৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণ
১৯৭০ সালের নির্বাচন অবিভক্ত পাকিস্ত পানের প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন ছিল। কেননা, পাকিস্তানের তেইশ বছরে প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথম দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে।
১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের আগে শুধু প্রাদেশিক নির্বাচন হয় এবং সামরিক শাসনের অধীনে সব নির্বাচন হয় পরোক্ষ ভোটে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের ৭ তারিখ পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ২৯১ টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ ডিসেম্বর হয় প্রাদেশিক পরিষদের ২৭৯টি আসনে।
১৭ জানুয়ারিতে উপকূলীয় এলাকায় ৯টি জাতীয় পরিষদের ও ২১টি প্রাদেশিক পরিষদের আসনে নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। আওয়ামী লীগের এ বিপুল বিজয়ের পিছনে নানা কারণ ছিল-
১. পশ্চিম পাকিস্তানিদের জুলুম-নির্যাতন : শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকে পূর্ব বাংলার মানুষের উপর যে জুলুম, নির্যাতন ও বৈষম্য বঞ্চনা করেছিল, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি ব্যালটের মাধ্যমে আস্থা জানিয়ে এর জবাব দেওয়া হয়।
২. নির্বাচনি ইশতেহার : আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে এ অঞ্চলের আপামর জনতার প্রাণের দাবি প্রতিফলিত হওয়ায় তারা এর দ্বারা বিপুলভাবে আকৃষ্ট হয় এবং আওয়ামী লীগের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন ব্যক্ত করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণ
৩. ইসলামি আদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শন : নির্বাচনি প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু ইসলামি আদর্শের প্রতি সম্মান দেখানোতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করতে ভূমিকা রাখে ।
৪: মুজিবের নেতৃত্ব : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পিছনে দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত ইমেজও বিশেষভাবে কাজ করেছিল। তার সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ নেতৃত্বসুলভ গুণাবলি এবং ক্ষুরধার প্রাঞ্জল বক্তৃতা মানুষকে সহজেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেছিল ।
ফলে জনতা তার দল আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে প্রকারান্তরে তার প্রতিই শ্রদ্ধা জানায়। তদুপরি পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব বাংলায় যে স্বাতন্ত্র্যবাদ ও জাতীয়তাবাদী চেতনা গড়ে উঠেছিল, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে তাও সহায়ক হয়েছিল।
১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মূল কারণগুলো কী ছিল?
৫. নির্বাচনে বিলম্ব : ১৯৪৭ সালের প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে ২৩ বছরে কোনো সাধারণ নির্বাচন না হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এমনিতেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলে যায়।
ফলশ্রুতিতে দেশের প্রথম নির্বাচন হিসেবে পূর্ব বাংলার তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার উদ্দেশ্যে উৎসবের আমেজ নিয়ে এ নির্বাচনে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে।
৬. অন্যান্য দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর যে সকল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সাংগঠনিক দিক দিয়ে তার কোনোটিই আওয়মী লীগের মতো এতটা শক্তিশালী ছিল না। যার ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ খুব সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণ
৭. পাক-ভারত যুদ্ধ : ১৯৬৫ সালে সংঘটিত পাক-ভারত যুদ্ধে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলাকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত রেখে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় ঘটে।
এ যুদ্ধের পর পূর্ব বাংলার জনগণ বুঝতে পারে যে, পশ্চিমারা কখনোই বাঙালির জানমালের নিরাপত্তার চিন্তা করে না। তাদের এ চিন্তা-চেতনাও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে ভূমিকা রেখেছিল ।
৮. ছয়-দফা দাবি : আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ তথা ৬-দফা দাবি উত্থাপিত হয়েছিল । এই দাবি উত্থাপনের পর বাঙালি অধিকার সচেতন হয়ে উঠে ।
বাঙালির এ অধিকার সচেতনতা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আরও বেশি পরিপক্কতা লাভ করে। যার ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয় অর্জন করে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের কারণ
৯. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা : তৎকালীন পশ্চিমা । শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে।
পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবসহ অন্যান্য সকল নেতাকে এ মামলা থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানিদের এ ষড়যন্ত্র ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছিল। ধারণা করা হয়, আওয়ামী লীগের বিজয়ের পিছনে এ ষড়যন্ত্র মামলাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ।
১০. ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান ১৯৬৬ সালের ৬-দফা এবং ছাত্রদের ১১ দফার ভিত্তিতে ১৯৬৯ সালে লৌহ মানব আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে যে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ে সেটা গণ-অভ্যুত্থান নামে অভিহিত। মূলত এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই বাঙালিরা পাকিস্তানকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে। বাঙালির এই মানসিক চেতনা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে বাস্তব রূপ লাভ করে। যার ফলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৩ বছরের জুলুম-নির্যাতন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙালি সর্বদাই সংগ্রাম করেছে। সংগ্রামী বাঙালি পুরো পাকিস্তান আমলে কখনোই স্বস্তিতে থাকতে পারেনি।
এমনি এ পরিস্থিতিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষতি সাধন হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ঘূর্ণিঝর পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা এবং ত্রাণ কাজে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।
এতে সারা বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানিদের আরও ঘৃণা করতে থাকে। এই ঘৃণার চরম বহিঃপ্রকাশই হলো ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়।