বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য আলোচনা কর, শেখ মুজিবের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য আলোচনা কর
কোনও রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নির্ভর করে দেশটির নেতৃত্বের রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সফলতার জন্য শুধু শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করলেই হয় না, পররাষ্ট্রনীতির সফল বাস্তবায়নের জন্য থাকতে হয় শক্তিশালী নেতৃত্ব। নীতি ও নেতৃত্ব- এ দুইয়ের ওপরই নির্ভর করে কোনেও রাষ্ট্রের সাফল্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা এর কোনও ব্যতিক্রম দেখি না।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানবিক সমাজের দর্শনে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি স্বাধীনতার পর বিশ্বব্যাপী সেই দর্শন ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল দর্শন নির্ধারণ করলেন- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব।
১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের অগাস্ট পর্যন্ত মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার সময় পেয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এ অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের স্বকীয় অস্তিত্ব জানান দেন তিনি। জাতিসংঘের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে বিশ্বের নিপীড়িত সব গোষ্ঠীর পক্ষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ৭০টির বেশি সহযোগিতামূলক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন বঙ্গবন্ধুর সরকার।
এ সময়েই বাংলাদেশ ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি ও ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইডেন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বুলগেরিয়া, বেলজিয়াম, আলজেরিয়া, নেদারল্যান্ডস, জাতিসংঘ, ইউনিসেফ, ডাব্লিউএফপি, আইডিএ, ইউএনএইচসিআর থেকে কোটি কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের ঋণ, সাহায্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আসতে সক্ষম হন বঙ্গবন্ধু।
এমনকি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে প্রায় ৫০টির মতো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের শতাধিক সফর অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে।
দেশ পুনর্গঠনের জন্য স্বাধীনতাপরবর্তী প্রতিটি দিনেই নতুন উদ্যমে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন বঙ্গবন্ধু। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের একটি সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করা এবং এই দেশকে কল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর প্রথম আন্তর্জাতিক বৈঠক থেকেই এই প্রচেষ্টা শুরু করেন তিনি।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি, পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনে পৌঁছান বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তখন থেকেই তাঁর কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি বৈঠক করলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে।
এছাড়াও সেখানে তিনি লেবার পার্টির নেতা হেরল্ড উইলসন, এমপি পিটার শোর, কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল আর্নল্ড স্মিথসহ অন্যান্য আরো অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আলোচনার মূল বিষয়বস্তুই ছিল- বাংলাদেশ গঠনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ সহযোগিতার প্রসঙ্গ।
এরপর ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে দেশে ফিরলেন। পথিমধ্যে সাইপ্রাসে যাত্রা বিরতিকালে সাইপ্রাসের রাষ্ট্রপতি ম্যাকারিয়াস বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানান।
দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক সংবর্ধনায় লাখো ভারতবাসীর সাথে উপস্থিত ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রিপরিষদের সকল সদস্য। মুক্তিযুদ্ধে সার্বিক সহযোগিতার জন্য তিনি সকল ভারতবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ব্যক্তিগত বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে মার্চের মধ্যে সব ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। ফলে ১২ মার্চ ১৯৭২ তারিখেই সৈন্য প্রত্যাহার সমাপ্ত হয়।
বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি এবং বাংলাদেশের
দেশের মাটিতে পা রেখেই বঙ্গবন্ধু নতুন করে সোনার বাংলা গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। পরের দিনই তিনি অস্থায়ী সাংবিধানিক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে দীর্ঘ প্রতিশ্রুত সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে রচনা করেন নতুন সংবিধান।
সেই সঙ্গে প্রণয়ন করা হয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা হলো বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান: ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়। এ নীতির ভিত্তিতেই আজকের বাংলাদেশ বিশ্ব সমাজের সঙ্গে দৃঢ়তর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কখনও শুধু নিজের দেশের মানুষের কল্যাণের কথাই ভাবেননি। তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন সারা বিশ্বের নিঃস্ব মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘বিশ্বটা দুভাগে বিভক্ত—শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতদের দলে।’
মূলত বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন একজন বিশ্ব নেতা, যিনি সব সময়ই শোষিতদের পক্ষে কথা বলতেন। তাকে তুলনা করা হতো হিমালয়ের সঙ্গে। তিনি আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন; তিনি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বিদেশি শাসনের অবসান চেয়েছেন। তিনি যেমন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন, তেমনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সাইপ্রাস সরকারকে উৎখাতের নিন্দাও করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বিদেশ সফরে ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ভারতের কলকাতায় যান। এর পরে পয়লা মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্রদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতাকারী প্রস্তাবের বিপক্ষে ‘ভেটো’ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিল দেশটি। ক্রেমলিনে তিনি তৎকালীন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল লিওনিদ ব্রেজনেভ এবং প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নির সাথে বাংলাদেশের পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা করেন।
তেসরা মার্চ স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশ-সোভিয়েত অর্থনৈতিক চুক্তি। একই সাথে স্বাক্ষরিত হয় ‘মুজিব-কোসিগিন’ ঘোষণা। এই ঘোষণায় বাংলাদেশের পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন তৎপরতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য-সহায়তার প্রতিশ্রুতির উল্লেখ করা হয়।
১৯৭২ (বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে) ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে আসেন। ওই সফরে দুই দেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদের বন্ধুত্ব, সহযোগিতা এবং শান্তি বিষয়ক একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল, ১৯৭২ সালের এই চার মাসেই বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক সাফল্যে বাংলাদেশের সাথে ভারত, সোভিয়েত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপন হয়। এছাড়া এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে আরও ৫০টিরও অধিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন করে। একই সাথে বাংলাদেশ কমনওয়েলথ, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ পেতে শুরু করে।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ আইএমএফ (১৭ মে), আইএলও (২২ জুন), আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়ন (২০ সেপ্টেম্বর), ইউনেসকো (১৯ অক্টোবর), কলম্বো প্ল্যান (৬ নভেম্বর) ও গ্যাটের (৯ নভেম্বর) সদস্য পদ লাভ করে। ওই বছরের ৮ অগাস্ট বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে আবেদন পাঠায়। দুই দিন পর বঙ্গবন্ধু নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যকে বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য অনুরোধ করে পত্র লেখেন। ২৩ অগাস্ট যুক্তরাজ্য, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়া এক মিলিত প্রস্তাবে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তির জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে জোরালো সুপারিশ করে। তবে চীন ওই প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। যা হোক, শেষ পর্যন্ত ৩০ নভেম্বর সাধারণ পরিষদ প্রস্তাবটি সুপারিশ করে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কমনওয়েলথ অব ন্যাশনস, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা ও জাতিসংঘ। এ ৪টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিটি সম্মেলন ও অধিবেশনগুলোয় বঙ্গবন্ধু ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
বঙ্গবন্ধুর সফল পররাষ্ট্রনীতির স্বীকৃতি
১৯৭৩ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করে। রাষ্ট্র পরিচালনার মাত্র ১ বছর ৪ মাসের মাথায় (২৩ মে) জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কারের এ ঘোষণার মুলে ছিল তার সফল পররাষ্ট্রনীতি ও বিশ্বে শান্তির পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন।
১৯৭৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়ার্ল্ডহেইম গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসেন ২৫ মার্চ।
বঙ্গবন্ধু ২৬-৩১ জুলাই প্রেসিডেন্ট জোসিপ ব্রোজ টিটোর আমন্ত্রণে যুগোস্লাভিয়া সফর করেন। সফরকালে প্রেসিডেন্ট টিটো ন্যাম ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন জানান।
অগাস্টে বঙ্গবন্ধু কানাডায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলনে যোগ দেন। সেপ্টেম্বর তিনি আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত চতুর্থ ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন।
ওই সময় তিনি ফিদেল কাস্ত্রো, বাদশাহ ফয়সাল, প্রেসিডেন্ট টিটো, প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন, প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি, প্রধানমন্ত্রী তাকেদ্দিন স্লথ, প্রেসিডেন্ট জুল্যাস নায়ারে প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন।
বঙ্গবন্ধু সাত দিনের এক সফরে ১৮ অক্টোবর টোকিও গমন করেন। এ সফরকালে তিনি ‘যমুনা সেতু’ নির্মাণে জাপানের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন।
সেই সেতু আজকে ‘বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু’ নামে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে। এ বছর তিনি স্বল্প সময়ের জন্য মালয়েশিয়া সফরেও গিয়েছিলেন।
১৯৭৩ সালের ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ভিয়েতনামের শান্তিচুক্তিকে অভিনন্দন জানান। সেই বছর বাংলাদেশ এডিবি (১৮ ফেব্রুয়ারি), আইসিএও (২৮ ফেব্রুয়ারি), আটিইউ (৮ সেপ্টেম্বর) এবং ফাও (১২ নভেম্বর)-এর সদস্য পদ লাভ করে। ২১ জুলাই বাংলাদেশ সরদার মোহাম্মদ দাউদ খানের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। জুলাই মাসে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারকেও স্বীকৃতি দেয়।
বঙ্গবন্ধু ৬ অক্টোবর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানান। তিনি মিসর ও সিরিয়ায় এক লাখ পাউন্ড চা প্রেরণের নির্দেশ দেন। এবং আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু মিসর ও সিরিয়ায় চিকিৎসকদল পাঠান।
১৯৭৪ সালের শুরুতেই চার দিনের এক সফরে বাংলাদেশে আসেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নরম্যান এরিক কার্ক। যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসিপ ব্রোজ টিটো ২৯ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেন।
ফেব্রুয়ারিতে সফরে আসেন ওআইসি মহাসচিব। ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্থান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর, বঙ্গবন্ধু ইসলামিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য পাকিস্তান গমন করেন।
সেসময় বঙ্গবন্ধু যখন লাহোর বিমানবন্দরে অবতরণ করেন, তখন রাস্তার দু-পাশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের জনগণ শ্লোগান তুলেছে- ‘জিয়ে মুজিব, জিয়ে মুজিব’।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি
মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফরে আসেন। মার্চ মাসে বাংলাদেশে এক সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতিকালে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে আসেন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ইউ নে উইন।
১২ মে পাঁচ দিনের সফরে বঙ্গবন্ধু ভারত যান। এ সফরে দুই দেশের মধ্যে সীমানা চিহ্নিতকরণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এরপর সেনেগালের প্রেসিডেন্ট লিওপোল্ড সেংঘর বাংলাদেশ সফর করেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ১৫ জুন পাঁচ দিনের সফরে ঢাকা আসেন। এ মাসেই বাংলাদেশ সফর করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট নগুয়েন হু থু ঢাকায় এক সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেন।
১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে ১৩৬তম সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে। ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা বাংলায় ভাষণ দেন।
২২ অক্টোবর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রথম অংশগ্রহণ করেই বাংলাদেশ জাতিসংঘ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহিষ্কারের দাবি জানায়। ১৯ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে নামিবিয়া বিষয়ক কমিশনে মনোনয়ন দেয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কূটনৈতিক চিন্তাধারাই
১৯ জুলাই বাংলাদেশ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আর্চবিশপ মাকারিয়সের নেতৃত্বাধীন সাইপ্রাস সরকারকে উৎখাতের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। অগাস্ট মাসে বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয়। ১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এ মাসেই তিনি ইরাক সফরে যান। এর পরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার ঢাকা সফরে আসেন। বঙ্গবন্ধু ৫ নভেম্বর মিসর ও ১০ নভেম্বর কুয়েত সফরে যান।
একই মাসে পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় আসেন। ৩ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার রাজা ঢাকা সফরে আসেন। ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে যান। ডিসেম্বর মাসে ঢাকা সফরে আসেন ভুটানের রাজা এবং এফএও-এর মহাপরিচালক।
১৯৭৫ সালের ১৯ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফরে আসেন। ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সফরে আসেন জাপানের যুবরাজ আকিহিতো। একই মাসে নেপালের রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল নেপাল যায়। মার্চে ঢাকায় আসেন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)-এর প্রেসিডেন্ট।
দুই দিনের সফরে ১৪ মার্চ ঢাকায় আসেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ। ওই মাসে সিডার প্রেসিডেন্টও ঢাকা সফর করেন। ২৭ এপ্রিল কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু জ্যামাইকা যান।
সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু যখন দেশকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিলেন, ঠিক এমনই একটা সময় নেমে এলো ভয়ানক আঁধার। ১৫ অগাস্ট, ১৯৭৫। ইতিহাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন কালো রাত। বর্বর দেশাদ্রোহীদের হামলায় সপরিবারের প্রাণ হারালেন জাতির পিতা।
অশ্রুসিক্ত হলো একটি জাতি, এতিম হলো এই অভাগা দেশ, হতবাক হলো গোটা বিশ্ব। এরপরের সময়গুলোয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও উগ্রবাদের গ্রাসে বিধ্বস্ত হয় সোনার বাংলাদেশ।
দীর্ঘ ২১ বছরের একটি অন্ধকার যুগ পেরিয়ে, ১৯৯৬ সালে আবারো বাংলাদেশের হাল ধরলেন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এলেন বঙ্গবন্ধুর শান্তি ও সমৃদ্ধির আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে।
সম্বিত ফিরে পেল জনগণ। রচিত হলো অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির আরেক মহাকাব্য। সেই ধারাবাহিকতাতেই আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ।
উন্নয়নশীল দেশের গণ্ডি পেরিয়ে উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখানোর জন্য উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় ধাবিত হয়েছে আমাদের প্রাণের দেশ।