পাইকারী ব্যবসায় কাকে বলে । পাইকারী ব্যবসায় কত প্রকার ও কি কি । পাইকারী ব্যবসায় সুবিধা ও অসুবিধা । পাইকারী ব্যবসায় গুরুত্ব
পাইকারী ব্যবসায় কাকে বলে । পাইকারী ব্যবসায় কত প্রকার ও কি কি । পাইকারী ব্যবসায় সুবিধা ও অসুবিধা । পাইকারী ব্যবসায় গুরুত্ব
পাইকারী ব্যবসায় কাকে বলে :-
খুচরা ব্যবসায়ীদের মতো পাইকার বিপণন প্রণালির গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থ ব্যবসায়ী। খুচরা ব্যবসায়ীরা পণ্যদ্রব্য চূড়ান্ত ভোক্তাদের নিকট বিক্রয় করে, অন্যদিকে পাইকারি ব্যবসায় বলতে পণ্যদ্রব্য ও সেবা পুনঃ বিক্রয় বা ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহারকারীদের কাছে বিক্রয় করাকে বোঝায়। যে ব্যক্তি পাইকারি ব্যবসায়ের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করে তাকে পাইকার বা Wholesaler বলে।
অন্য ভাবে বলা যায়, উৎপাদকের নিকট থেকে বেশি পরিমাণে পণ্য ক্রয় করে খুচরা ব্যবসায়ীর নিকট অল্প পরিমাণে পণ্য বিক্রয় করার কাজকে পাইকারী ব্যবসায় বলা হয়।
পাইকারী ব্যবসায় উৎপাদক এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি যোগসূত্রে হিসেবে কাজ করে এবং প্রথম পক্ষের নিকট থেকে পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ করার পর তা দ্বিতীয় পক্ষের নিকট সরবরাহ করে। চূড়ান্ত ভোগকারীর নিকট পণ্য বিক্রয় করা হলে তাকে পাইকারী ব্যবসায়ী বলা যাবে না। পাইকারী ব্যবসায়ী একজন উৎপাদকও নন কিংবা একজন খুচরা কারবারীও নন; বরং তিনি এ দুইয়ের মাঝে একটি সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেন।
William J. Stanton পাইকারি ব্যবসায়ের যে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তা হলো, “Wholesaling includes the sale, and all activities directly incidental to the sale of products or services to those who are buying for resale or for business use.”
অর্থাৎ যারা পুনঃ বিক্রয় বা ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহারের জন্য ক্রয় করে তাদের নিকট পণ্য বা সেবা বিক্রয় করা ও বিক্রয় সংক্রান্ত কার্যাবলী সম্পাদন করাকে পাইকারী ব্যবসায় বলে।
Philip Kotler & Gary Armstrong এর মতে, “Wholesaling includes all the activities involved in selling goods or services to those who are buying for purposes of resell or business use.”
অর্থাৎ পাইকারি ব্যবসায় বলতে পুনরায় বিক্রয় করার জন্য অথবা বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য পণ্য বা সেবা ক্রয় করে খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রয়ের সকল কাজকে বোঝায়।
পরিশেষে বলা যায়, যে ব্যবসায়ীরা দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনকারী অথবা আমদানিকরকের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করে খুচরা ব্যবসায়ী অথবা শিল্পীয় ব্যবহারকারীদের কাছে বিক্রয় করে, তাদেরকে পাইকারী ব্যবসায়ী বলে।
পাইকারী ব্যবসায়ী কত প্রকার ও কি কি :-
১. বণিক পাইকার (Merchant Wholesalers) :-
বণিক পাইকার তাদেরকেই বলা হয় যারা স্বাধীনভাবে নিজেদের পাইকারি ব্যবসায় পরিচালনা করে এবং ব্যবসায়ে ব্যবহৃত পণ্যদ্রব্যের মালিকানা লাভ করে। অর্থাৎ যে সকল স্বাধীন পাইকারি ব্যবসায়ী পণ্যের মালিকানা গ্রহণ করে এবং পণ্যের যাবতীয় ঝুঁকি গ্রহণ করার সাথে সাথে ওই পণ্যের খুচরা ব্যবসায়ী বা শিল্পীয় ব্যবহারকারীর নিকট বিক্রয় করে তাকে বণিক পাইকারি ব্যবসায়ী বলে।
এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, তারা যেসব পণ্যের লেনদেন করে সেগুলোর স্বত্ব নিজের হাতে রাখে। সব দেশেই বণিক পাইকারের সংখ্যা অন্যান্য পাইকারের তুলানায় বেশি। বণিক পাইকারকে দুটি উপ-শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়।
(ক) পূর্ণ সেবাদানকারী বণিক (Full-service Wholesalers) :-
যে সকল পাইকারি ব্যবসায়ীরা পাইকারি ব্যবসায়ের প্রায় সকল প্রকার সেবা প্রদান করে তাকে পূর্ণ সেবাদানকারী পাইকারি ব্যবসায়ী বলে। যেমন: পণ্য মজুদকরণ, বাকিতে বিক্রয়, পণ্য সরবরাহ করা। তাদেরকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়ঃ
(i) পাইকার বণিক (Wholesale Merchants) :-
পাইকার বণিকরা প্রধানত খুচরা ব্যবসায়দের নিকট পণ্য বিক্রয় করে এবং সর্ব প্রকার সেবা প্রদান করে থাকে।
(ii) শিল্প-পরিবেশক (Industrial Distributors) :-
এ শ্রেণীর বণিকগণ সাধারণত শিল্প পণ্যের পাইকারি কারবার করে। তারা শুধুমাত্রশিল্প পণ্য ব্যবহারকারীদের নিকট পণ্যসামগ্রী বিক্রয় করে।
(খ) সীমিত সেবাদানকারী বণিক (Limited Service Wholesalers) :-
যে সকল পাইকারি ব্যবসায়ীরা পণ্যের মালিকানা লাভ করলেও পাইকারি ব্যবসায়ের অন্যান্য কার্যাবলি যেমন পণ্য সরবরাহ, ঋণ প্রদান, মজুদ পণ্য নিয়ন্ত্রণ, বাজার তথ্য সরবরাহ ইত্যাদি কার্য সম্পাদন করে না তাদেরকে সীমিত সেবাদানকারী পাইকারি ব্যবসায়ী বলে।
(i) নগদ পাইকার (Cash and Carry Wholesalers) :-
এরা খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট নগদ ছাড়া বাকিতে পণ্য বিক্র করে না এবং খুচরা কারবারিরই বরং পাইকারের দোকানে বিক্রিত পণ্য পৌঁছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে না। খুচরা কারবারিই বরং পাইকারের দোকানে গিয়ে নগদ টাকায় দ্রব্যসামগ্রী জন্য করে এবং নিজের খরচে ক্রীত সামগ্রী নিয়ে আসে।
(ii) ট্রাক পাইকার (Truck Wholesalers) :-
এরা ট্রাক জবাব নামেও পরিচিত। এরা প্রধানত বিক্রয়ের সাথে সাথে পণ্য ডেলিভারী দিয়ে থাকে। তারা পচনশীল বা আধা পচনশীল পণ্য (যেমন দুধ, মাছ, রুটি জাতীয় দিয়ে থাকে) ট্রাকে বা ভ্যানে বহন করে বিভিন্ন মার্কেট বা মহল্লায় গিয়ে দোকানে দোকানে বিক্রি করে।
[ বি:দ্র: উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)]
(iii) ড্রপ-শিপার (Drop Shippers) :-
এরা বড় বড় শিল্প-কারখানার সাথে জড়িত থেকে পাইকারি ব্যবসায় চালায়। তারা নিজেরা মাল স্টকে রাখে না কিংবা মাল পরিবহনও করে না। তারা কোন গ্রাহকের নিকট থেকে ফরমায়েশ পাওয়ার পর একজন সরবরাহকারী খুঁজে বের করে এবং তাদেরকেই নির্দিষ্ট শর্ত মোতাবেক গ্রাহকের নিকট যথাসময়ে পণ্য পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়। তবে ফরমায়েশ প্রাপ্তির সময় থেকে আরম্ভ করে ডেলিভারী দেয়া পর্যন্ত সরবরাহকৃত পণ্যের স্বত্ব ও ঝুঁকি গ্রহণ করে। এদের পন্য মজুদ করে রাখতে হয় না বলে খরচ কম পড়ে। ফলে তারা গ্রাহকদেরকেও কম খরচে সরবরাহ করতে পারে।
(iv) র্যাক জবার (Rack Jobbers) :-
র্যাক জবারগণ এমন এক ধরনের পাইকার যারা খাদ্যবস্তু নয় এমন পণ্যের ব্যবসায় করে। তারা প্রধানত, মুদি ও ওষুধের খুচরা কারবারিদের নিকট পণ্য বিক্রয় করে। তারা দোকানে দোকানে ডেলিভারী ট্রাক বা ভ্যান পাঠিয়ে পণ্য সরবরাহ করে। তারা পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে এবং স্টকের হিসাব রাখে। র্যাক জবারগণ খুচরা ব্যবসায়ীকে শুধুমাত্র ভোক্তার নিকট বিক্রিত পণ্যের বিল পরিশোধের জন্যই অনুরোধ করে। তবে অবিক্রিত পণ্যের স্বত্ব জবারেরই থেকে যায়।
(v) উৎপাদকদের সমবায় (Producers’ Cooperatives) :-
উৎপাদনকারীরা সমবায় সমিতি গঠন করে স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য শস্যাদি একস্থানে একত্রিত করে।
(vi) ডাকযোগে ফরমায়েশদানকারী পাইকার (Mail order Wholesalers) :-
এ ধরনের পাইকারগণ খুচরা দোকানদার, শিল্পীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকদের নিকট অল্প ওজনের বিভিন্ন সামগ্রীর মূল্য তালিকা পাঠায় এবং ফরমায়েশ গ্রহণ করে। ফরমায়েশ অনুযায়ী তারা গ্রাহকের ঠিকানায় পণ্যসামগ্রী ডাকযোগে কিংবা অন্য কোন পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়।
২. দালাল (Brokers) :-
যে মধ্যস্থ ব্যবসায়ী ক্রেতা-বিক্রেতাকে একত্র করে একটি সমঝোতা চুক্তির ভিত্তিতে ক্রয় বিক্রয়ে সহায়তা করে তাদেরকে দালাল বলে। দালালরা সাধারণত পণ্য মজুদ বা সংরক্ষণ করে না, পণ্যের মালিকানা লাভ করে না, অর্থসংস্থান করে না, ঝুঁকি গ্রহণ করে না ইত্যাদি।
৩. প্রতিনিধি (Agents) :-
যে সকল পাইকারি ব্যবসায়ী পণ্যের মালিকানা গ্রহণ করে না কিন্তু প্রদত্ত সেবার জন্য কমিশন আদায় করে দালালের তুলনায় দীর্ঘমেয়াদি সেবা প্রদান করে তাদেরকে প্রতিনিধি বলে। প্রতিনিধিকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: ১. উৎপাদনকারীর প্রতিনিধি, ২. বিক্রয় প্রতিনিধি, ৩. ক্রয় প্রতিনিধি এবং ৪, কমিশন মার্চেন্ট।
(ক) উৎপাদকের প্রতিনিধি (Manufacturers Agents) :-
তারা একই রকম পণ্যের একাধিক উৎপাদকের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রত্যেক উৎপাদকের সাথে তাদের আনুষ্ঠানিক চুক্তি থাকে, যার মধ্যে পণ্যের বিক্রয় মূল্যসহ কর্ম এলাকা ওয়ারেন্টি, কমিশনের রেট ইত্যাদি উল্লেখ করা হয়। এসব প্রতিনিধিদের পণ্য বিক্রয়ে বিশেষ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকে।
এজেন্টরা সাধারণত একটি ক্ষুদ্র অফিস স্থাপন করে সেখানে স্বল্প সংখ্যক দক্ষ বিক্রয়কর্মী নিয়োগ করে। যেসব উৎপাদক ফুল-টাইম বিক্রয়কর্মী নিয়োগ করে পণ্য বিক্রি করতে ইচ্ছুক নয়, সাধারণত তারাই প্রতিনিধির সেবা গ্রহণ করে থাকে।
(খ) বিক্রয় প্রতিনিধি (Selling Agents) :-
এরা কোন উৎপাদকের সমর্থ উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের জন্য উৎপাদকের সাথে চুক্তিবন্ধ হয় এবং ক্রেতা সংগ্রহ করার পর তার সাথে পণ্য বিক্রয়ের জন্য দর-কষাকষি করে।
(গ) ক্রয় প্রতিনিধি (Buying Agents) :-
এরা পণ্য ক্রেতার পক্ষ হয়ে ক্রয় কার্যে সহায়তা করে।
(ঘ) কমিশন মার্চেন্ট (Commission Merchant) :-
এরা উৎপাদকের নিকট থেকে পণ্যসামগ্রী নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে এবং পরবর্তীতে ক্রেতার সাথে বিক্রয়ের ব্যাপারে দর-কষাকষি করে।
৪. উৎপাদকদের পাইকার (Manufacturers Wholesalers) :-
উৎপাদক পাইকারের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি না করে বিভিন্নভাবে পণ্য বিতরণের কাজে নিযুক্ত থাকতে পারে; তা নিম্নরূপঃ
(ক) উৎপাদকদের বিক্রয় শাখা (Manufacturers’ Sales Branches) :-
কোন কোন উৎপাদক পাইকারের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি না করে বিভিন্ন স্থানে নিজস্ব বিক্রয় শাখা (Branch) খুলে পণ্য পাইকারি হারে বিক্রয় কর। বিক্রয় শাখায় পণ্য মজুদ রাখা হয় এবং শাখার মাধ্যমে বিক্রয় মজুদ নিয়ন্ত্রণ ও বিজ্ঞাপনের কাজ চালানো হয়।
(খ) উৎপাদকদের বিক্রয় অফিস (Manufacturers Sales Offices) :-
অনেক উৎপাদক স্বাধীন পাইকারের পরিবর্তে নিজেরা বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রয়-অফিস খুলে পাইকারি কার্যাবলি সম্পাদন করে। এ অফিসগুলো আলাদাভাবে পরিচালনা করা হয়। তবে বিক্রয় অফিসে পণ্য মজুদ রাখা হয় না। গ্রাহকের সাথে চুক্তি সম্পন্ন হবার পর গুদামঘর বা কারখানা থেকে সরাসরি পণ্য গ্রাহকের নিকট সরবরাহ করা হয়।
৫. বিবিধ পাইকার (Miscellaneous Wholesalers) :-
কতিপয় বিশেষায়িত শ্রেণীর পাইকারদের অস্তিত্বও দেখতে পাওয়া যায়-
(ক) কৃষি সমাবেশক (Agricultural Assemblers) :-
এরা কৃষকদের নিকট থেকে কৃষিজ পণ্য সংগ্রহ করে বিরাট মজুদ গড়ে তোলে এবং বড় বড় লটে ধান কল, আটার কল, পাট কল, সরকারী ক্রয়কেন্দ্র ইত্যাদির নিকট বিক্রয় করে।
(খ) নীলাম কোম্পানি ( Auction Companies) :-
যেসব শিল্পে ক্রেতারা পণ্য ক্রয়ের পূর্বে পণ্য দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে চায় সেখানে নীলাম কোম্পনিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নীলাম কোম্পানি নীলামের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ডাককারীর (Bidder) নিকট পণ্য বিক্রয় করে।
(গ) বিশেষায়িত পাইকার (Specialised / Speciality Wholesaler) :-
বিশেষায়িত পাইকার একটি বিশেষ পণ্যের পাইকারি ব্যবসায়ে নিয়োজিত থাকে।
(ঘ) সাধারণ পাইকার (General Wholesaler) :-
সাধারণ পাইকার বিভিন্ন রকমের পণ্যের ব্যবসায় করে থাকে।
(ঙ) নগদ পাইকার (Cash and Carry Wholesaler) :-
নগদ পাইকার তাদেরকেই বলা হয় যারা নগদে ছাড়া বাকিতে পণ্যের পাইকারি লেনদেন করে না।
(চ) জাতীয় পাইকার (National Wholesaler) :-
সমগ্র দেশে পাইকারি ব্যবসায়ের পরিধি সম্প্রসারিত করে যারা ব্যবসায় চালায় তাদেরকে জাতীয় পাইকার বলে।
(ছ) আঞ্চলিক পাইকার (Regional Wholesaler) :-
আঞ্চলিক পাইকারদের ব্যবসায় একটি বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে।
(জ) স্থানীয় পাইকার (Local Wholesaler) :-
স্থানীয় পাইকারগণ তাদের ব্যবসায় তাদের নিজস্ব ক্ষুদ্র এলাকা (যথা গ্রাম, হাট-বাজার বা শহরের বাইরে সম্প্রসারিত করে না)।