১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির কারণ সমূহ, ১৯৪৭ সালে ভারত কেন বিভক্ত হয়?, ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির কারণ উল্লেখ কর, ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি ও ব্রিটিশ শাসনের অবসান
১৭৫৭ সালে ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা চলে যায় এককালে যারা ছিলেন এদেশীয় নৃপতি, কৃপা ও অনুগ্রহ প্রার্থী তাদের হাতে। ফলে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়। কিন্তু ইতিহাসের ধর্ম হল পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, একদিন যে বেনিয়ারা শূন্য হাতে ভারতবর্ষে আসেন তেমনি আবার শূন্য হাতে চলে যান। আর এরই মধ্যবর্তী ঘটনা হল চরম দুঃখের ও কষ্টের। ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেখা যায় পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে প্রায় ২০০ বছর বেনিয়ারা এ উপমহাদেশে শোষণ চালায় এবং পরবর্তীতে একপর্যায়ে ১৯৪৭ সালে ভারত ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয়।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির প্রেক্ষাপট : অনেক কাহিনী ও ঘটনা পরিক্রমায় ভারত বিভক্তি সম্পন্ন হয়েছিল। নিম্নে এ বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করা হল :
১. ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ : ভারতবর্ষে কোম্পানির শাসনে ভারতবর্ষের জনসাধারণের মনে যখন চরম অসন্তোষ দেখা দেয় তখন প্রত্যক্ষ কারণ তথা সিপাহিদের মধ্যে অসন্তোষের কারণে সংঘটিত হয় ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহীই ছিল ভারতবাসীর প্রথম প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রাম। তবে দুর্ভাগ্য যে, সঠিক নেতৃত্বের অভাবে এ বিদ্রোহ ব্যর্থ হয় এবং ভারতবাসীর শোষণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। তবে ভারতবাসীর এ বিদ্রোহ থেকে নতুন চেতনার সঞ্চার হয়েছিল।
২. ১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা : ভারতবাসী ব্রিটিশ শাসনকে কখনও মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারে নি। আর এ না পারার কারণে তারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করে, কিন্তু কোন আন্দোলনেও সফল হতে পারে নি। আর ব্যর্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মনে প্রেরণার সঞ্চার হয় যে, কোন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন ছাড়া আন্দোলন সফল করা যাবে না। তাই একজন ভারতীয় জনসাধারণের প্রতি সহানুভূতিশীল অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সিভিলিয়ান হিউম বড়লাট ডাফরিনের প্রেরণায় ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এ কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর ভারতবাসী কথা বলার মত মাধ্যম খুঁজে পায়। ফলে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে প্রতিবাদ করার পথ সহজ হয়। এ কংগ্রেস ভারত বিভক্তিতে অনেকটা অবদান রেখেছিল।
৩. আলীগড় আন্দোলন : ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হলে ভারতীয়দের কিছুটা সুবিধা হয়। কিন্তু এ কংগ্রেস প্রথমে ছিল নিরপেক্ষ সংগঠন কিন্তু কংগ্রেস নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে সৈয়দ আহমদ খান মুসলমানদেরকে কংগ্রেস থেকে দূরে থাকতে বলেন এবং আন্দোলনের বাণী নিয়ে আসেন। এ আলীগড় আন্দোলনে মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবনতির কথা তুলে ধরা হয়। ফলে ভারতীয় মুসলমানরা তাদের দুর্বলতা সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। তাই আলীগড় আন্দোলনের প্রেরণা ভারত বিভক্তির ক্ষেত্রে অনেকটা ভূমিকা পালন করেছিল।
৪. বঙ্গভঙ্গ ও রদ : ব্রিটিশ সরকার ১৯০৫ সালে লর্ড কাজনের সময় প্রশাসনিক সুবিধার অজুহাত দেখিয়ে বঙ্গভঙ্গ করেন। কিন্তু প্রশাসনিক সুবিধার অন্তরালে ব্রিটিশ সরকারের অন্য উদ্দেশ্য ছিল। বঙ্গভঙ্গ ছিল ভারতীয় মুসলমানদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। তাই মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গকে সাদরে গ্রহণ করে। অন্যদিকে, ভারতীয় কংগ্রেসের তথা ভারতীয় নেতৃবর্গের আন্দোলন ছিল অখণ্ড ভারতের, তাই তারা বঙ্গভঙ্গকে একটা চক্রান্ত বলে বর্ণনা করে এবং একে বাঙালি জাতীয়তাবাদে আঘাত বলে বর্ণনা করে। তাই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে তারা অগ্রসর হয় এবং একপর্যায়ে তা স্বদেশী আন্দোলনে পরিণত করে। স্বদেশী আন্দোলন থেকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে পরিণত হলে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহর করতে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত যদিও ভারতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের আন্দোলনের সফলতা ছিল তা আবার অন্যদিকে মুসলমানদের কাছে ছিল ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। তাই বঙ্গভঙ্গ রদ থেকে মুসলমানরা চিরদিনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। তাই তারা এ ব্রিটিশ শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার অপেক্ষায় থাকে।
৫. মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা : ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ছিল প্রথম পর্যায়ে একটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠন। কিন্তু পরবর্তীকালে কংগ্রেসে কয়েকজন উগ্রপন্থি নেতার আবির্ভাবের ফলে কংগ্রেস নিরপেক্ষ চরিত্র হারিয়ে ফেলে। তাই মুসলমানরা স্বতন্ত্র একটি জাতি হিসেবে স্বতন্ত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপর হয়। এভাবে একপর্যায়ে ১৯০৬ সালে স্যার সলিমুল্লাহ এর চেষ্টায় ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় মুসলিম নীগ প্রতিষ্ঠা হয়। এ মুসললিম লীগ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের ন্যায় মুসলিম লীগের অবদান ছিল প্রশংসনীয়।
৬. স্বদেশী আন্দোলন : ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ডাক দেয়। এ আন্দোলনের ধরন ছিল দু’ধরনের। যথা : বয়কট আন্দোলন ও স্বদেশী পণ্য ব্যবহার আন্দোলন। এর মূলবক্তব্য ছিল, যদি ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করে তাহলে তারা বিলাতি দ্রব্য বর্জন করবে এবং স্বদেশী পণ্য ব্যবহার করবে। এর ফলে ব্রিটেনের শিল্প ও কলকারখানা অচল হয়ে যাবে। তাই সরকার বাধ্য হয় সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে। কিন্তু এ আন্দোলন ভারতবাসীর একাংশকে খুশি করলেও অন্য অংশ প্রতিবাদে ফেঁটে পড়ে। আর প্রতিবাদের ফসল হল ভারত বিভক্তি।
৭. মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন : ভারতবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার প্রতিশ্রুতি দেন যে, ১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো আইনে ভারতে দায়িত্বশীল সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। কিন্তু আইন পাস হওয়ার পর ফলাফল আসে উল্টো। তাই ভারতবাসীর অসন্তোষের মাত্রা বেড়ে যায়। আর এ অসন্তোষ থেকেই তারা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে। যে বিরোধী আন্দোলন ভারত বিভক্তি ত্বরান্বিত করেছিল।
৮. খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন : ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারতে এক অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়। কারণ, মুসলমানরা ধর্মীয় কারণে তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষায় অনেকটা সচেষ্ট ছিল। অন্যদিকে, রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত ছিল। এ ধরনের অবস্থায় ব্রিটেন মিত্রপক্ষে যোগদান করলে ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি পেশ করে। কিন্তু দেখা যায়, এ সময় ব্রিটিশ সরকার যে প্রতিশ্রুতি দেন তা পরে রক্ষা করতে পারেন নি। আর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারার দরুন মুসলমানরা তুরস্কের খেলাফতের মর্যাদা রক্ষার্থে আন্দোলনের ডাক দেয় যা ‘খেলাফত আন্দোলন’ নামে খ্যাত। একপর্যায়ে খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন ঐকমত্যের ভিত্তিতে অগ্রসর হয়। কিন্তু তা সফল হয় নি। তবে খেলাফত আন্দোলন সফল না হলেও এর অভিজ্ঞতা ভারতবাসীকে জাতীয়তা চেতনা বিকাশে সহায়তা করেছিল।
১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনকে কেন্দ্র করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দেয়। সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার কুখ্যাত রাওলাট এ্য্যার’ এর প্রবর্তন করেন। এ আইনের প্রতিবাদে ভারতবাসী আরো বেশি সোচ্চার হয়। ফলে একপর্যায়ে তারা ধর্মঘটের ডাক দেয়। ধর্মঘট সফল হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার আরো দমনমূলক অভিযান অব্যাহত রাখেন। ভারতীয় জাতীয় কংস ১৯২০ সালে ১৩ এপ্রিল ‘জালিয়ানওয়ালাবাগে এক সমাবেশের আয়োজন করে। কিন্তু ঐ সমাবেশে জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে গুলি চালিয়ে শত শত লোককে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর আন্দোলন আরো তুঙ্গে উঠে যায়। একপর্যায়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বে যে অসহযোগ আন্দোলন তা খেলাফত আন্দোলনের সাথে ঐকমতো আসে। কিন্তু ঐকমত্যের ভিত্তিতে আন্দোলন পরিচালনা করলেও তা দুর্ভাগ্যবশত ব্যর্থ হয়। তবে ব্যর্থ হলেও অসহযোগ আন্দোলনের শিক্ষা ভারতবাসীকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়।
৯. ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন । ১৯৩৫ সালের ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানে আইন পাস করা হয়। কিন্তু এ আইনে যে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয় তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় নি। আর তা বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে ভারতবাসীর যে অসন্তোষ তা আরো বেড়ে যায়। ফলে ভারতবাসীর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন আরো সোচ্চার হয়।
১০. সাইমন কমিশন ঃ ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের ধারা মোতাবেক এ আইনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য দশ বছর পর একটি কমিশন প্রেরণ করার কথা বলা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দশ বছর পূর্ণ না হতেই ১৯২৭ সালে জন সাইমনের নেতৃত্বে ভারতে একটি কমিশন প্রেরণ করেন। এ কমিশনে কোন ভারতীয় সদস্য না থাকায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তা বর্জন করে। কিন্তু বর্জন করলেও এ কমিশন ভারত বিভক্তির পথকে অনেকটা সুগম করেছিল।
১১. নেহেরু রিপোর্ট : পার্লামেন্টে বার্কেন হেডের কথার চ্যালেঞ্জ করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস মতিলাল নেহেরুকে সভাপতি করে ভারতের একটি সংবিধান রচনা করার জন্য কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি তিন মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটি ভারত সম্পর্কিত শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করে। কিন্তু এ রিপোর্ট নিয়েও ব্রিটিশ সরকার টালবাহানা শুরু করেন। ফলে ভারতীয় জনসাধারণের মনে অসন্তোষের মাত্রা আরোও বেড়ে যায়।
১২. জিন্নাহর চৌদ্দ দফা : ১৯২৮ সালে নেহেরু রিপোর্ট প্রকাশিত হলে জিন্নাহ নেহেরু রিপোর্টের উপর কিছু সংশোধনী আনয়ন করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু কংগ্রেস জিন্নাহর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে জিন্নাহ নেহেরু রিপোর্টে যেমন হিন্দুদের স্বার্থের কথা বলা হয় তেমনি তিনি চৌদ্দ দফায় মুসলমানদের স্বার্থের কথা ভুলে ধরেন। ফলে ভারতে এক রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থা দেখা দেয়। এ ধরনের রাজনৈতিক অসন্তোষ ভারত বিভক্তি তরান্বিত করেছিল ।
১৩. আইন অমান্য আন্দোলন ঃ নেহেরু রিপোর্ট নিয়ে ব্রিটিশ সরকার টালবাহানা শুরু করলে জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারকে নেহেরু রিপোর্ট কার্যকরী করার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়। যদি মেনে নেওয়া না হয় তাহলে আইন অমান্য আন্দোলনের হুমকি দেয়। কিন্তু বাস্তবে তাই হয়। ফলে আইন অমান্য আন্দোলন ভারতে দেখা দেয়। আইন অমান্য আন্দোলনে ভারতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। তবে এটা ভারতবাসীকে অনেকটা প্রেরণা যুগিয়েছিল পরবর্তী আন্দোলনগুলোতে ।
১৪. গান্ধী আরউইন চুক্তি : আইন অমান্য আন্দোলন একপর্যায়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। তাই ভাইসরয় আরউইন ১৯৩১ সালের ৫ মার্চ একটি চুক্তি সই করেন গান্ধীজির সাথে। এ চুক্তি অনুযায়ী সমস্যা সমাধানের জন্য গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান জানান। ফলে ১৯৩০-৩১-৩২ সালে পরস্পর তিনটি গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান করা হয়। কিন্তু কোন বৈঠকে সমস্যার তেমন সমাধান হয় নি। একপর্যায়ে ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ঘোষণা করেন।
১৫. ১৯৩৭ সালের নির্বাচন : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী প্রদেশগুলোতে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। প্রদেশগুলোতে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কারণে ১৯৩৭ সালে এ প্রদেশগুলোতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ কোয়ালিশন করে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু এ মন্ত্রিসভা বেশিদিন টিকে থাকতে ব্যর্থ হয় ।
১৬. লাহোর প্রস্তাব । ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পরবর্তী সরকার গঠন নিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সাথে এর গোলযোগ দেখা দেয়। কারণ, কংগ্রেস হিন্দু অধ্যুষিত প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং মুসলিম লীগ মুস অধ্যুষিত প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বাংলা প্রদেশে কৃষকপ্রজা পার্টির নেতা ফজলুল হক কামালের কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু কংগ্রেস তা প্রত্যাখান করে। আর এ প্রত্যাখান করার মুসলমানরা আলাদা একটি জাতি হিসেবে স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য লাহোরে মিলিত হয় এবং একটি মু সম্পর্কিত প্রস্তাব পাস করে যা ‘লাহোর প্রস্তাব’ নামে খ্যাত।
১৭. ত্রিপস মিশন : ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে জাপানি আক্রমণের মাত্রা বেড়ে যায় 4 ধরনের অবস্থায় ভারতীয় নেতারা ব্রিটিশকে ভারত ত্যাগের পরামর্শ দেয়। এছাড়া ব্রিটিশ সরকারও ভারত সম্পর্কিত মনোভাবের পরিবর্তন করেন। ফলে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৯৪২ সালে ভারতে একটি কমিশন প্রেরণ করেন। কমিশন ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে অনেক আলোচনা করে। কিন্তু কোন ঐকমত্যে আসতে ব্যর্থ হলে ব্রিটিশ সরকার নিজস্ব পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এ ভারত বিভক্তির পূর্ব লক্ষণ ছিল।
১৮. ভারত ছাড় আন্দোলন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতে জাপানি আক্রমণের ভীতি দেখা দেয়। ফলে ভারতীয় নেতারা উপলব্ধি করেন যে, ভারতের স্বার্থে ব্রিটিশ সরকারের ভারত ত্যাগ করা উচিত। তাই তারা আগস্ট প্রস্তাবের মাধ্যমে ব্রিটিশকে ভারত ছেড়ে যেতে বলেন। তবে ব্রিটিশ সরকার ভারত ছেড়ে না গেলেও অনেকটা ভিত্তি রচিত হয়েছিল।
১৯. ১৯৪৬ সালের নির্বাচন : ১৯৪৬ সালে প্রদেশগুলোতে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে এতে কেন্দ্রীয় নির্বাচনেরও কথা ছিল। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ শতকরা ৯৫% ভোট পায়। যা আলাদা ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠা করার ভিত্তি রচনা করেছিল।
২০. জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব : ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যখন শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে ঐকমত্যের অভাব তখন জিন্নাহ তাঁর বিখ্যাত দ্বিজাতি তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। এতে তিনি মুসলমানদেরকে আলাদা একটি জাতি হিসেবে ঘোষণা করেন এবং স্বতন্ত্র আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব দেন। ২১. মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা : ভারতে শাসনতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা চরম আকার ধারণ করলে ব্রিটিশ সরকার তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি ক্যাবিনেট মিশন ভারতে প্রেরণ করেন। এ কমিশন ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা নিয়ে ভারতের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনায় আসতে ব্যর্থ হয়। ফলে মিশন নিজস্ব পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এ পরিকল্পনার মধ্যে ভারত বিভক্তির বীজ নিহিত ছিল।
২২. ৩ জুন পরিকল্পনা : ভারতীয়দের মধ্যে অসন্তোষ যখন চরম পর্যায়ে তখন ব্রিটিশ সরকার দেখলেন যে, আর এ ভারতে শাসনকার্য পরিচালনা করা সম্ভব না। তাই ব্রিটিশ সরকার লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে পাঠান। মুি ব্যাটেনের চেষ্টায় ৩ জুন পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করা হয়। ফলে একটি সীমানা কমিশন গঠনও করা হয়। যা ছিল ভারত বিভক্তির পূর্বশর্ত।
২৩. ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন পাস। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ৩ জুন পরিকল্পনা ঘোষণা করার পর ১৯৪৭ সালে একটি আইন পাশ করেন। এ আইনের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি আলাদা ভূখণ্ড সৃষ্টি করা হয়। ফলে দীর্ঘদিনের ভারতবাসীর দাবি ভারত বিভক্তি সম্পন্ন হয়।
উপসংহার : অতএব বলা যায়, পরিবর্তনই হল ইতিহাসের ধর্ম। যেখানে শেষ সেখানে শুরু। ইতিহাসের এ নিয়মে যে বেনিয়ারা বাণিজ্যের জন্য একদা ভারতে আসত তাঁরা পরে ভারতের নিয়ন্ত্রণ কর্তা হন এবং প্রায় ২০০ বছর তাঁরা তাঁদের শাসন, শোষণ বজায় রাখতে সক্ষম হন। এ সময়ে তাঁরা ভারতবাসীর প্রতি যে চরম অত্যাচার নির্যাতন করেন তা তাঁদের পতন ডেকে আনে। ফলে একপর্যায়ে তারা ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তবে এজন্য অনেক কারণসহ ভারতবাসীর ঐক্যবোধ দায়ী ছিল। তবে ভারত বিভক্তি ছিল অনেকটা ঐতিহাসিক দিক থেকে তাৎপর্যময়।