১৯০৬ সালের সিমলা ডেপুটেশনের পটভূমি ব্যাখ্যা কর। সিমলা ডেপুটেশন কি মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

১৯০৬ সালের সিমলা ডেপুটেশনের পটভূমি ব্যাখ্যা কর। সিমলা ডেপুটেশন কি মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল?


ভূমিকা : ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেন নি। তবে ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্রিটিশ শাসনকে স্বাগত জানায় এবং নিজেদের স্থান সমাজে করে নিতে সক্ষম হন। একপর্যায়ে দেখা যায় সকল দিক থেকে ভারতীয় হিন্দুরা স্থান করে নেয় এবং মুসলমানরা অবহেলিত বলে পরিগণিত হয়।

হিন্দুদের সংগঠন বলে খ্যাত কংগ্রেস প্রথম পর্যায়ে ছিল অসাম্প্রদায়িক সংগঠন। কিন্তু পরে কংগ্রেসের কয়েকজন কঠোরপন্থি নেতার জন্য তা সাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয়। তাই ভারতীয় মুসলমানরা নিজেদের একটি কথা বলার মাধ্যম তৈরি করার জন্য প্রচেষ্টা চালান। একপর্যায়ে লর্ড মিন্টোর সময় তারা বেশ তৎপর হন এবং মুসলমানদের পৃথক জাতি হিসেবে পৃথক মর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যে আগা খানের নেতৃত্বে ১৯০৬ সালে বড়লাট মিন্টোর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সিমলায় এ স্থানের নামানুসারে একে বলা হয় সিমলা ডেপুটেশন।


সিমলা ডেপুটেশনের পটভূমি/ প্রেক্ষাপট : ১৯০৬ সালের সিমলা ডেপুটেশন ছিল ভারতীয় মুসলমানদের দাবি আদা য়ের ক্ষেত্রে একটি মাইল ফলক। নিম্নে সিমলা ডেপুটেশনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হল :

প্রথমত, ভারতে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে হিন্দু ও মুসলিম সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়। হিন্দু ও মুসলমানদের যে ধর্মীয় পার্থক্য তা সামাজিক জীবনেও প্রতিফলিত হয়। কারণ, এতে হিন্দুদের সুবিধা ছিল যে, তারা প্রথমেই ব্রিটিশ শাসনকে স্বাগত জানিয়ে সকল দিক থেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেন। ফলে শিক্ষা, সংস্কৃত, বড় বড় চাকরির ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান করে নেন। অন্যদিকে মুসলমানরা প্রথম থেকে ব্রিটিশ সরকারের সংশ্রব বর্জন করেন। ফলে চাকরি, শিক্ষা সকল ক্ষেত্রে মুসলমানরা পিছিয়ে যান। তবে মুসলমানরা এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চেষ্টায় ছিলেন।


দ্বিতীয়ত, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে হিন্দু সমাজে ধর্মীয় জাতীয়তার উপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক জাতীয়তার পত্তন হয়। এসময় অনেক হিন্দু কবি বিশেষ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হেমচন্দ্র, নবীন চন্দ্র সেন, বঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাদের রচনার মাধ্যমে হিন্দুদেরকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন। হিন্দুদের শিক্ষার উন্নতির জন্য কলকাতায় হিন্দু কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলমানদের শিক্ষা গ্রহণের কোন সুযোগ ছিল না। এছাড়া হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষার্থে ঐ সময় কিছু সমিতি যথা ঃ ল্যান্ড হোল্ডারস সোসাইটি, বেঙ্গল ইন্ডিয়া সোসাইটি, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব সমিতির মাধ্যমে হিন্দুরা অবস্থার উন্নতিসাধন করেন। তাই মুসলমানরা নিজেদের উন্নতির জন্য পথ খুঁজতে থাকেন ।


তৃতীয়ত, ভারতবর্ষে হিন্দুরা যখন সামাজিকভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে সমাজের মধ্যে মর্যাদাবান বলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে তখন মুসলিম সমাজে কেবল চেতনাবোধ জাগ্রত হয়। এছাড়া ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর হতে আধুনিকতার আদর্শের ভিত্তির উপর মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের প্রবণতা দেখা দেয়। ১৮৬৩ সালে কলকাতায় নবাব আব্দুল লতিফ মুসলমান শিক্ষা বিষয়ক সমিতি এবং ১৮৭৭ সালে সৈয়দ আমীর আলী কর্তৃক কেন্দ্ৰীয় মোহামেডান এসোসিয়েশন গঠিত হলে এর সূচনা হয়। এ সমিতিগুলোতে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়।


চতুর্থত, ভারতবর্ষে মুসলমানরা যখন অবহেলিত তখন সৈয়দ আহম্মদ খান এর আবির্ভাব হয়। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য ভাবধারা প্রসারের লক্ষ্যে ১৮৭৭ সালে অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে আলীগড়ে এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ কলেজ প্রতিষ্ঠা করে মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের সঞ্চার করার জন্য পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া তিনিই প্রথম কংগ্রেস থেকে মুসলমানদের দূরে থাকতে বলেন। শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে তিনি মনে করতেন, ভারতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হলে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের শাসন সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর স্থাপিত হবে।


পঞ্চমত, ভারতবর্ষে লর্ড কার্জন প্রশাসনিক সুবিধার অজুহাতে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করেন। ফলে মুসলমানদের মধ্যে নতুন জাতীয় চেতনার সঞ্চার হয়। তাই তারা বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত বহাল রাখার জন্য নিজেদেরকে সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালান ।


ষষ্ঠত, বঙ্গভঙ্গের পর ১৯০৬ সালে মর্লি ভারতের দায়িত্ব নিয়ে আসেন। তিনি ভারতের শাসন ক্ষমতায় এসেই ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের কথা ঘোষণা করেন। যে’ ঘোষণা মুসলমানদেরকে ঐক্যবোধ হতে প্রেরণা যোগায় ।


সিমলা ডেপুটেশনঃ ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিয়ে লর্ড মর্লির ঘোষণায় শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের কথা জানতে পেয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ, তাদের মতে, ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভা গঠিত হলে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। তাই নতুন শাসনতন্ত্রে মুসলমানরা তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বড়লাট মিন্টোর কাছে প্রতিনিধি দল পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাই মহসীন উল মুলক কাল বিলম্ব না করে বড়লাট লর্ড মিন্টোর সাথে সাক্ষাতের জন্য একটি প্রতিনিধি দল গঠন করেন। এছাড়া আলীগড়ের অধ্যক্ষ Archibold এর সহযোগিতায় একটি স্মারকলিপি রচনা করেন। মহামান্য তৃতীয় আগা খানকে প্রতিনিধি দলের নেতা নির্বাচন করা হয়। ১৯০৬ সালে ১ অক্টোবর আগা খানের নেতৃত্বে ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল সিমলায় বড়লাট মিন্টোর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। যা ইতিহাসে সিমলা ডেপুটেশন নামে খ্যাত।

সিমলা ডেপুটেশনের বৈশিষ্ট্য/শর্তাবলি/দাবিসমূহ : মুসলমান প্রতিনিধি দল সিমলা ডেপুটেশনে ভারতবর্ষে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কতকগুলো দাবি করেন। দাবিগুলো হল :


১. পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ব্যবস্থা : সিমলা ডেপুটেশনে মুসলমানরা স্থানীয়, প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সমস্ত কাউন্সিলে মুসলমান প্রতিনিধিগণ তাদের পৃথক মুসলিম নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা নির্বাচিত হবেন। এর ব্যতিক্রম করা যাবে না।


২. মুসলমানদের পৃথক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা । তারা মতামত ব্যক্ত করেন যে, ভারতে মুসলমানরা একটি পৃথক সম্প্রদায় এবং তাদের স্বার্থ ও হিন্দুদের / অন্যদের চেয়ে পৃথক। তাই তাদের স্বার্থরক্ষার গ্যারান্টি দিতে হবে। যাতে অন্য সম্প্রদায়ের দ্বারা তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না হয়।


৩. পৃথক অসিন সংরক্ষণ। এতে বলা হয় যে, যেহেতু ভারতে মুসলমানরা সংখ্যায় কম এজন্য জনসংখ্যাগত শক্তি অপেক্ষা বেশি আসন সংরক্ষণ করতে হবে।


৪. আইনসভায় মুসলিম প্রতিনিধি নিয়োগ : সিমলা ডেপুটেশনে মুসলমান প্রতিনিধিরা দাবি করেন, যে আইনসভায় মুসলিম প্রতিনিধিকে কেবলমাত্র মুসলিম ভোটেই নির্বাচিত হওয়ার অধিকার দিতে হবে।

৫. স্থানীয় প্রতিনিধিত্বের সুযোগ মুসলমানদেরকে স্থানীয় পরিষদ যথা : পৌরসভা, জেলা বোর্ডগুলোতে সম্প্রদায়গত প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করতে হবে।


৬. প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্ব । এতে দাবি করা হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সিনেট ও সিন্ডিকেটে মুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষণ (নির্দিষ্ট) করতে হবে।


৭. ব্রিটিশ আনুগত্যের মনোভাব এ ডেপুটেশনের মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ রাজ্যের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ব্যক্ত করেন।


মূল্যায়ন : ১৯০৬ সালে আগা খানের নেতৃত্বে যে মুসলিম প্রতিনিধি দল সিমলায় বড়লাট মিন্টোর সাথে সাক্ষাৎ করেন তা ছিল স্বার্থগত দিক থেকে মুসলমানদের জন্য প্রয়োজনীয়। লেডি মিন্টোর ভাষায়, বড়লাটের সাথে মুসলিম প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎকার ভারতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। লর্ড মিন্টো মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন এবং এ আশ্বাস দেন যে, একটি পৃথক সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থ নিরাপদ রাখা হবে। এছাড়া তিনি আরও বলেন ব্রিটিশ সরকার অতীতে ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ব্যাপারে যে সুবিবেচনা করে এসেছেন তা ভবিষ্যতেও বহাল থাকবে। সিমলা ডেপুটেশনে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর মুসলিম নেতাদের মনে এক বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় এবং তারা মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার প্রচার ও রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার জন্য একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার সংকল্প করেন। ফলে তারা সিমলায় এক ঘরোয়া বৈঠকও করেন এবং বৈঠকে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য খসড়া আলোচনা করেন। এ আলোচনার ফলশ্রুতিতে পরে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।


উপসংহার : অতএব, মুসলমানদের স্বার্থগত বিচারে সিমলা ডেপুটেশনকে এক মাইল ফলক বলা যায়। কারণ, এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে ভারতীয় মুসলমানরা দীর্ঘদিন থেকে তাদের যে বৈষম্যের পাহাড় এর অভিজ্ঞতা তা তুলে ধরে নিজেদের স্বার্থ আদায়ের পথ সুগম করতে সক্ষম হন। যদি তারা এ বৈঠক করতে না পারতো তাহলে হয়তো ইতিহাস অন্য ধারায় প্রবাহিত হতো। সুতরাং, মুসলমানদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে সিমলা ডেপুটেশন গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

Leave a Comment