ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিষয়ের অর্থায়নের ক্রমবিকাশ শীর্ষক একটি রচনা

অর্থায়নের ক্রমবিকাশ

ভূমিকা:

অর্থায়ন বর্তমান সময়ে মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মানুষের পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য বর্তমানে অর্থায়নের ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থায়ন তহবিল ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে। কোন উৎস থেকে কিভাবে তহবিল সংগ্রহ করে কোথায় বিনিয়োগ করলে সর্বোচ্চ মুনাফা পাওয়া যাবে সেই বিষয়ে অর্থায়ন আলোচনা করে।

অর্থায়নের ধারণা:

অর্থায়ন বলতে তহবিল সংগ্রহ ও ব্যবহার সংক্রান্ত প্রক্রিয়াকে বোঝায়। অর্থাৎ ব্যবসায়ীক কাজে তহবিল সংগ্রহের উৎস এবং সে সকল তহবিল সঠিক স্থানে বিনিয়োগ করার বিষয়ে অর্থায়ন আলোচনা করেন। অর্থায়ন তহবিল ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে।

একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা একটি প্রতিষ্ঠানে কোন কোন উৎস থেকে কিভাবে আয় হবে এবং কোথায় কিভাবে তা বিনিয়োগ করা হবে এটি অর্থায়নের মূল আলোচ্য বিষয়।

বিভিন্ন উৎস এর মধ্যে কোন উৎস কখন কি পরিমানে ব্যবহার করে তহবিল সংগ্রহ করা উচিত এবং কোন কোন খাতে কি পরিমাণে তা কিভাবে খরচ বা বিনিয়োগ করে মুনাফা বৃদ্ধি করা যায় সেই বিষয় নিয়ে ব্যবসায় অর্থায়ন আলোচনা ও দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে।

অর্থায়নের ক্রমবিকাশ:

সপ্তদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের পরেই উৎপাদন কৌশল জটিলতর হয় এবং বিশেষায়িত ও বিভাজিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদন-প্রক্রিয়া উল্কর্ষ লাভ করে।

বাজার প্রতিযােগিতায় টিকে থাকতে হলে অর্থায়ন-সংক্রান্ত ধারণা ও ব্যবহার অত্যাবশ্যক হয়ে যায়। হিসাবশাস্ত্রের বিকাশের সাথে সাথে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফিন্যান্স মূলত আর্থিক বিবরণীর বিচার-বিশ্লেষণের কাজে নিয়ােজিত ছিল।

ক্ল্যাসিকাল ধারার ব্যষ্টিক অর্থনীতির উন্নতির সাথে সাথে কারবারের নিজস্ব ও বিশেষায়িত অর্থনীতি নিয়েও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে অর্থায়ন সম্পৃক্ত ছিল।

অর্থায়নের ক্রমবিকাশের এই ধারা অর্থায়নের প্রকৃতি ও আওতা সম্পর্কে আমাদের একটি অর্থবহ ধারণা দেয়। গতানুগতিক ধারায় আর্থিক ব্যবস্থাপকদের প্রধান দায়িত্ব ছিল হিসাব সংরক্ষণ ও তা বিশ্লেষণপূর্বক ভবিষ্যৎ কার্যক্রম প্রণয়ন।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রতিবেদন তৈরি করা এবং নগদ অর্থের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি তার প্রদেয় বিলগুলাে যেন যথাযথ সময়ে পরিশােধে সমর্থ হয়, তাও অর্থায়নের ক্রমবিকাশের ধারায় অর্থায়নের কাজ হিসেবে যুক্ত হয়।

কিন্তু সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে প্রতিষ্ঠানের ব্যাপ্তি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আর্থিক ব্যবস্থাপকদের দায়িত্বকে পরিবর্তিত করেছে। অর্থায়নের বিকাশের মূল চারণভূমি যুক্তরাষ্ট্রে অর্থায়নের যে বিবর্তন গত শতাব্দীতে সংঘটিত হয়েছে তা পরে সারা বিশ্বেই অর্থায়নের বিবর্তনের ধারা হিসেবে পরিচয় লাভ করে।

অর্থায়নের ক্রমােন্নয়ন ধারাকে পর্যায়ক্রমিকভাবে উপস্থাপনে দেখা যায় :

ক. ১৯৩০-এর পূর্ববর্তী দশক : এই সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলাের মধ্যে একত্রীকরণের প্রবণতা শুরু হয়।

আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ করে কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে কোন প্রতিষ্ঠান একত্রীকরণ হওয়া উচিত এই সংক্রান্ত রূপরেখা দিতে আর্থিক ব্যবস্থাপকদের দায়িত্ব পালন করতে হয়।

তারা এই একত্রীকরণে বিশাল অংকের অর্থসংস্থান ও আর্থিক বিবরণী তৈরি করার দায়িত্ব পালন করেন।

খ. ১৯৩০-এর দশক : একত্রীকরণ প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রে যথেষ্ট সফলতা পায়নি। আগের দশকে একীভূত অনেক প্রতিষ্ঠানই পরের দশকে দেউলিয়া হয়ে যায়।

উপরন্তু ত্রিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে চরম মন্দা শুরু হয়। অনেক লাভজনক প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় পড়ে যায়। সেমতাবস্থায় ব্যবসায়গুলাে পুনর্গঠন করে কীভাবে প্রতিষ্ঠানগুলােকে দেউলিয়াত্ব থেকে রক্ষা করা যায়, এ ব্যাপারে আর্থিক ব্যবস্থাপক বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন।

এ সময় থেকেই শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে অর্থায়নের প্রয়ােজন দেখা দেয়।

গ. ১৯৪০-এর দশক : এ সময়ে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসায় পরিচালনার জন্য তারল্যের প্রয়ােজনীয়তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করা যায়। নগদ অর্থপ্রবাহের বাজেট করে সুপরিকল্পিত নগদপ্রবাহের মাধ্যমে অর্থায়ন সেই দায়িত্ব পালন করে।

ঘ. ১৯৫০-এর দশক: এই দশকে অর্থায়ন পূর্বে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে সর্বোচ্চ লাভজনক বিনিয়ােগ প্রকল্প মূল্যায়নে নানা প্রকার গাণিতিক বিশ্লেষণ কাজে নিয়ােজিত হয়।

সুদূরপ্রসারী প্রাক্কলনের মাধ্যমে উপযুক্ত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়ােগ করে বিক্রয় বৃদ্ধি ও ব্যয় হ্রাস করে মুনাফা সর্বোচ্চকরণ করাই তখন অর্থায়নের প্রধান কাজে পরিণত হয়। এই ধারাকে অর্থায়নের সনাতন ধারা হিসেবে গণ্য করা হয়।

ঙ. ১৯৬০-এর দশক: এই সময় থেকেই আধুনিক অর্থায়নের যাত্রা শুরু। অর্থায়ন মূলধন বাজারকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করে। শেয়ারহোল্ডাররা প্রতিষ্ঠানের মালিক ফলে শেয়ার হােল্ডারদের সম্পদ বা শেয়ারের বাজারদর সর্বাধিকরণই ছিল এই সময়ের অর্থায়নের উদ্দেশ্য।

এই উদ্দেশ্যকে সফল করার ক্ষেত্রে। নানা রকম আর্থিক বিশ্লেষণমূলক কার্য শুরু হয়। অর্থায়নে খুঁকির ধারণা বুঝিয়ে দেয় যে মুনাফা বৃদ্ধির সাথে সাথে সাধারণত ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়।  সুতরাং মুনাফা বৃদ্ধি সর্বদা কাক্ষিত নাও হতে পারে।

চ. ১৯৭০-এর দশক: এই দশকে কম্পিউটার অধ্যায়ের শুরু হয়, যা শুধু উৎপাদন কৌশলই নয়, ব্যবসা অর্থায়নকেও পাল্টিয়ে দেয়। অর্থায়ন এখন অংকনির্ভর হয়ে উঠেছে।

বেশির ভাগ আর্থিক সিদ্ধান্ত মূলত জটিল অংকনির্ভর এবং কম্পিউটারের মাধ্যমেই তা সুচারুরূপে সম্পাদন করার প্রবণতা এই সময়ে বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়।

যেমন ঝুঁকির ধারণা এখন অনেকটা সঠিকভাবে পরিমাপ ও ব্যবস্থাপনা করা হয়। মূলধনি কাঠামাের সনাতন ধারণাও অনেক জটিল ও অংকনির্ভর হয়।

এই সময় যেসব তাত্ত্বিক ব্যবসায় অর্থায়নকে নানা তত্ত্বের বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ করেছিলেন, তাদের মধ্যে হারি মার্কোইজ, মার্টন মিলার, মডিগ্লিয়ানি ছিলেন উল্লেখযোগী।

পরবর্তীতে ১৯৯০-এর দশকে এসব তাত্ত্বিকগণ গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে। অর্থায়নের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য নােবেল পুরস্কার লাভ করেন।

ছ. ১৯৮০-এর দশক: ব্যবসায় সম্প্রসারণ ও প্রতিযােগিতামূলক বাজারব্যবস্থায় টিকে থাকার জন্য অর্থায়ন তার সনাতনী দায়িত্বের পরিবর্তন করে নতুনরূপে আবির্ভূত হয়।

এই সময় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে মূলধনের সুদক্ষ বণ্টন ও প্রকল্পগুলাে হতে অর্জিত আয়ের বিচার-বিশ্লেষণই ছিল অর্থায়নের মূল বিষয়।

জ. ১৯৯০-এর দশক ও আধুনিক অর্থায়নের সূচনা: এই দশকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (World Trade Organization) আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বব্যাপী আমদানি-রপ্তানির প্রতিবন্ধকতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। অর্থায়নও এ সময়ে আন্তর্জাতিকতা লাভ করে।

একদিকে যেমন অর্থায়নের বিনিয়ােগ সিদ্ধান্ত পৃথিবীর কোথায়, কোন পণ্য প্রস্তুত করা ও বিক্রয় করা লাভজনক সেটা বিবেচনা করে, আরেকদিকে বিশ্বের কোন মূলধনি বাজার কী প্রকৃতির ও কোথা থেকে তহবিল সংগ্রহ করা লাভজনক, তাও অর্থায়নের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়।

ফলে অর্থায়ন হলাে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় একটি প্রায়ােপিক সমাধানের ক্ষেত্র, যা হিসাবরক্ষণ, অর্থনীতি ও অন্যান্য আর্থিক বিষয়গুলােকে সংমিশ্রণ করে সৃষ্টি হয়েছে।

উপসংহার: এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি আধুনিক ব্যবসায় বানিজ্যে বিকাশে অর্থায়নের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থায়নে আদি থেকে বর্তমানে পৌছাতে অর্থায়নের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে।

J.S.C

Leave a Comment