১৯১৯ সালের দ্বৈত শাসনব্যবস্থা বলতে কি বুঝ?, দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি ও পরিধি আলোচনা কর।
ভূমিকা : শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯০৯ সালে সংস্কার আইন পাস করেন ৷ এ আইন পাস হলে কংগ্রেসের উদারপন্থি নেতা গোখলে প্রথম এ আইনকে উদার ও ন্যায্য বলে অভিনন্দিত করেন।
কিন্তু যে সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯০৯ সালের আইন প্রণয়ন করা হয় তা বাস্তবায়িত না হলে আবার ভারতে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক জটিলতা দেখা দেয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য এক দশক পর আবার ১৯১৯ সালে আইন প্রণয়ন করেন। তবে এ আইন প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে ভারত সচিব এডুইন মন্টেগু এবং বড়লাট চেমসফোর্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ আইনে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল। এ দ্বৈত শাসনব্যবস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল শাসনতান্ত্রিক সমস্যার সমাধান করা ।
দ্বৈত শাসনব্যবস্থা : দ্বৈতশাসনের কথা বলতে সাধারণত দুই ধরনের শাসনব্যবস্থাকে বুঝায়। অন্যদিকে দ্বৈতশাসন বলতে প্রশাসনে দুটি কর্তৃপক্ষের উপস্থিতি বুঝায়। এছাড়া দ্বৈতশাসনের আলোচনায় Dyarchy শব্দটি এসে যায়। Dyarchy শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দের যৌগিক। Di শব্দের অর্থ twice বা দুই এবং archic শব্দের অর্থ Rule বা শাসন। এ থেকে বুঝা যায় যে, Dyarchy শব্দের অর্থ দুই সরকার বা দ্বৈত শাসনব্যবস্থা।
দ্বৈতশাসনের মূল কথা হল, সরকারের বিভিন্ন বিষয়সমূহকে দুই ভাগে ভাগ করে শাসন করা। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী প্রাদেশিক সরকারের বিষয়গুলোকে দুভাগে ভাগ করা হয়। যথা : (১) সংরক্ষিত বিষয় (Reserved Subject) ও (২) হস্তান্তরিত বিষয (Transferred Subject)।
সংরক্ষিত বিষয়সমূহ প্রাদেশিক গভর্নর তার শাসন পরিষদের সহায়তা ও পরামর্শক্রমে শাসন করতেন। সংরক্ষিত বিষয়গুলো ছিল বিচার, পুলিশ, জল সরবরাহ, অর্থ, কলকারখানা, জলবিদ্যুৎ, সংবাদপত্র, গৃহনির্মাণ, ভূমি রাজস্ব, কৃষি ঋণ ইত্যাদি। অন্যদিকে হস্তান্তরিত বিষয়সমূহ যথা : শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, কৃষি, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন, পূর্ত বিভাগ, সমবায়, আবগারি বিভাগ ইত্যাদি। গভর্নর মন্ত্রিসভার পরামর্শক্রমে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। অতএব বলা যায়, শাসন ক্ষেত্রে প্রাদেশিক ক্ষেত্রে এরূপ যে নীতি তা দ্বৈত শাসনব্যবস্থা নামে খ্যাত।
দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য : ব্রিটিশ সরকারের ভারত শাসন আইন প্রবর্তনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা। ভারতে দায়িত্বশীল শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কথা দিয়ে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালের আইন প্রবর্তন করেন। তবে এক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের নীতি ছিল ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া বা ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। কারণ, তাদের মতে, পরিপূর্ণ স্বশাসনের চাপ বহন করা ভারতীয়দের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সুতরাং ব্রিটিশ সরকারের দ্বৈতশাসন প্রবর্তনের মূল লক্ষ্য ছিল প্রশাসনের মধ্যে ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত করা। যাতে ভবিষ্যতে স্বায়ত্তশাসনের জন্য রাজনৈতিক প্রথা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এছাড়া ব্রিটিশ সরকারও ভারতীয় জনগণের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করাও তাদের লক্ষ্য ছিল।
দ্বৈতশাসনের প্রকৃতি ও পরিধি ঃ ১৯১৯ সালে প্রাদেশিক প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে যে শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেন তার মাধ্যমে ১৯২১ সাল হতে ভারতের ৮টি প্রদেশে যথা- বার্মা, বাংলা, বিহার, মাদ্রাজ, আসাম, বোম্বে, যুক্তপ্রদেশ এবং পাঞ্চাবে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। ১৯৩২ সালে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ দ্বৈত শাসনব্যবস্থার অধীনে আনা হয়। ১৯১৯ সালে প্রদেশে যে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয় তা ১৬ বছর ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রথম থেকে এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভারতের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল যথা : কংগ্রেস তাঁর বিরোধিতা শুরু করেন।
এ ব্যবস্থায় ১৯২০ সালের অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে কংগ্রেস অস্বীকৃতি জনায়। এ সময় কংগ্রেসের মধ্যপন্থি রাজনীতিকরা ১৯১৯ সালের সংস্কারকে সমর্থন করেন এবং দ্বৈতশাসন কার্যকর করার উদ্দেশ্যে National Liberal Rederation নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং ১৯২০ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসের মধ্য থেকে বেড়িয়ে এসে চিত্তরঞ্চন দাস ও মতিলাল নেহেরু ‘স্বরাজ দল’ নামে একটি দল গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং আইন পরিষদে বিপুল সংখ্যাধিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন।
তবে আদর্শগত আলোচনায় দেখা যায়, স্বরাজ দলের উদ্দেশ্য ছিল সংবিধানকে কার্যকর না করার উদ্দেশ্যে ভিতর হতে বানচাল করার চক্রান্ত। এ ধরনের অবস্থায় ১৯২৪/২৬ সালের মধ্যে যুক্ত প্রদেশ ও বাংলায় সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। অন্যান্য প্রদেশসমূহে গভর্নর ও মন্ত্রীদের দ্বন্দ্বের ফলে প্রশাসনে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। ফলে দেখা যায় যে, এ ব্যবস্থায় জটিলতা দেখা দেয়। তবে এ ব্যবস্থা বেশি দিন টিকে থাকে নি। ১৯৩৭ সালে ১৯১৯ সালের দ্বৈত শাসনব্যবস্থার বিলোপ সাধন করা হয়।
দ্বৈত শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা : ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে প্রবর্তিত দ্বৈত শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার অনেক কারণ ছিল। যথা :
১. ত্রুটিপূর্ণ বিভাজন নীতি : ১৯১৯ সালের আইনে যে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে প্রদেশে দ্বৈতশাসন প্রবর্তনের নীতি গৃহীত হয় তা ছিল প্রকৃতিগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ। এক্ষেত্রে আলোচনায় বলা যায়, সরকার একটি গোটা প্রতিষ্ঠান, কাজেই একে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায় না। যদি বিভক্ত করা হয় তা হবে রাজনৈতিক তত্ত্ব ও নীতিমালার পরিপন্থি। কিন্তু ১৯১৯ সালের আইনে প্রদেশের বিষয়সমূহ সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত এ দুই ভাগে ভাগ করার ফলে শাসনতান্ত্রিক জটিলতা দেখা দেয়। কারণ, এখানে প্রাদেশিক সরকারের একাংশ আইনসভার কাছে এবং অপরাংশ জনগণের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। এরূপ জটিলতায় এ শাসন ব্যর্থ হতে বাধ্য।
২. শাসনতান্ত্রিক জটিলতা : দ্বৈত শাসনব্যবস্থায় সরকারের বিষয়গুলোকে বিভক্ত করার ফলে শাসনকার্যে জটিলতা দেখা দেয়। ফলে প্রদেশের উন্নতি নানাভাবে ব্যাহত হয়। যেমন দেখা যায়, মাদ্রাজের তদানিন্তন মন্ত্রী K. V. Reddy কে জলসেচের দায়িত্ব ছাড়াই মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু জল সেচ ছিল গভর্নরের সংরক্ষিত বিষয় । শিক্ষা হস্তান্তরিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হলেও ইউরোপীয় এবং এ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের শিক্ষা সংরক্ষিত বিষয়ে রাখা হয় ।
৩. মন্ত্রিসভার মধ্যে সুসম্পর্কের অভাব : গভর্নরের শাসন পরিষদের সদস্যদের সাথে মন্ত্রিসভার সুসম্পর্ক ছিল না। কারণ, প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রীরা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হতেন এবং গভর্নরের শাসন পরিষদের সদস্যরা গভর্নর কর্তৃক মনোনীত হন। ফলে দুই মন্ত্রিসভার সদস্যরা ঐকমত্যে আসতে পারেন নি। ফলে মন্ত্রীদের বিরোধের জন্য প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। একপর্যায়ে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের সাথে কাউন্সিলের সদস্যদের বিরোধ বেধে যায়। এ অবস্থায় বিরোধ বাধলে স্বাভাবিকভাবে গভর্নর স্বজনপ্রীতির দ্বারা পরিচালিত হয়ে মনোনীত শাসন পরিষদের সদস্যদের সমর্থন করেন।
৪. গভর্নরের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা : এ দ্বৈত শাসনব্যবস্থায় প্রাদেশিক মন্ত্রীদেরকে দু’দিক নিয়ন্ত্রণ করতে হতো। এতে দেখা যায়, একদিকে গভর্নরের অধীনে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে সমস্যা হল একজন মন্ত্রী গভর্নর কর্তৃক নিযুক্ত এবং তাদেরকে এজন্য গভর্নরের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে হতো। অন্যদিকে নিজ নিজ বিভাগের কাজ করার জন্য প্রাদেশিক আইনসভার কাছে দায়ী থাকতে হতো। তাই তাদের দুকূল রক্ষা করে চলতে হতো। কারণ, গভর্নরের সাথে বেশি সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হতো এবং আইসভা যাতে অনাস্থা প্রস্তাব পাস করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হতো। তবে এক্ষেত্রে গভর্নরের একাধিপত্য বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ধরনের ব্যবস্থা আদৌ টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না।
৫. মন্ত্রীদের দায়িত্বহীনতা : মন্ত্রীদের যৌথ দায়িত্বের নীতিকে প্রাদেশিক গভর্নররা কখনও স্বীকার করেন নি। কারণ, দেখা যায়, মন্ত্রীরা কখনোই সংঘবদ্ধ দল হিসেবে কাজ করত না। তাদের মধ্যে সর্বদা দ্বন্দ্ব লেগে থাকত। উদাহরণস্বরূপ Calcutta Municipal Bilকে কেন্দ্র করে নবাব সাহেবের সাথে সুরেন্দ্রনাথের বিরোধ কিংবা ফিরোজ খান নুন কর্তৃক হিন্দু কর্মীদের সমালোচনা। এ ধরনের অবস্থায় মন্ত্রীরা দায়িত্বহীনভাবে কাজ করতে থাকেন। যার ফলে শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধান হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল।
৬. ভারত সচিবের নিয়ন্ত্রণ : এ দ্বৈত শাসনব্যবস্থায় ভারত সচিবের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু এ নিয়ন্ত্রণ ছিল মন্ত্রীদের কাছে অষন্তোষজনক। কারণ, এতে দেখা যায়, হস্তান্তরিত বিষয়গুলোতে জড়িত কর্মচারীদেরকে নিয়ন্ত্রণ করত ভারত সচিব। এতে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের উপর মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা না হয়ে সচিবের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। এ ব্যবস্থা ছিল শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে বিরোধপূর্ণ। এতে মন্ত্রীদের পদমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। সুতরাং এ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না ।
৭. সচিব বা বিভাগীয় প্রধানদের প্রাধান্য : এ শাসনব্যবস্থার নিয়মানুযায়ী দেখা যায়, মন্ত্রীদের সাথে সচিব বা প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত বিভাগীয় প্রধানদের বিরোধ দেখা দেয়। এ বিরোধে দেখা যায়, সচিবের সাথে বা বিভাগীয় প্রধানদের সাথে গভর্নরের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকায় গভর্নর প্রায়ই সচিব বা বিভাগীয় প্রধানদের পক্ষ অবলম্বন করত। ফলে মন্ত্রীদের পদমর্যাদায় আঘাত লাগত ।
৮. অর্থকে সংরক্ষিত বিষয়ভুক্তকরণ : এ শাসনব্যবস্থা ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হল অর্থকে সংরক্ষিত বিষয়ভুক্তকরণ। এতে দেখা যায়, জাতি গঠনমূলক বা উন্নয়নমূলক কার্যাদির দায়িত্ব মন্ত্রীদের উপর অর্পণ করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহের ক্ষমতা দেওয়া হয় গভর্নরের শাসন পরিষদের হাতে। ফলে মন্ত্রীদের নিজস্ব কার্যাদি পালনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য অর্থ সচিবের উপর নির্ভর করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু অর্থ সচিব ভারতের সিভিল সার্ভিসের সদস্য হওয়ায় ভারতীয় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি তার কোন সহানুভূতি ছিল না। তিনি হস্তান্তরিত বিষয়গুলোর চেয়ে সংরক্ষিত বিষয়ের প্রতি বেশি যত্নবান ছিলেন। ফলে অনেক ক্ষেত্র মন্ত্রিগণ জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল লাভে বঞ্চিত হন।
৯. দলীয় ব্যবস্থার বিকাশ না ঘটা : এ ব্যবস্থার ফলে একমাত্র মাদ্রাজ ছাড়া অন্যকোন স্থানে দলীয় ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে নি। কিন্তু দলীয় ব্যবস্থার বিকাশ ছিল দায়িত্বশীল সরকার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার পূর্বশর্ত। কিন্তু এতে দেখা যায়, একমাত্র মাদ্রাজে অব্রাহ্মণ হিন্দুরা জাস্টিস পার্টিতে সমবেত হয়ে ব্রাহ্মণ অভিজাততন্ত্রের আয়েসি আধিপত্য মোকাবিলায় অগ্রসর হন। ফলে অভ্যন্তরীণ প্রশ্নে পার্লামেন্টে মুখোমুখি লড়াই হয়। কিন্তু বাংলায় ঐ সময় যে ‘স্বরাজ পার্টি’ ছিল তা ছিল ভিন্ন ধর্মী। এ পার্টির লক্ষ্য ছিল দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটানো। তাই প্রদেশগুলোতে দ্বৈতশাসন সাফল্য লাভ করতে পারে নি ।
১০. হিন্দু ও মুসলিম বিরোধ : হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ ছিল ভারতে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এ ব্যবস্থা বজায় থাকায় দেখা যায়, দ্বৈতশাসন ব্যর্থ হতে বাধ্য হয়। মুডিম্যান কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপোর্টে সাম্প্রদায়িক বিভেদ . দ্বৈতশাসনের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হয়।
১১. গভর্নরের ব্যাপক ক্ষমতা : দ্বৈতশাসনের ব্যর্থতার আলোচনায় অনেকে গভর্নরের হাতে বেশি ক্ষমতা অর্পণ করাকে অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন। কারণ, এ আইনে গভর্নর সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত বিষয়সমূহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। এতে দেখা যায়, সংরক্ষিত বিষয়ের কোন ব্যয় বরাদ্দ আইনসভা কর্তৃক অনুমোদিত না হলে গভর্নর নিজ দায়িত্বে তা পাস করে নিতেন। তিনি আইন পরিষদ কর্তৃক গৃহীত বিলে ভেটো দিতে পারতেন। তিনি প্রয়োজনবোধে যে কোন বিলকে স্বীয় বিবেচনার জন্য সংরক্ষিত রাখতে পারতেন। সুতরাং গভর্নরের ব্যাপক ক্ষমতাই এ ব্যবস্থা ব্যর্থতার জন্য দায়ী।
১২. আইনের গঠনমূলক ত্রুটি : ১৯১৯ সালের দ্বৈত শাসনব্যবস্থা অন্তর্নিহিত ত্রুটির জন্যই ব্যর্থ হয়। এছাড়া ভারতের ঐ সময়ের কয়েকটি ঘটনা এ আইনের দ্বৈত শাসনব্যবস্থার পতনে অবদান রেখেছিল। যথা- ১৯১৯ সালে ১৩ এপ্রিলে জালিয়ান ওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড, খিলাফত আন্দোলন এবং ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রণীত কিছু নিষ্ঠুর আইন ভারতীয়দের মনে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করেছিল । তাই এ আইন ভারতীয়দের মনে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারে নি।
১৩. কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অসহযোগিতা : ১৯১৯ সালে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মনোভাবকেও অনেকে দায়ী করেছেন। কারণ দেখা যায়, ঐ সময় কংগ্রেসের নেতৃত্বে দেশব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। এছাড়াও অনেক কার্যকলাপ এ আইনের পরিপন্থি বা বাস্তবায়নের পরিপন্থি ছিল। যেমন দেখা যায়, ‘স্বরাজ পার্টি’ খিলাফত আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস থেকে বিভক্ত হয়ে ভারতে শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা যাতে বাস্ত বায়িত না হয় সে চেষ্টা করেন। ফলে এ আইন ব্যর্থ হতে বাধ্য হয় ।
মূল্যায়ন : ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক যে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয় তা ভারতের ইতিহাসে ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে সীমিতভাবে হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অনেকে মনে করেন যে, এ ব্যবস্থার মধ্যে ভারতে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের উৎস নিহিত ছিল। এ আইন প্রণয়ন করার ফলে আইন- পরিষদের পরিধি বৃদ্ধি পায় এবং গণতন্ত্রের এক ধাপ অগ্রসর হওয়া সুবিধা হয়।
এ আইনে বিভিন্ন সংস্কারমুখী পরিকল্পন মন্ত্রীরা গ্রহণ করার ফলে জনগণের সেবার মান বৃদ্ধি পায়। শাসন বিভাগ ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের অংশগ্রহণের ফলে ভারতীয়দের মধ্যে সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পায়। ফলে স্বশাসনের ক্ষেত্রেও অনেকাংশে প্রস্তুত হয়। তবে এ আইনের অনেক ত্রুটিও ছিল। ত্রুটিতে বলা হয় যে, ১৯১৯ সালের আইনে প্রাদেশিক স্বাতন্ত্র্য ও দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বলে যে দাবি করা হয় সে দাবি প্রহসন ছাড়া আর কিছু ছিল না। ভারতীয়রা এমনকি সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরাও দ্বৈত শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করেন।
এ প্রসঙ্গে R. Palme Dutta বলেছেন, “Dyarchy was Universally Condemned, not only by Indian opinion but also after a few years experience by rulling imperialist opinion. The responsibility of the Indian ministers was admittedly afarce.” তবে যতই সমালোচনা করা হোক না কেন এর ভাল দিকও ছিল, বলা যায়।
উপসংহার : অতএব বলা যায় যে, শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালের আইন পাস করেন এবং আইনের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য দ্বৈতশাসনের প্রবর্তন করেন। যদিও অনেকে দ্বৈতশাসন সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তবে এর মধ্যে সরকারের কল্যাণ নিহিত ছিল। তবে দুঃখ যে, ভারতের জনসাধারণের বিশেষত প্রভাবশালী মহল কংগ্রেস এর জন্য তা বাস্তবায়িত হতে পারে নি ।