লর্ড ডালহৌসি কি প্রকৃতই আধুনিক ভারতের জনক ছিলেন?,ভারতে স্থানীয় স্বশাসনের জনক হিসাবে লর্ড ডালহৌসি মনে করা হয়?, আধুনিক ভারতের জনক লর্ড ডালহৌসি

লর্ড ডালহৌসি কি প্রকৃতই আধুনিক ভারতের জনক ছিলেন?,ভারতে স্থানীয় স্বশাসনের জনক হিসাবে লর্ড ডালহৌসি মনে করা হয়?, আধুনিক ভারতের জনক লর্ড ডালহৌসি


ভূমিকা ঃ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল নিছক একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান পরে ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করেছিল। ফলে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়। ভারতবর্ষে শাসন ক্ষেত্রে কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে পরে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য একাধিক গভর্নর ও গভর্নর জেনারেল ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছিলেন। এ প্রেরিত গভর্নর জেনারেলরা কোম্পানির স্বার্থে বিভিন্ন জন বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে ভারতে আসেন। এ ধারাবাহিকতায় লর্ড ডালহৌসি ১৮৪৮ সালে ভারতে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন। লর্ড ডালহৌসি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী ব্যক্তি। তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বার্থে সবকিছু করতে রাজি ছিলেন।

লর্ড ডালহৌসির প্রাথমিক পরিচিতি : ১৮৪৮ সালে লর্ড ডালহৌসি যখন ভারতবর্ষে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৬ বছর। ভারতে আসার আগে তিনি ইংল্যান্ডের বোর্ড অব ট্রেডের সহ-সভাপতি হিসেবে প্রশাসনকার্যে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। স্কচ জাতির স্বভাবসুলভ বাস্তবতাবোধের সাথে তিনি তাঁর অভিজাতসুলভ ঔদ্ধত্যকে যুক্ত করে তাঁর ব্যক্তিত্বকে বৈশিষ্ট্য দেন।

তিনি যে নীতি গ্রহণ করেন তা কার্যকরী করার জন্য অপরিসীম উদ্যম ও কঠোর পরিশ্রম করতে পারতেন। তাই ভারতবর্ষে গভর্নর জেনারেল হিসেবে তিনি সংস্কারকার্যে মনোনিবেশ করেন। ডালহৌসির সংস্কারসমূহ ঃ ভারতীয় ইতিহাসে লর্ড ডালহৌসি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের একনিষ্ঠ ধারক ও বাহক এবং স্বত্ব বিলোপ নীতির প্রয়োগকর্তা হিসেবে সমধিক খ্যাতি বা কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

এ সকল সাম্রাজ্যবাদী কাজের ফলে তাঁর সুযৌক্তিক ও জনহিতকর সংস্কারগুলো সাধারণত আমাদের মতে, তেমন স্থান পায় না। কিন্তু কতকগুলো সংস্কার সাধনের জন্য লর্ড ডালহৌসি ভারতবাসীর কৃতজ্ঞতা স্বাভাবিকভাবে আশা করতে পারেন। তাঁর সংস্কারগুলো ছিল যথাক্রমে :

১. সেনাবাহিনীর সংস্কার: সেনাবাহিনীর মধ্যে তখন সমুদ্র যাত্রা জাতিগত পবিত্রতা বিনাশের কারণ হিসেবে বিবেচিত হতো। লর্ড ডালহৌসি এ অযৌক্তিক কুসংস্কার হতে ভারতীয় সৈনিকদেরকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এমন একটি ব্যবস্থা চালু করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন যাতে প্রত্যেক সুস্থ সবল ব্যক্তিই সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে এবং পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত হবে। সে সময়কার বাংলার সৈনিকদের সামরিক যোগ্যতার অভাব দৃষ্টে তিনি এ ব্যবস্থা চালু করার পক্ষপাতী ছিলেন।


২. শিক্ষা সংস্কার : ডালহৌসি শিক্ষা ক্ষেত্রেও সংস্কার সাধন করেন। তিনি তাঁর শাসনামলে বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি স্যার চার্লস উডের ১৮৫৪ সালের ডেসপ্যাচকে কার্যকরী করার উদ্যোগ নেন। তাঁর আমলে বিদ্যালয়গুলোকে গ্রান্ট ইন এইড প্রদানের ব্যবস্থা করা হয় এবং বেশ কয়েকটি কলেজ স্থাপিত হয়। তিনি প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের চেষ্টা করেন। উড়ের ডেচপ্যাচে কলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বাইয়ে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। লর্ড ডালহৌসির ভারত ত্যাগের পর এ সুপারিশ কার্যকরী হয়। তিনি করকীর কারিগরি বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন করেন।


৩. পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সংস্কার : লর্ড ডালহৌসির আমলকে ভারতে পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের যুগ বলা চলে। লর্ড ডালহৌসি ভারতে পশ্চিমা সভ্যতা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রবর্তন করাকে তাঁর শাসনকালের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেন। তবে এতে তাঁর সম্রোজ্যবাদী স্বার্থ ছিল। কারণ, ভারতের তথাকথিত আধুনিকীকরণ বা পশ্চিমীকরণ দ্বারা ভারতের সম্পদ অপহরণ করাই ছিল তাঁর সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য। ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন দ্বারা গ্রামাঞ্চলের বাজারগুলোতে ব্রিটিশ পণ্য বিক্রির জন্য উন্মুক্ত করা ছিল তাঁর অন্যতম লক্ষ্য।

এছাড়া সামরিক প্রয়োজন ও সেনা চলাচলের কাজকে ত্বরান্বিত করারও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। এছাড়া তিনি রাস্তাঘাট নির্মাণ কাজে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য ১৮৫৪ সালে Public Works Department স্থাপন করেন। এ দপ্তর গঙ্গা খালের কাজ সমাপ্ত করেছিল। কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত গ্রাট্রাংক রোড প্রসারিত হয়। তিনি ভারত ছাড়ার আগে ভারতের বড় বড় শহরগুলোর মধ্যে সড়ক পথে যোগাযোগ স্থাপনের এক পরিকল্পনা রচনা করেন। ডালহৌসি পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হিসেবে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন।

১৮৫৩ সালে তিনি এক স্মারকলিপিতে পরিচালকসভার কাছে রেলপথ ভারতে তৈরি হলে কি সুবিধা হবে সে সম্পর্কে রিপোর্ট দেন। এতে তিনি বলেন,

ক. সামরিক স্বার্থরক্ষা, দ্রুত সেনা চলাচল ও সমরোপকরণ পাঠানোর সুবিধাঃ

খ, ভারতে ব্রিটিশ বাণিজ্য ও পণ্যের দ্রুত পরিবহণ এবং বন্দর থেকে দেশের অভ্যন্তরে পাঠাবার সুবিধা;

গ. গ্রামাঞ্চল থেকে পাট, নীল, লোহা প্রভৃতি কাঁচামাল শহরে ও বন্দরে আনার সুবিধা:

ঘ. রেল নির্মাণে ব্রিটেনের উদ্বৃত্ত মূলধনের বিনিয়োগ দ্বারা ব্রিটিশ মূলধনীদের লাভের ব্যবস্থা। রেলপথ নির্মাণ দ্বারা-এ চারটি প্রধান স্বার্থরক্ষা হবে। ফলে ডালহৌসির সময় রেল এবং রেলপথ নির্মিত হয়। বোম্বাই থেকে পুনা ছিল ভারতের প্রথম রেলপথ। তার পরে কলকাতা-রাণীগঞ্জ ছিল দ্বিতীয় রেলপথ। ফলে ভারতের ব্যবসায়-বাণিজ্যে সুবিধা হয়।


৪. প্রশাসন/শাসন সংস্কার : বাংলাদেশের প্রশাসনিক দায়িত্ব তখন পর্যন্ত গভর্নর জেনারেলের অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল। লর্ড ডালহৌসির চেষ্টায় বাংলার জন্য একজন পৃথক লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগ করা হয়। তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভার স্বাধীন কার্যকলাপের পক্ষপাতী ছিলেন এবং বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতির সাথে এ বিষয়ে বাক্ বিতণ্ডা করতেও তিনি পশ্চাৎপদ হন নি। ভারতবাসী একদিন নিজেদের শাসনে আইন প্রণয়ন নিজেরা করবে এ কল্পনা তিনি করতেন এবং এ পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেন। পাঞ্জাবের উন্নতির জন্য তিনি জন লরেন্স ও আরো কয়েকজন দক্ষ প্রশাসক নিয়োগ করেন, যারা পাঞ্জাবের বিশেষ উন্নতি সাধন করেন।


৫. ডাক বিভাগের সংস্কার : লর্ড ডালহৌসি ডাক বিভাগের সংস্কার সাধন করেন। তিনি কলকাতা থেকে আগ্রা পর্যন্ত প্রথম টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা ও পেনি পোস্টকার্ড-এর প্রচলন করেন। এর ফলে অফিসের কাজকর্মে যে অযথা বিলম্ব ঘটত তার অনেক দূরীভূত হয়ে জরুরি বিষয়াদি সম্পর্কে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত প্রেরণ করা সম্ভব হল । ৬. বিবিধ : তিনি বনভূমি সংরক্ষণ নীতি প্রবর্তন করে প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক আবহাওয়া বজায় রেখে উপযুক্ত বারিপাতের সুযোগ যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য ব্যবস্থা করেন। তিনি চা বাগানের প্রসার সাধনে যথেষ্ট উৎসাহ দেখান। মেরিয়া নামক এক সমাজ বিরোধী দলের অত্যাচারে বিভিন্ন অঞ্চলে ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছিল। ডালহৌসির আমলে এ মেরিয়া উপদ্রবের অবসান ঘটলে দেশে ভীতি দূর হয়। এছাড়া তিনি অনেক ক্ষেত্রে যে যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দেন তা তাঁকে ভারতে স্মরণীয় করেছে। তবে এসবই ছিল কোম্পানির স্বার্থে ।

মূল্যায়ন : লর্ড ডালহৌসি গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব নিয়ে যে সংস্কারসমূহ সম্পাদন করেন তা ছিল অনেকটা কোম্পানির স্বার্থে। তবে এগুলো তাঁর কাছে ভালো উদ্যোগ হলেও সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিল না। অনেকে তাঁর সংস্কার কার্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যদিও ভারতবাসী তাঁর সংস্কার দ্বারা উপকৃত হয় তা ছিল তাঁর সংস্কারের পরোক্ষ ও অপ্রত্যাশিত ফল। তিনি যে প্রকৃতই ভারত দরদী ছিলেন তাঁর প্রমাণ অত্যন্ত ক্ষীণ। যে ক্ষেত্রে ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে রেলপথ প্রবর্তন সেসকল দেশের শিল্প বিপ্লব ও আধুনিকীকরণের প্রধান কারণ ছিল। ভারতের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ যুগে রেলপথ স্থাপন দ্বারা ভারতের অনুরূপ উন্নতি হয় নি। এ যুগে রেলপথ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে সুরক্ষিত করার হাতিয়ার। ইংল্যান্ডের কলে তৈরি সস্তা মাল এ রেলযোগে ভারতের গ্রামেগঞ্জে পরিবহণ করা এবং গ্রামাঞ্চল থেকে কাঁচামাল রপ্তানির জন্য বন্দরে পরিবহণ করাই ছিল রেলপথ নির্মাণের লক্ষ্য। রেলযোগে দূর দূরান্তে সেনাদল পাঠানোও যেত। ডালহৌসি যদি প্রকৃতই ভারতীয় প্রজাদের মঙ্গল চাইতেন তাহলে তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রায়তওয়ারী বন্দোবস্তের ত্রুটিগুলো দূর করতেন।


অযোধ্যায় নতুন করে রাজস্ব ধার্য করার সময় করের হার কমাতেন। তিনি ভারতে শিল্প বিস্তারের চেষ্টা করেন নি। এসকল কাজ না করায় তাঁর সংস্কারের ফল জনসাধারণের কাছে পৌঁছায় নি। তিনি ভারতীয় সভ্যতাকে নীচু চোখে দেখতেন। ভারতবাসীর সভ্যতাকে ঘৃণা করে ভারতবাসীকে প্রকৃতই ভালবাসা সম্ভব ছিল না। ম্যাশম্যান এজন্য ডালহৌসিকে আলোকপ্রাপ্ত স্বৈরাচারী বলে অভিহিত করেছেন। ভারতীয় সভ্যতাকে তুচ্ছ করে ও ভারতীয় জনমতকে অগ্রাহ্য করে তিনি ইম্পিরিয়েল চরিত্রের পরিচয় দেন। এজন্য তিনি ভারতবাসীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা লাভে বঞ্চিত হন। ডালহৌসি তাঁর রাজা অধিগ্রহণ ও উপর থেকে কর চাপিয়ে দেওয়া সংস্কারকে ঠিক কোথায় থামিয়ে দেওয়া উচিত সে মাত্রাজ্ঞান রাখতেন না। সাম্রাজ্যবাদ ও সংস্কারের গর্ব, ভারতবর্ষ সম্পর্কে নৈতিক দায়িত্ববোধ তাঁকে দাম্ভিক করেছিল। তিনি অত্যন্ত দ্রুত ও অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী কাজে লিপ্ত হন। ধর্ম প্রচারকরা যেরূপ নৈতিক বিশ্বাস নিয়ে কাজ করেন তিনিও তাই করতেন। ভারতবাসী তা পছন্দ করবে কিনা তা তিনি দেখতেন না। এর ফলে তিনি ভারতবর্ষকে এক গভীর বিপদে ফেলে দেন।


উপসংহার ঃ অতএব বলা যায়, ভারতবর্ষে কোম্পানি শাসনের ইতিহাসে লর্ড ডালহৌসি ছিলেন ঘোর সাম্রাজ্যবাদী। এ সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবাপন্ন হওয়ায় তাঁর সংস্কার কার্যাদি তেমন গুরুত্ব পায় নি। কারণ, তিনি সাম্রাজ্য বিস্ত ার করার ক্ষেত্রে যে হীন মানসিকতার পরিচয় দেন তা পরে ভালো কাজ করলেও ফুটে উঠা সম্ভব ছিল না। তাই বলা যায়, লর্ড ডালহৌসির যে সংস্কার কার্যাদি তা ছিল তাঁর ভালো উদ্যোগ। এতে কোম্পানির স্বার্থ থাকলেও প্রকারান্তরে ভারতবাসীর কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। তাই তিনি কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে তুলনামূলক প্রশংসার দাবিদার। এছাড়া তাঁর সংস্কার কার্যাদি ভারতের জনসাধারণের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন সূচিত করেছিল।

Leave a Comment