিম্নাস্ত্র দেওয়া হয়।
৭. দেশীয় রাজ্যগুলোর সাথে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপন : ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার তাদের নীতির পরিবর্তন ঘটান। পূর্বে তাদের নীতি ছিল সমগ্র ভারতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার বা ভূখণ্ড সৃষ্টি করা। কিন্তু এ বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার দেশীয় রাজ্যগুলোর সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হন। ফলে ভারতবাসীর কিছুটা সুবিধা হয়।
৮. মুঘল সাম্রাজ্যের অবসান : ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ অন্য দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও একদিকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ বিদ্রোহের পর ভারতবর্ষ থেকে মুঘল শাসনের অবসান হয়। দিল্লি অধিকার করে ইংরেজ সরকার বাহাদুর শাহকে বন্দি করেন। মুঘল বাদশাহদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এবং বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেওয়া হয়। ১৮৬২ সালে রেঙ্গুনে তার মৃত্যুর সাথে সাথে ভারতে মুঘল সম্রাট বংশের গৌরব চিরতরে মুছে যায় ।
৯. ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ ঃ এ বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে ব্রিটিশ সরকার তাদের নীতির পরিবর্তন করেন। ফলে ভারতে সংস্কারমূলক পরিকল্পনার পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের সম্পর্কে অনেকটা সচেতন হন।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, ১৮৫৭ সালে যে বিদ্রোহ সংঘটিত হয় তা সিপাহিদের প্রত্যক্ষ স্বার্থে আঘাত লাগার জন্য শুরু হয়েছিল। তবে এ বিদ্রোহের জন্য দায়ী ছিল ব্রিটিশ সরকারের ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ১০০ বছরের শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর ক্ষোভের চরম প্রতিবাদ। আর এ প্রতিবাদের জন্যই ভারতের শিক্ষিত, বেকার, মধ্যবিত্ত, কৃষক, শ্রমিক, সিপাহি সকলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, বলিষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য যে নেতৃত্বের প্রয়োজন, তা না থাকায় এবং ব্রিটিশ সরকারের দমন নীতির, কারণে এ বিদ্রোহ সফল হতে ব্যর্থ হয়। তবে ব্যর্থ হলেও ভারতবাসীর মধ্যে চেতনার বিকাশে এ বিদ্রোহ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।