মানবজীবন ও সমাজে ধর্মের ভূমিকা, ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ,ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশে অলৌকিকতার প্রভাব, ধর্মের উৎপত্তি ব্যাখ্যায় কতিপয় সামাজিক তত্ত্ব,ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক তত্ত্বগুলোর পারস্পরিক তুলনা,মানবজীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা

প্রশ্ন সমাধান: ধর্মের উৎপত্তি ব্যাখ্যায় কতিপয় সামাজিক তত্ত্ব

ধর্ম (Religion) | ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ | সমাজ গঠনে ধর্মের ভূমিকা

ধর্ম (Religion) : ধর্ম একটি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। আদিম যুগ হতে আরমভ করে বর্তমান আধুনিক সভ্য সমাজেও ধর্মের অস্তিত্ব দেখা যায়। বিভিন্ন সমাজে ধর্মের বিভিন্নতা দেখা যায়। আবার বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন সমাজে ধর্মের বিভিন্ন ধরন দেখা যায়। যেমনকোনাে সমাজে ভূতপ্রেতকে কেন্দ্র করে ধর্ম গড়ে ওঠে, কোনাে সমাজে মানুষ গাছপালা, লতাপাতা, পশুপাখিকে পূজা করে, কোনাে সমাজে এক ঈশ্বর/সৃষ্টিকর্তাকে আরাধনা করে।

ধর্মের সংজ্ঞা : নৃবিজ্ঞানী টেইলর (Tylor)-এর মতে, “ধর্ম হল আত্মিক জীবে বিশ্বাস” (belief in spiritual beings)। ডুর্খেইম (Durkheim) বলেন যে, “ধর্ম হল পবিত্র জগৎ সম্পর্কে বিশ্বাস ও তৎসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আচারঅনুষ্ঠানাদি।” মনীষী ফেজার (Fazar) -এর মতে, “ধর্ম হল মানুষের চেয়ে উচ্চতর এমন একটি শক্তিতে বিশ্বাস যা মানবজীবন ও প্রকৃতির ধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তার মতে, ধর্মের মূল উপাদান ২টি যথা- (ক) মানুষের চেয়ে উচ্চতর শক্তিতে বিশ্বাস এবং (খ) সে শক্তির আরাধনা।

ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ

ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে মতবাদগুলােকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়, যথা-
(১) টেইলরের সর্বপ্রাণবাদ মতবাদ
(২) মেরেটের মহাপ্রাণবাদ মতবাদ।

১। টেইলরের মতবাদ :

টেইলর বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে, আদিম মানুষ প্রথমে আত্মা, প্রেতাত্মা ও নিজ নিজ মৃত পূর্বপুরুষের পূজা করত। পরে তাদের মধ্যে প্রকৃতিপূজার উন্মেষ ঘটে। ফলে তারা নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, চাঁদ-তারা প্রভৃতি প্রাকৃতিক বস্তুর পূজা শুরু করে। প্রকৃতিপূজা থেকে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় দেবদেবীর মূর্তি পূজার উদ্ভব হয়। এ পর্যায়ে আদিম মানুষ ছিল বহু-ঈশ্বরবাদী। কালক্রমে তাদের মধ্যে পরমেশ্বরের ধারণার সৃষ্টি হয় এবং সমাজে একেশ্বরবাদের উদ্ভব হয়। টেইলরের মতে, ভূতপ্রেত ও মৃত পূর্বপুরুষ পূজার উদ্ভব ঘটে আত্মার ধারণা থেকে। বতুত টেইলরের মতবাদের মূল ভিত্তি হল আত্মী।

আদিম মানুষ মনে করত দেহ ও আত্মা নিয়ে মানবজীবন। দেহ জড়পদার্থ কিন্তু আত্মা অমর ও সচল। এরা অতিপ্রাকৃত বলেই রহস্যময়, বিস্ময়কর। এরা বতু, সময় ও স্থানকে অক্রিম করে চলতে পারে। এখন প্রশ্ন হল আদিম মানুষ আত্মার ধারণাকে কিভাবে পেল? আদিম মানুষ আত্মার ধারণা পেয়েছে স্বপ্নের মধ্যদিয়ে। ঘুমের মধ্যে মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে সে বহু দূরে বেড়াতে যায়, পাহাড় পর্বতে চড়ে, শিকার করে। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর সে দেখে তার দেহ সেখানেই আছে। তারা মনে করত যে, মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে আত্মা ভ্রমণে বের হয়। দেহ থেকে আত্মার সাময়িক অনুপস্থিতি হল ঘুম। আর স্থায়ী বিচ্ছেদ হল মৃত্যু। মৃত্যুর পর দেহ পচে যায়, নষ্ট হয়, কিন্তু আত্মা বিনষ্ট হয় না।

আত্মা আশেপাশে বসবাস করে এবং মাঝেমধ্যে জীবন্ত লােকের ওপর ভর করে তাতে তার মঙ্গল-অমঙ্গল ঘটে। তাই প্রেতাত্মাকে সর্বদা খুশি করার জন্য আদিম মানুষ মৃত পূর্বপুরুষের আত্মাকে পূজা দিত। পূর্বপুরুষ-পূজার স্তর পার হয়ে আদিম মানুষ প্রকৃতিপূজা অর্থাৎ গাছপালা, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত প্রভৃতিকে আরাধনা করতে শুরু করে। এসময় সমাজে বহু ঈশ্বরবাদের অস্তিত্ব দেখা দেয়। এরপর ক্রমে ক্রমে বিবর্তনের মাধ্যমে একেশ্বরবাদের উৎপত্তি হয়।

২। মেরেটের মহাপ্রাণবাদ তত্ত্ব :

আদিম মানুষ এত বুদ্ধিমান ছিল না যে তারা আত্মার ধারণা লাভ করতে পারে। তাই মেরেট মনে করেন যে, আদিম মানুষ আত্মা-প্রেতাত্মার ধারণা লাভের আগেই বিশেষ এক নৈর্ব্যক্তিক শক্তির ধারণা অর্জন করেছিল। এ তত্ত্বের মূলকথা হল সর্বপ্রাণবাদে পৌছার পূর্বে আদিম মানুষের মনে ‘মনা বা নৈর্ব্যক্তিক প্রাকৃত শক্তির ধারণা জন্মে। এ তত্ত্বের নাম মহাপ্রাণবাদ। এখন প্রশ্ন হল ‘মনা শক্তি কী ? ‘মনা’ বলতে বােঝায় এক অস্বাভাবিক অতিপ্রাকৃতিক শক্তি।

‘মনা’ বলতে কোনাে ভূত, প্রেত, আত্মা, প্রেতাত্মাকে বােঝায় না, এটা একটি নৈর্ব্যক্তিক অতিপ্রাকৃতিক শক্তি যা কোনাে ব্যক্তি বা বস্তুতে অস্বাভাবিক গুণ বােঝাতে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ ‘মনা’ শক্তি যার মধ্যে বিরাজ করে সে অসাধারণ ও অসত্বকে সত্ব করে তােলে। আদিম মানুষ এই মনা-শক্তির উপস্থিতি অনুধাবন করে এবং সেগুলােকে ভয়, ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতে থাকে। আর এভাবেই আদিম সমাজে ধর্মের উৎপত্তি লাভ করে।

সমাজ গঠনে ধর্মের ভূমিকা

ধর্মীয় বিশ্বাস ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও সমাজজীবনে ধর্মের একটা বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এজন্য বলা হয় ধর্ম যতখানি ব্যক্তিগত ব্যাপার তার তুলনায় অনেক বেশি সামাজিক। সমাজজীবনে ধর্ম নানাভাবে নিজেকে প্রকাশ করে। বিভিন্ন পারিবারিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের ওপর ধর্মের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলাে সামাজিক মেলামেশার কেন্দ্র। সামাজিক মেলামেশার ফলে ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি ও প্রীতির সঞ্চার হয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলাে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববােধ জাগ্রত করে, মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং জনকল্যাণমূলক কর্ম সম্পাদন করার জন্য উৎসাহ প্রদান করে। এছাড়া সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সামাজিক ঐক্য বজায় রাখার জন্য ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধর্ম ব্যক্তির মনে সামাজিক মূল্যবােধ সঞ্চারিত করে, ধর্ম ব্যক্তিকে সামাজিক নিয়ম মেনে চলতে, সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে শিক্ষা দেয়। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সামাজিক জীবনের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। সুতরাং সমাজ গঠনে তথা সমাজজীবনে সংহতি রক্ষা করতে ধর্ম একটি নিয়ামক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

ধর্ম বা Religion শব্দটি পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত ও চর্চিত শব্দগুলোর মধ্যে একটি। ধর্ম নিয়ে আলোচনা বা ভাবনা শুরুর প্রথমেই মননে একটি প্রশ্নের উদয় হয়– ধর্ম কী? ধর্মের সংজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রে ধর্ম প্রবর্তক এবং সমাজতাত্ত্বিকগণের কিছুটা পার্থক্য লক্ষ করা যায়। ধর্ম প্রবর্তকেরা ধর্মকে উপস্থাপন করেছেন একটি মহাপবিত্র ও পরম মতবাদ বা জীবনাদর্শ হিসেবে। আর সমাজতাত্ত্বিকেরা ধর্মের সংজ্ঞা, প্রকৃতি, আচারিক কার্যকলাপকে বিচার করেছেন নৈর্ব্যক্তিকতার মানদণ্ডে।

ধর্মগুরু বা ধর্ম প্রবর্তকেরা ধর্মকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে স্থাপন করেছেন যেখানে প্রবেশ করতে হলে ব্যক্তিকে ব্যাপক আচার-নিষ্ঠ হতে হয় এবং কিছু মৌলিক বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়। 

ধর্ম কী?

ধর্মকে মোটা দাগে সংজ্ঞায়িত করার আগে ব্যক্তি ও বস্তুর ধর্মভিত্তিক গুণের কথা বলা প্রয়োজন। প্রত্যেকটি বস্তুর একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন: তরলের বৈশিষ্ট্য গড়িয়ে যাওয়া, অগ্নির বৈশিষ্ট্য পোড়ানো, বায়ুর বৈশিষ্ট্য আয়তনহীনতা ইত্যাদি। এ বৈশিষ্ট্যগুলো বস্তুর পরম গুণ। হাজার বছর আগেও এ গুণ ছিল, হাজার বছর পরেও থাকবে। বিচ্ছিন্ন করার উপায় নেই। সেরকম মানুষ বা Homo sapiens দেরও কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলোকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভৌত ও মানবিক। দৃষ্টি, শ্রবণ, স্বাদ ইত্যাদি ভৌত বৈশিষ্ট্য আর, বিশ্বাস, আচরণ ইত্যাদি মানবিক বৈশিষ্ট্য যেগুলো নিম্ন শ্রেণির প্রাণীর মাঝে দেখা যায় না। মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলোকেই পরে ধর্ম নামে সংজ্ঞায়িত ও প্রচারিত করা হয়েছে।

মানুষের লিখিত ইতিহাসের বয়স ৫০০০ বছর হলেও ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিকগণ মানবেতিহাস রচনা ও গবেষণার  সময় তার আগের মানুষদের মাঝেও এমন কিছু আচারানুষ্ঠানের দেখা পেয়েছেন যেগুলোকে পবিত্র বলে পালন করত সে যুগের মানুষ। অনেক সমাজতাত্ত্বিক ধর্মের অনেক রকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। তন্মধ্যে, ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুর্খেইমের (Émile Durkheim) সংজ্ঞাটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। 

“A religion  is  a  unified  system  of  beliefs  and  practices  relative  to  sacred  things… beliefs  and  practices  which  unite  into a single  moral  community…. all  those  who adhere  to them.”

অর্থাৎ, ধর্ম হচ্ছে পবিত্র বস্তুর সাথে যুক্ত বিশ্বাস এবং অনুশীলনের সামগ্রিক ব্যবস্থা যা বিশ্বাসীদের নিয়ে একটি নৈতিক সম্প্রদায় সৃষ্টি করে।

ধর্ম নিয়ে ডুর্খেইমের এ সংজ্ঞাটি ধ্রুপদী এবং ব্যাপক। প্রচলিত ধর্মগুলোর অনেকগুলোতে (যেমন: বৌদ্ধ মতবাদ, কনফুসীয়বাদ ইত্যাদি)  ঈশ্বর বা সর্বশক্তিমান কোনোরূপ সত্তায় বিশ্বাসকে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়া হয়নি। তবুও, সেখানে কিছু পবিত্র ও পরম বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস করা হয়। তাই, ডুর্খেইমের sacred বা পবিত্র শব্দটির ব্যবহার সংজ্ঞাটিকে জুতসই করেছে। তিনি পবিত্র ও লোকজ দুটো বিষয়ের মাঝে মোটা দাগে বিভাজন টেনেছেন। যাপিত জীবনে সমাজে যেটি বা যেগুলো গোষ্ঠীগতভাবে পবিত্র সেগুলোই ধর্ম।

ধর্মের উৎপত্তির সামাজিক তত্ত্ব

ধর্ম বা পবিত্র বিশ্বাসমালার উৎপত্তি নিয়ে অনেক ধরনের মতবাদ প্রচলিত আছে। নৃতাত্ত্বিকগণ অনেক সমাজ ও তাদের সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণের পরে ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদগুলো প্রদান করেছেন। জনপ্রিয় মতবাদগুলো হচ্ছে টাইলরের সর্বপ্রাণবাদ, ম্যারেটের প্রাক-সর্বপ্রাণবাদ, ডুর্খেইমের ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব, মার্কসীয় তত্ত্ব ইত্যাদি।

সর্বপ্রাণবাদ বা Animism

সর্বপ্রাণবাদে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্তা হচ্ছে ‘আত্মা’। ল্যাটিন শব্দ Anima-র বাংলা তর্জমা করলে হয় আত্মা। ল্যাটিন ‘অ্যানিমা’ থেকেই অ্যানিমিজম শব্দের উৎপত্তি। ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ ও গবেষক এডওয়ার্ড বার্নেট টাইলর (E. B. Tylor) সর্বপ্রাণবাদের প্রবক্তা। তার মতে, ধর্ম বা রিলিজিয়নের উৎপত্তি হয়েছে আদিম মানুষের আত্মা বা অ্যানিমায় বিশ্বাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে।

মানুষের আত্মা সম্পর্কীয় ধারণাটি তৈরি হয়েছে মূলত দুটো অভিজ্ঞতা বা চেতনার ওপর ভিত্তি করে। একটি স্বপ্নের অভিজ্ঞতা অন্যটি মৃত্যুর চেতনা। সে যুগে মানুষ বিশ্বাস করা শুরু করে প্রতিটি বস্তু ও অবস্তুগত সত্তার ভেতরে একটি নির্যাস বা আত্মা রয়েছে যেটি পরম এবং আত্মা সদা চঞ্চল। নিদ্রারত অবস্থায় দেখা স্বপ্নগুলোকে মানুষ গুরুত্ব দেওয়া শুরু করে এবং ভাবা শুরু করে স্বপ্নে দেখা ঘটনাগুলোয় আত্মা সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। সে হিসেবে, জড় ও অপ্রাণীবাচক সত্তাগুলোর ওপরও আত্মাবাদ আরোপ করা হয়। প্রকৃতির চলনক্ষম ও অচলনক্ষম প্রতিটি সত্তাকেই আত্মাধীন বলে কল্পনা করা হয়।

মানুষ নিদ্রা ও মৃত্যুর সাদৃশ্যকরণ করে। মৃত্যুর পরে আত্মা মুক্ত আত্মা হিসেবে মুক্তি পায় অথবা প্রেতাত্মা হিসেবে আবার উত্তর-পুরুষগণের কাছে ফিরে আসে, যার সাথে সাক্ষাতের অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে স্বপ্ন। সর্বপ্রাণবাদ মূলত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ধর্মতাত্ত্বিক ধারণাকে প্রতিফলিত করে। টাইলর মনে করেন, সর্বপ্রাণবাদ ধারণা থেকেই পরবর্তীতে প্রকৃতিপূজা ও একেশ্বরবাদের ধারণাটি এসেছে। মৃত্যুর পরের জীবন, স্বর্গ-নরকের ধারণা, পাপ-পুণ্যের হিসাব, কবরের আজাব, জন্মান্তর ইত্যাদি ধারণাগুলোর আদিসূত্র সর্বপ্রাণবাদে লুকিয়ে আছে। এখনও অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং সভ্যদেরও অনেকেই সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাস করে।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কেউ কেউ এখনও বৃক্ষপূজা (তুলসীগাছ পূজা, বটগাছ পূজা) ও প্রাণীপূজা (সর্পদেবী মনসার উপাসনা, দুর্গার বাহন সিংহের স্তুতি) করে থাকে। টাইলরের সর্বপ্রাণবাদের সুনির্দিষ্ট ও শক্তপোক্ত প্রমাণ-উপাত্ত না থাকলেও অধিকাংশ সমাজতাত্ত্বিক একেই ধর্মের উৎপত্তিগত তত্ত্বগুলোর ভেতর সবচেয়ে আধ্যাত্মিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

প্রাক-সর্বপ্রাণবাদ বা Animatism

অ্যানিমিজম বা অ্যানিম্যাটিজমের মধ্যে চেতনাগত কিছু সাদৃশ্য থাকলেও যথেষ্ট বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান। স্যার টাইলরের সর্বপ্রাণবাদ তত্ত্ব প্রদানের ২৯ বছর পরে আরেক ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ রবার্ট ম্যারেট ১৯০০ সালে ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত আরেকটি তত্ত্ব প্রদান করলেন। একে pre-animism বা প্রাক-সর্বপ্রাণবাদ বলে প্রচার করা হয়।

ম্যারেট সাহেব মেলিনেশীয় ধর্মতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতে করতে লক্ষ করলেন যে, আদিম মানুষ আত্মা বা anima-র ধারণা লাভের আগে একটি অতি প্রাকৃতিক নৈর্ব্যক্তিক শক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। এটি ভূত-প্রেত, আত্মা-প্রেতাত্মার ঊর্ধ্বে এমন একটি শক্তি যেটিকে অব্যক্তিক বলে চিহ্নিত করেছিল সে যুগের মানুষ। এ শক্তির নাম দিয়েছিল তারা ‘mana’ বা ‘মানা’। তারা বিশ্বাস করত এটি উদ্ভিদ-প্রাণী সবকিছুর ঊর্ধ্বে এমন একটি শক্তি যাকে ধারণ করতে হয়। যাকে ধারণ করলে অসাধ্য সাধন করা যায়। নারী-পুরুষ যে কেউ সেই অবিনশ্বর শক্তিকে তুষ্ট করে তাকে ধারণ করতে পারত এবং অন্যের মাঝে সেটি সঞ্চারিতও করা সম্ভব ছিল।

আদিম মানুষ সেই মানাকে ভয়, ভক্তি ও ভরসা করা শুরু করে। mana শব্দ থেকেই Manaism এর উৎপত্তি যেটি Animatism এর আরেকটি নামও বটে। বাংলায় Animatism এর যোগ্য প্রতিশব্দ হয় মহাপ্রাণবাদ। ম্যারেটের মতে, মানার ধারণা লাভ এবং বিশ্বাসই ছিল আদিম মানুষের আধ্যাত্মিক সাধনা বা সমষ্টিগত পবিত্র চিন্তার সর্বোচ্চ উৎকর্ষ। অ্যানিম্যাটিজম থেকেই মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাসে বিবর্তন শুরু হয়। কালের পরিক্রমায় একেশ্বরবাদ ও বহুশ্বরবাদের জন্ম হয়।

ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব বা Functionalism

ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুর্খেইম ক্রিয়াবাদী তত্ত্বের আলোকে ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, সামাজিক ঐক্য ও সংহতি টিকিয়ে রাখার জন্য ধর্মকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের জীবনে শৃঙ্খলা ও পাপবোধের ব্যাপারে সচেতনতা ও ভীতি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ধর্মের উৎপত্তি। বিশ্বের প্রসিদ্ধ ধর্মগুলোর উৎপত্তির পটভূমি ও ইতিহাসের পাশাপাশি মানবেতিহাসের তুলনামূলক বিশ্লেষণের আলোকে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। তিনি আরো বলেন যে বিশৃঙ্খল সমাজকে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ রকমের অবস্থা থেকে উদ্ধার করে একটি শৃঙ্খলিত ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজে ধাবিত করার একটিই মাত্র উপায় ছিল– মহাজাগতিক, পবিত্র ও অতিপ্রাকৃত শক্তির অবতারণা করা, যেটিতে বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেকে একটি দলভুক্ত হবে এবং কিছু নির্দেশমালা মেনে চলবে কঠোরভাবে।

বিশ্বাসীদের দ্বারা আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে ধর্ম আরো মূর্ত রূপ ধারণ করে। ডুর্খেইমের মতে ধর্ম মূলত চারটি ক্রিয়া বা Functions সম্পাদন করে।

  • শৃঙ্খলা বিধান করে
  • পারস্পরিক সম্পর্ক শক্তিশালী করে
  • সামাজিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদন করে
  • প্রফুল্লতা দান করে

ডুর্খেইমের ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত এ মতবাদটি ঋজু এবং সাবলীল। এ মতবাদে আধ্যাত্মিক চেতনাকেও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। 

মার্কসীয় তত্ত্ব বা Marxism

কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ধর্মকে মনে করেছেন শোষক শ্রেণির একটি হাতিয়ার হিসেবে, যেটিকে তারা ব্যবহার করা হয়েছে সামাজিক অসমতাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। ধর্মকে মার্কস ও এঙ্গেলস সমাজের আর পাঁচটা অনুষঙ্গের মতোই একটি অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। ঐশ্বরিকতা বা মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য পৃথিবীর জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে সংগ্রাম করা থেকে বিরত থাকতে নিষেধ করেছেন তারা। মার্কসের ভাষায়,

Religion is the impotence of the human mind to deal with the occurrences it can not be understood.”

অর্থাৎ, ধর্ম মানব মনের একটি দুর্বলতম অনুষঙ্গ যেটি অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করে মানব মনকে প্রবোধ দেয়।”

মার্কসের মতে, অর্থনীতি হল মানবেতিহাসের বস্তুগত ভিত্তি। দর্শন, শিল্প-সাহিত্যের আগে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের চাহিদা গুরুত্বপূর্ণ। বৈষয়িক চাহিদাগুলো পূরণের জন্য মানুষ সম্পদ সৃষ্টি করে। সম্পদ থেকে ধীরেধীরে রাষ্ট্র, সমাজ, নীতি, আদর্শ, ধর্ম, তত্ত্ব ইত্যাদির জন্ম হয়। মূলভাব হচ্ছে– অর্থনৈতিক উপরিকাঠামোর উপরে মানব সমাজের অন্যান্য বিষয়গুলো দাঁড়িয়ে আছে।

মার্কস ও এঙ্গেলস দেখেছিলেন, মানুষের চারদিকের পরিবেশগত অক্ষমতা এবং সেটি হতে পরিত্রাণের সান্ত্বনা হিসেবেই ধর্মের উদ্ভব হয়েছে। তারা তাদের ‘পুঁজি’এন্টি দ্যুরিং’লুদভিগ ফয়েরবাখ’চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান’-সহ অন্যান্য রচনায় প্রমাণ করে গিয়েছেন যে আদিম সমাজের মানুষের প্রকৃতির সাথে লড়াইয়ের অসহায়ত্ব থেকেই ধর্মের উৎপত্তি। পাশাপাশি, গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের দাস, সামন্ত, পুঁজিবাদী ও প্রাচ্য স্বৈরাচারী পর্যায়গুলোতে শাসক, প্রভু, সামন্ত, রাজাবর্গের শোষণের প্রতি প্রতিবাদের অক্ষমতা বা পরাজয় থেকে যে অসহায়ত্ব সৃষ্টি হয়েছিল সেটি থেকেই মানুষ একটি অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করে। শোষিতের দল মৃত্যু পরবর্তী একটি জীবনে বিশ্বাস করা শুরু করে যেখানে অনন্ত সুখের সংবাদ দিত ধর্মগুরুরা। আর এভাবেই সমাজে ধর্ম একটি শক্তিশালী মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

ধর্ম নিয়ে মার্কসের সবচেয়ে প্রচলিত উক্তিটি হল–

“Religion is…

the sigh of the oppressed creatures,

the sentiment of a heartless world,

and the soul of the soulless conditions.

It is the opium of the people.”

বাংলায়, “ধর্মীয় দুঃখবাদ হচ্ছে বাস্তব দুঃখবাদের প্রকাশ ও বাস্তব দুঃখবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ধর্ম হচ্ছে নির্যাতিত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন এক জগত পরিবেশের কল্পিত আত্মা। ধর্ম জনগণের জন্য আফিম।”

মার্কসের সমালোচনাকারীরা এবং ধর্মান্ধরা শুধু শেষ পঙক্তিটি ব্যবহার করে মার্কসের ধর্মের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গিটি তুলে ধরার জন্য। কিন্তু পুরো বক্তব্যটি পড়লে স্পষ্টতর হয় মার্কসের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি। মার্কসবাদ সর্বদাই বিজ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়েছে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যেটি যুক্তিগ্রাহী সেটিই গ্রহণীয়। অলীক কল্পনা বা যুক্তিহীন বিশ্বাসের ওপর মার্কসবাদ তৈরি হয়নি। মার্কস যেমন শ্রেণিবৈষম্যেহীন ইউটোপিয়ান সমাজের ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন তেমনই ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন অলীক বিশ্বাস ও কপোল কল্পনার অবসান হয়ে একটি যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক সমাজের উদ্ভবের। মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করে সমাজ যত প্রগতির দিকে অগ্রসর হবে তত সেখানে ধর্মের গুরুত্ব হ্রাস পাবে।

[ বি:দ্র: নমুনা উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)]

ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক তত্ত্বগুলোর পারস্পরিক তুলনা

ধর্মের উৎপত্তিগত সামাজিক তত্ত্বগুলোর একেকটির একেকরকম স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। তত্ত্বগুলোর কোনোটিই পর্যালোচনা বা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তত্ত্বগুলো নিজেদের মধ্যে তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যাবে।

সর্বপ্রাণবাদ  মহাপ্রাণবাদের তুলনা

সর্বপ্রাণবাদ ও মহাপ্রাণবাদ দুটোই ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত প্রাচীন বিশ্বাস ও রীতি-নীতিকে প্রকাশ করে। দুটো তত্ত্বের মাঝেই রীতিগত জায়গায় কিছুটা মিল লক্ষণীয়। একটি ছকের মাধ্যমে দুটো মতবাদের বৈশিষ্ট্যাবলীর আলোকে মিল-অমিলগত একটি তুলনা তুলে ধরা হল-

বৈশিষ্ট্যমহাপ্রাণবাদসর্বপ্রাণবাদ
সংজ্ঞাব্যক্তিসত্তাহীন এমন একটি শক্তিতে বিশ্বাস যেটি সকল জীবন্ত ও জড় পদার্থে বিদ্যমান এবং যার উপস্থিতিতে কেউ অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হয়।সকল ইতর প্রাণী, উদ্ভিদ, নদী-সাগর, বজ্রপাত, স্থান, পদার্থ এমনকি শব্দেও একটি আলাদা সত্তার নির্যাস বা আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস।
প্রবর্তকব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ রবার্ট ম্যারেট ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে এ মতবাদ প্রদান করেন।আরেক ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ স্যার এডওয়ার্ড বার্নেট টাইলর ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে এ মতবাদ প্রদান করেন।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যএ মতবাদে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রতাকে উপেক্ষা করা হয়েছে কারণ এখানে এমন একটি শক্তির অস্তিত্বে বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে যেটি ব্যক্তির ঊর্ধ্বে।এখানে, ব্যক্তি-প্রাণীসহ প্রতিটি জীবন্ত সত্তায় আলাদা আলাদা আত্মার উপস্থিতিকে স্বীকৃতি দিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে গুরুত্ববহ করা হয়েছে।
সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী‘মানা’-কেই সর্বোচ্চ স্থানে স্থাপন করেছেন ম্যারেট।‘আত্মা’-ই সবার উপরে সর্বপ্রাণবাদীদের কাছে।
মৃত্যু পরবর্তী ভাবনামানাকে তুষ্ট করে যে মানার অধিকারী হতে পারবে সেই মৃত্যুর মাধ্যমে মুক্তি পাবে।মৃত্যুর পরে আত্মা নবরূপে আবির্ভূত হতে পারে নবসত্তায় অথবা অজান্তেই প্রেতচ্ছায়া হয়েও ঘুরতে পারে।
সাধারণত্বমহাপ্রাণবাদীরা একটি সাধারণ মহাশক্তি ‘মানা’য় বিশ্বাস করে।সর্বপ্রাণবাদীরা আলাদা আলাদা আত্মার অধিকারী মনে করে সবাইকে।
অন্য নামমহাপ্রাণবাদের বা Animatism এর আরেক নাম প্রাক-সর্বপ্রাণবাদ। ইংরেজিতে Manaism-ও বলা হয় একে।সর্বপ্রাণবাদের বা Animism এর অন্য কোনো নাম নেই। 
সফলতা  স্বীকৃতিমহাপ্রাণবাদকে সমাজবিজ্ঞানীরা অধিক যুক্তিযুক্ত ও অভেদ্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।সর্বপ্রাণবাদকে যুক্তিযুক্ত বলা হলেও দালিলিক প্রমাণাদির অভাবে অনেকেই এ মতবাদকে স্বীকার করেন না।
উপসনা এবং আনুষ্ঠানিকতাইতিবাচক চেতনা ও অর্চনার মাধ্যমে প্রসাদ বিতরণ; কবজ-মাদুলি ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যায় মহাপ্রাণবাদীদের মাঝে।উপাসনার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে– নিজেকে প্রকৃতির একটি পুণ্য আত্মায় পরিণত করা। সকল জীবকে ও প্রাকৃতিক সত্তাকে সমান জ্ঞান করা।

চার তত্ত্বের পর্যালোচনা

ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত পূর্বোল্লিখিত চারটি তত্ত্ব (দেখুন- ধর্মের উৎপত্তি ব্যাখ্যায় কতিপয় সামাজিক তত্ত্ব) সমাজবিজ্ঞানে সবচেয়ে লোকপ্রিয়। মার্কসের দর্শন পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে তার ধর্মভিত্তিক চেতনাটিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মার্কসবাদীরা সবকিছুর পেছনেই একটি বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধান করতে ভালোবাসে। সে দৃষ্টিকোণ থেকেই তারা মার্কসের ধর্মের উৎপত্তি ও প্রসার সংক্রান্ত তত্ত্বটি গ্রহণ করেছে শুদ্ধ অন্তঃকরণে।

ডুর্খেইমের ক্রিয়াবাদী তত্ত্বটিতে সাবলীলভাবে বলা হয়েছে ধর্মের উৎপত্তির ব্যাপারে। ক্রিয়াবাদী তত্ত্বে বলা হয়েছে যে সচেতনভাবেই একটি গোষ্ঠীর হাত ধরে ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। সে গোষ্ঠী সমাজভেদে হিতৈষী বা সুবিধাভোগী দু’য়ের যেকোনো একটি হতে পারে। মার্কস ও ডুর্খেইমের তত্ত্বের মাঝে কিছু কিছু মিল পাওয়া যায়। মার্কস সরাসরি ঘোষণা করলেও ডুর্খেইম অপ্রত্যক্ষভাবে স্বীকার করেছেন যে ধর্ম সমাজে অসমতাকে টিকিয়ে রেখেছে। মার্কসের কাঠখোট্টা বিশ্লেষণ গোঁড়ারা তো নয়ই অনেক সমাজবিজ্ঞানীও মেনে নেননি। যারা তার অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত তত্ত্বকে আস্তাকুড়ে ফেলেছেন তারাই তার ধর্মের উৎপত্তিগত তত্ত্বকেও বোগাস আখ্যায়িত করেছেন।

মার্কস এবং ডুর্খেইম কেউই অতিপ্রাকৃত কোনো শক্তি বা পরমাত্মা/আত্মার প্রভাবে ধর্মের গোড়াপত্তন হয়েছে এমনটি বিশ্বাস করেননি। আধ্যাত্মিকতা বলতে নিজেকে জানা বা আত্মানুসন্ধানকে ন্যায্যতা প্রদান করা হলেও প্রেতচ্ছায়ার অস্তিত্বকে সরাসরি অগ্রাহ্য করা হয়েছে মার্কসবাদে। সর্বপ্রাণবাদ ও মহাপ্রাণবাদের সাথে ক্রিয়াবাদ ও মার্কসবাদের তুলনা করলে অনেক জায়গাতেই বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। সর্বপ্রাণবাদ থেকেই টোটেম, ফেটিশ, প্রকৃতিপূজা ইত্যাদির গোড়াপত্তনের একটি সুন্দর সাযুজ্য লক্ষ করা গেলেও ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব বা মার্কসবাদে তেমনটি যায় না।

মহাপ্রাণবাদে আরেকটি ব্যাপার লক্ষ করার মতো। সেটি হচ্ছে– একটি সাধারণ মহাশক্তি বা মানার আরাধনা বা মানাকে ধারণ করাটা সেখানে তপস্যার প্রধানতম লক্ষ্য হওয়ায় মানব মনে অব্যক্তিক ঈশ্বরের অপ্রত্যক্ষ উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। ফলতঃ মানুষ সামাজিক জীবনে একটি অবলম্বন পায়। মহাপ্রাণবাদ এবং সর্বপ্রাণবাদকে প্রাচীন আর্য ভারতীয় বৈদিক ধর্মের উত্তরপুরুষ হিসেবেও অনেক সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করেছেন। আর্যরা এমন একটি নিরাকার ও নিরাসক্ত ব্রহ্মের কথা তাদের প্রধানতম ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’-এ, বিশেষ করে ‘ঋগ্বেদ’-এ উল্লেখ করেছিল যার সাথে মানার সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।

আবার, আদিবাসী অনার্যদের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসেও নিরাকার একটি পরম সত্তার উপস্থিতি দেখা গিয়েছে। আর্য-অনার্য জীবনাচরণ সমান্তরাল হলেও সমান হয়নি। অনার্যরা দাস, শূদ্র হয়েই তাদের জীবন পার করেছে। হাজার বছরের ধর্মাচরণে বৈদিক আর্য ধর্ম পরিমার্জিত ও পরিবর্তিত হয়েছে। একটি সুশৃঙ্খলিত সমাজ প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে আর্যরা ঋগ্বেদ রচনা করে সামাজিক কাঠামো নির্মাণ করলেও যুগান্তরে সেটি শাসনের হাতিয়ারে পরিণত হয়। শূদ্রদের নিচু-হীন বলে পরিচিত করানো হয়। তারা তাদের এ অবস্থার জন্য পূর্বজন্মের কৃত পাপকে দোষী সাব্যস্ত করতে থাকে।

এখানে আবার মার্কসীয় তত্ত্ব ও ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আব্রাহামি ধর্মগুলোর কথা বিবেচনা করা যাক। খ্রিষ্টান, ইহুদি ও ইসলাম তিনটি বর্তমানে প্রচলিত আব্রাহামি ধর্মগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও লোকপ্রিয়। এ তিন ধর্মাবলম্বীরা প্রত্যেকেই আব্রাহাম বা ইবরাহিমকে ঈশ্বরের প্রেরিত দূত বা পয়গম্বর বলে বিশ্বাস করেন। বিশ্বাসগত দিক থেকে আব্রাহামকে জাতির পিতাও বলা হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা তাকে ‘খলিলুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেন। একেশ্বরবাদ যারা প্রচার করেছেন তাদের ভেতর পয়গম্বর আব্রাহাম সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ। তিনি তৎকালীন ইরাকের উর নামীয় একটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন রাজপুরোহিতের ঘরে। যৌবনে পদার্পণের পরে সমাজের অসামঞ্জস্যতা নিয়ে তিনি অতিমাত্রায় চিন্তিত ও ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেক চিন্তা চেতনার পরে তিনি একেশ্বরবাদী নতুন ধর্মের প্রবর্তন করেন।

সমাজে প্রচলিত অন্যায় ও বৈষম্যকে হটিয়ে সুশৃঙ্খল সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এবং প্রচলিত আধ্যাত্মিকতার ঊর্ধ্বে নতুন একটি ঈশ্বরত্বের সংবাদ দিয়ে তিনি তার নব-ধর্মের অনুসারী সংগ্রহ করা শুরু করেন। কালান্তরে ইহুদীবাদ, খ্রিস্টানিটি এবং ইসলামের জন্ম হয় আব্রাহামের প্রচারিত মতবাদ থেকে। এখানেও, ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব ও মার্কসীয় তত্ত্বের বৈষয়িকতা লক্ষ করা যায়।

ধর্ম ও ধর্মভিত্তিক আলোচনাকে সমাজবিজ্ঞানের উপশাখা সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে স্থান দেওয়া হলেও সমাজবিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখায় ধর্মের অনুষঙ্গ খুব স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। পৃথিবীতে কয়েক হাজারের মতো ধর্ম ও মতবাদ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে যেগুলো মানুষের নিত্যদিনকার কার্যকলাপকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। তাই, ধর্মভিত্তিক গবেষণা, আলোচনা, সমালোচনা এক হিসেবে মানুষের যাপিত জীবনের ব্যবচ্ছেদেরই শামিল।

ধর্মের ভবিষ্যৎ  ভবিষ্যতের ধর্ম

আগামী শতাব্দীগুলোতে ধর্মের অস্তিত্ব সংক্রান্ত আলোচনা বা মতামত শুরুর আগে বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি উক্তি বলে শুরু করা যাক –

“I am deeply a religious non-believer–

That is a some kind of religion.”

অর্থাৎ, আইনস্টাইন বলছেন, “আমি একজন গোঁড়া অবিশ্বাসী– কিন্তু, সেটাও যে একধরনের ধর্মের আওতাভুক্ত হয়ে গেল।”

মাইক্রোবায়োলজির জনক লুই পাস্তুর বলেছিলেন –

“Little science takes you away from God, but more of it takes you to him.”

অর্থাৎ, “অল্পবিজ্ঞান তোমাকে ঈশ্বরচ্যুত করলেও, গভীর বিজ্ঞান তোমাকে তার সাথে লীন করবে।”

লুই পাস্তুরের কথাটি ধর্মের অস্তিত্বের ব্যাপারে সরাসরি নির্দেশনা দিতে পারে অনুসন্ধানকারীদেরকে। ধর্মের মূল বা সঠিকতা বুঝতে হলে ধর্ম প্রবর্তকদের জীবনাচরণের দিতে খেয়াল করতে হবে। খেয়াল করে দেখা গেছে- তাদের একাগ্রতা, আধ্যাত্মিকতা, জ্ঞান ও প্রাচুর্যতা পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে ক্ষীয়মাণ হয়ে প্রবেশ করেছে। ধীরে ধীরে বিশুদ্ধ মতবাদ অশুদ্ধ হওয়া শুরু করে। যুগান্তরে যুগোপযোগীতা হারায়। তারপর স্ববিরোধীতার জন্ম হয়। আরেকটি নতুন মতবাদের বীজ উপ্ত হয় সেখান থেকে। একসময় নতুন আরেকটি মতবাদ জন্ম নেয়।

গত, ৫০০০ বছর এভাবেই চলছে। তবে যে যাই বলুক, সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ধর্মের অবদান সবচেয়ে বেশি। শ্রেণিদ্বন্দ্ব, গোষ্ঠীবৈষম্য যতদিন থাকবে ততদিন মানুষের প্রতি দুঃখ-কষ্ট, অন্যায়-অনাচারও থাকবে। নির্যাতিত অসহায় মানুষ এসে আশ্রয় নেবে ধর্মের ছায়াতলে। পাপ-পুণ্যের হিসাব বা পরলৌকিক জীবনের প্রতি বিশ্বাস বা ভয় মানুষকে ধাবিত করবে সৎকাজের প্রতি। ভলতেয়ার বলেছিলেন,

It’s impossible to believe in god like it’s impossible not to believe in him.”

“If there were no God, it would have been necessary to invent him.”

“ঈশ্বরে বিশ্বাস করা যেমন অসম্ভবপর, তেমনই অসম্ভবপর ঈশ্বরে বিশ্বাস না করা।”

“যদি সত্যিকারের ঈশ্বর বলতে কেউ নাও থাকত, তবুও আমাদের একজন ঈশ্বরকে সৃষ্টি করতে হত।”

[ বি:দ্র: নমুনা উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)]

মানবজীবনে ধর্মের গুরুত্ব, প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মানবজীবনে ধর্মের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিম্নরূপ :

১. মানসিক শান্তি (Mental Peace) : মানুষের মানসিক প্রশান্তি লাভে ধর্ম বিশেষ ভূমিকা পালন করে। একমাত্র ধর্মই পারে মানসিক শান্তি আনতে। মুসলমানরা যখন মসজিদে অবস্থান করে, তখন তারা একটি বিশেষ শান্তি অনুভব করে।

বিজ্ঞাপনমসজিদকে সব সময় একটি শীতল পবিত্র স্থান মনে হয়। ঠিক তেমনি অন্যান্য ধর্মের লোকজন তাদের উপাসনালয়ে গিয়ে শান্তি অনুভব করে।

২. জীবনের নিরাপত্তা বিধান (Safeguard of Life) : প্রত্যেক নাগরিকের কাছে তার নিজের জীবন সবচেয়ে মূল্যবান। ধর্ম মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি ধর্মে অন্যায় হত্যাকাণ্ডকে মহাপাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। হত্যাকারীর জন্য সর্বোচ্চ দণ্ডবিধান মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রীতিও বেশির ভাগ ধর্মে অনুসৃত হয়েছে।

৩. ঐক্য সাধন (Act of establishing Unity) : মানুষের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টিতে ধর্ম ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে একটি গভীর ঐক্য লক্ষ করা যায়। যদি কোনো ধর্মের লোক অন্য কোনো ধর্মের লোকের কাছে শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তার ধর্মের লোকজন একত্র হয়ে তাকে সাহায্য করে।

৪. সম্পদের নিরাপত্তা বিধান (Safeguard of Wealth) : জীবনের পরেই মানুষের অত্যন্ত প্রিয় বস্তু সহায়-সম্পদ তথা ধন-সম্পদ। ধর্ম মানুষের সম্পদের নিরাপত্তা বিধানে যথাযথ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি ধর্মে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, অর্থ আত্মসাৎ, লুণ্ঠন ও অবৈধ উপার্জন অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এসব কাজকর্মের জন্য শাস্তির বিধান আছে। অন্যের অর্থ-সম্পদ অবৈধভাবে দখল বা আত্মসাৎ করাকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছে।

৫. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ (Social Control) : সমাজ পরিচালনার নানা বিষয়ে ধর্ম বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ধর্মের সঠিক ব্যবহারই সমাজকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

৬. সম্মানের নিরাপত্তা বিধান (Safeguard of Prestige) : ধর্ম মানুষের সম্মান ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধান করে। কারণ মান-সম্ভ্রম মানুষের জীবন ও সম্পদের চেয়েও বেশি প্রিয় বলে প্রতীয়মান হয়। মানুষ তার ইজ্জত, সম্মান রক্ষার জন্য অকাতরে সম্পদ ব্যয় করে, জীবন উৎসর্গ করে। প্রতিটি ধর্মে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া, অহংকার করা, মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা, ছোট করা বা অসম্মান করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা, মিথ্যা দোষারোপ, চোগলখুরি, কু-ধারণা, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, কারো সম্মানে আঘাত লাগে—এমন কথা বলা বা কাজ করা ইত্যাদিকে সব ধর্মে পরিহার করতে বলা হয়েছে।

৭. ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম (Religion in Personal Life) : ব্যক্তিগত জীবনকে সমাজসিদ্ধভাবে পরিচালনা করতে ধর্মের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম মানুষকে সৎ, কর্মঠ, দায়িত্বশীল, সহানুভূতিশীল ও পরস্পরকে ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। ব্যক্তির স্বাস্থ্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পবিত্রতা, সৌন্দর্য, আহার-বিহার, চিত্তবিনোদন, শিক্ষা, বিবেক-বুদ্ধি, অল্পে তুষ্টি, চারিত্রিক স্বচ্ছতা, কর্মোদ্যম, ধীরস্থিরতা, বিচক্ষণতা, বিনয় নম্রতা, ভদ্রতা, মহানুভবতা, সততা, নৈতিকতা, পরার্থপরতা, ভালো কাজ, অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রায় সব ধর্মে শিক্ষা দেওয়া হয়।

৮. পারিবারিক জীবনে ধর্ম (Religion in Family Life) : পরিবার সমাজের একটি ক্ষুদ্রতম আদিম সংগঠন। বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে পরিবারব্যবস্থা গড়ে ওঠে। বিবাহবন্ধন না থাকলে তরুণ-তরুণীদের অবাধ মেলামেশা, অবাধ যৌনাচার, লিভ টুগেদার, সমকামিতা, ব্যভিচার, ধর্ষণ, বিবাহের নামে অনেক স্ত্রী গ্রহণ প্রভৃতির দ্বারা মানবজাতি পাপপঙ্কিলতায় নিমজ্জিত হতো। তাই বিবাহ একটি সুষ্ঠু পারিবারিক জীবন উপহার দেয়, যেখানে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন মিলে সুখে-শান্তিতে বসবাস করে। বিশ্বের সব ধর্ম পরিবারব্যবস্থাকে অটুট ও স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৯. সামাজিক জীবনে ধর্ম (Religion in Social Life) : সমাজজীবনকে স্বাভাবিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ, মূল্যবোধ, নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক সংহতি বিকাশে ধর্মের ভূমিকা অতুলনীয়। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মানুষ একত্র হয়ে পারস্পরিক সহানুভূতি ও প্রীতির সঞ্চার করে। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মে মানবপ্রেম, মানবসেবা, পরার্থপরতা, দয়া, সহনশীলতা, সহযোগিতা, সদাচার প্রভৃতির শিক্ষা দেওয়া হয়।

১০. রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্ম (Religion in State Life) : পৃথিবীর প্রতিটি দেশে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠার পেছনে ধর্মের ভূমিকা অনন্য। যে দেশে যে ধর্মের লোক বেশি, সাধারণত সেই ধর্মের লোকজন ক্ষমতায় আরোহণ করে। ধর্মের কারণেই রাষ্ট্র সুসংহত ও স্থায়ী হয়। তাই যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত থাকেন, তাঁরা যেন স্বেচ্ছাচারী, কর্তৃত্ববাদী না হন, ধর্ম সেই শিক্ষাই দেয়। ধর্ম রাষ্ট্রের প্রধানকে প্রজাপালক, প্রজাকল্যাণকর ও জনদরদি হতে নির্দেশ দেয়। জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি সব ধর্মের দিকনির্দেশনা রয়েছে।

১১. আন্তর্জাতিক জীবনে ধর্ম (Religion in International Life) : বিশ্বভ্রাতৃত্ব সৃষ্টিতে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। পৃথিবীর সব মানুষ উৎসগত বিবেচনায় এক ও অভিন্ন। তাদের মা-বাবা এক, সৃষ্টিকর্তা এক এবং তাদের জীবনের উদ্ভব, বিকাশ ও গন্তব্য এক। ধর্ম একান্তভাবে বিশ্বমানবকে পারস্পরিক অভিন্নতার এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে।

প্রশ্ন ও মতামত জানাতে পারেন আমাদের কে ইমেল : info@banglanewsexpress.com

আমরা আছি নিচের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুলোতে ও

Leave a Comment