থ্যালাসেমিয়া বিশেষ এক রক্তরোগ এবং এ রোগটি বংশগত। সাধারণত জিনগত ত্রুটির কারণে প্রোটিনগুলোর উৎপাদন কমে যায়। আর এতে শরীরে হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন স্বাভাবিক না থাকায় দেখা দেয় থ্যালাসেমিয়া রোগ।
থ্যালাসেমিয়া রোগের কি চিকিৎসা আছে?, থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা আছে, থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎ আছে কি?
থ্যালাসেমিয়া রোগের কি চিকিৎসা আছে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা পদ্ধতি। কিন্তু দেশে এতদিন এ পদ্ধতি ছিল না। রক্ত পরিসঞ্চালন এবং ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা নিতে পারতেন।
Table of Contents
আরো পড়ুন: চোখের রেটিনার গুরুত্ব কী রেটিনার কাজটা কী?
থ্যালাসেমিয়া কী: ১৯৩০ সালে প্রথম ‘থ্যালাসেমিয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। গ্রিক শব্দ ‘Thalassa’ এবং ইংরেজি শব্দ ‘aemia’ সহযোগে থ্যালাসেমিয়া শব্দটি তৈরি। ‘Thalassa’ অর্থ ভূমধ্যসাগরীয় এবং aemia অর্থ ‘রক্তাল্পতা’। ভূমধ্যসাগরের আশেপাশের দেশগুলোতে প্রথম এ রোগ আবিষ্কার হয় বলে এর নামকরণ হয় থ্যালাসেমিয়া। ভূমধ্যসাগর ছাড়া আফ্রিকা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
এতে একজন রোগী ৩০ থেকে ৩৫ বছর বেঁচে থাকতে পারতেন। কিন্তু অ্যালোজেনিক পদ্ধতিতে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে একজন রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
এই রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ চিকিৎসা নিতে একজন রোগীর প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয় হয়।
কারণ: ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জীনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জীন হিমোগ্লোবিনের গ্লোবিন অংশে ত্রুটি সৃষ্টি করে। ফলে লোহিত রক্তকণিকার আয়ু স্বাভাবিক ১২০ দিন থেকে কমে মাত্র ২০-৬০ দিনে নেমে আসে। অপরিপক্ক লোহিত রক্তকণিকার ভাঙনের দরুণ রক্তস্বল্পতা দেখা যায়।
বাবা অথবা মা, অথবা বাবা-মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। বাবা-মা দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, তাহলে শিশুর থ্যালাসেমিয়া নিয়ে ভূমিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ২৫%, বাহক শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা ৫০% আর সুস্থ শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা ২৫%। থ্যালাসেমিয়া রোগের কি চিকিৎসা আছে
ভাই-বোনের (চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো) মধ্যে বিয়ে হলে এবং পরিবারে কারো থ্যালাসেমিয়া থাকলে সন্তান-সন্ততির থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত বা বাহক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
আরো পড়ুন: স্বামী স্ত্রী পরস্পর গোপনাঙ্গের দিকে তাকালে কি স্মৃতি শক্তি নষ্ট হয়ে যায়?,
প্রকার: থ্যালাসেমিয়া প্রধানত ২ ধরনের। যথা- আলফা এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া। ১৬ নম্বর ক্রোমোসমে উপস্থিত ত্রুটিপূর্ণ আলফা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনকারী জীনের ত্রুটির দরুণ আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং ১১ নম্বর ক্রোমোসমে উপস্থিত ত্রুটিপূর্ণ বিটা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনকারী জীনের ত্রুটির দরুণ বিটা থ্যালাসেমিয়া হয়।
আলফা থ্যালাসেমিয়া আবার আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর (হাইড্রপস ফিটালিস) ও আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (হিমোগ্লোবিন-এইচ ডিজিজ/আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট) এ ২ রকম হতে পারে। যেখানে প্রথমটি অনেক মারাত্মক। বিটা থ্যালাসেমিয়া অনুরূপভাবে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর (কুলি’স এনিমিয়া) ও বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (ট্রেইট) ২ রকম হতে পারে।
এক্ষেত্রেও প্রথমটিই মারাত্মক বেশি। থ্যালাসেমিয়া বিভিন্ন হিমোগ্লোবিনোপ্যাথির সাথে একইসাথে সহাবস্থান করতে পারে। এদের মধ্যে আমাদের দেশে প্রধানত হিমোগ্লোবিন-ই বিটা থ্যালাসেমিয়া পাওয়া যায়। সামগ্রিকভাবে বিটা থ্যালাসেমিয়া, আলফা থ্যালাসেমিয়া অপেক্ষা বেশি তীব্র ও মারাত্মক।
আরো পড়ুন: ইচিন ড্রপ ব্যবহার,ইচিন চোখ/নাকের ড্রপ এর ব্যবহার কি কি?
লক্ষণ: বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে জন্মের ২-৩ বছরের মাঝে লক্ষণ প্রকাশ পায়। প্রথমে অবসাদ অনুভব, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, অস্বস্তি প্রভৃতি পরিলক্ষিত হয়। ধীরে ধীরে প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, শরীরে অতিরিক্ত লৌহ জমা হওয়া, সংক্রমণ, অস্বাভাবিক অস্থি, জন্ডিস, গাঢ় রঙের প্রস্রাব, মুখের হাড়ের বিকৃতি, ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি, হৃৎপিণ্ডে সমস্যা ইত্যাদি প্রকাশ পায়।
চিকিৎসা: থ্যালাসেমিয়া মাইনরে (ট্রেইট) সাধারণত কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তবে থ্যালাসেমিয়া মেজরে নিয়মিত রক্তসঞ্চালন হলো প্রধান চিকিৎসা।
তবে বারবার রক্তসঞ্চালনের একটি প্রধান অসুবিধা হলো যকৃতসহ বিবিধ অঙ্গে অতিরিক্ত লৌহ জমে যাওয়া। এ ধরনের জটিলতা প্রতিহতকরণে আয়রন চিলেশন থেরাপি এবং খাদ্যগ্রহণের পর চা পানের অভ্যাসকে উৎসাহিত করা হয়।
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়ার একটি কার্যকরী আধুনিক চিকিৎসা কিন্তু ব্যয়সাপেক্ষ। অনেকসময় প্লীহা বেশি বড় হয়ে গেলে সার্জারির মাধ্যমে প্লীহা অপসারণেরও প্রয়োজন পড়তে পারে।
প্রতিরোধ: থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোকল্পে বিবাহপূর্ব রক্ত পরীক্ষার বিষয়টি উৎসাহিত ও বাহকদের মধ্যে বিবাহ নিরুৎসাহিত করতে হবে। সিবিসি ও হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিসের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার বাহক শনাক্ত করা যায়।
গর্ভস্থ সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত কি-না জানার জন্য ফিটাল ব্লাড স্যাম্পলিং, অ্যামনিওসেনটেসিস, কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং প্রভৃতি পরীক্ষা করা যায়।
তবে এসব পরীক্ষা গর্ভাবস্থার ১৬-১৮ সপ্তাহে করানো উচিত। থ্যালাসেমিয়া নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর ৮ মে ‘বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস’ পালন করা হয়। আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ ও সচেতনতাই পারে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করতে।
কিভাবে হয় এ সংক্রমণ আর কি হয় এ সংক্রমণের ফলে-
* যদি বাবা মায়ের মাঝে কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক না হয়, তাহলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হবার কোন সম্ভাবনা নেই।
* যদি বাবা অথবা মা কেউ একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়ে থাকেন তবে সেক্ষেত্রে শতকরা ৫০ ভাগ সম্ভাবনা থাকে সন্তানের (ছেলে সন্তান, মেয়ে সন্তান সমান হারে) থ্যালাসেমিয়ার বাহক হবার।
* যদি বাবা ও মা দুজনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে শতকরা ২৫ ভাগ সম্ভাবনা থাকে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহনের, শতকরা ৫০ ভাগ সম্ভাবনা থাকে থ্যালাসেমিয়ার বাহক হবার আর বাকি ২৫ ভাগ সম্ভাবনা থাকে সম্পূর্ণ সুস্থ শিশু হিসেবে জন্মগ্রহণের।
শুদের থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ কারণ ও চিকিৎসা, থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করবেন যেভাবে
থ্যালাসেমিয়ার বাহক আর থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত বিষয় দুটি সম্পূর্ণ আলাদা।
যিনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ, শুধু তিনি থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করেন তার শরীরে। থ্যালাসেমিয়ার বাহক আগে থেকে চিহ্নিত করে দুজন থ্যালাসেমিয়ার বাহকের মাঝে বিয়ে বন্ধ করতে পারলে থ্যালাসেমিয়া রোগের বোঝা অনেকাংশে কমানো যায়। থ্যালাসেমিয়া রোগের কি চিকিৎসা আছে
থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহকের সংখ্যা নেহায়েতই কম নয় আমাদের দেশে। যতই থ্যালাসেমিয়া-ডে পালন করা হোক না কেন এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা আশানুরূপ নয়।
সমস্যাটা হয় তখনই যখন বাহক হিসেবে চিহ্নিত করার পর কাউন্সিলিং করা হয় বাবা মাকে।
সব বোঝানোর পর যখন বলা হয় বিয়ের আগে অবশ্যই ছেলে বা মেয়ের হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেসিস (ঐন বষবপঃৎড়ঢ়যড়ৎবংরং) করে জেনে নিতে হবে ছেলে বা মেয়েটি এই রোগের বাহক কিনা! কারণ দুজনেই বাহক হলে তাদের বাচ্চাদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া হতে পারে।
ভেবে দেখেন! আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটা কতটা সম্ভব? একটা বাহক মেয়ের বিয়ের সময় হলে পাত্র পক্ষকে যখন বলা হবে যে তার এই পরীক্ষা করা দরকার সেও বাহক কিনা এটা জানার জন্য। পরিস্থিতিটা কি হবে? কিছু বোঝার আগেই মেয়ে অসুস্থ! এটা সেটা বলে কত অপবাদ দিয়ে বিয়ে তো ভেঙে দিবেই, সঙ্গে আরও কত কি! এই ভয়ে বাবা মা ব্যাপারটা গোপন রাখবে আর ফলশ্রুতিতে রোগের সংখ্যা ও বাড়তে থাকবে। ছেলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
থ্যালাসেমিয়া রোগের কি চিকিৎসা আছে। আমরা নিজেদের যতই শিক্ষিত বলে দাবি করি না কেন, আজও আমাদের মাঝে অনেক ব্যাপারেই কুসংস্কার, গোড়ামি ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে। তাই আমরা চিকিৎসকরা যত সহজে কাউন্সিলিং করি না কেন ব্যাপারটা আসলে এত সহজ নয়।
এর জন্য প্রয়োজন সরকারের তরফ থেকে সহায়তা। সরকার যদি আইনের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক করে দেয় যে বিয়ের আগে প্রত্যেক ছেলে মেয়ের হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফরেসিস করতে হবে, তাহলে ব্যাপারটা অনেক বেশি সহজ হয়ে যাবে। মানুষ জানতে পারবে থ্যালাসেমিয়ার বাহক মানে রোগ না।
সে সম্পূর্ণ সুস্থ। শুধু ২ জন বাহক বিয়ে করলে তাদের বাচ্চাদের থ্যালাসেমিয়া রোগ হতে পারে।আর বাচ্চাদের কারও এই রোগ হলে কি কি সমস্যা হতে পারে সেটা আপামর জনতা জানতে পারলে তারা সতর্ক থাকতে পারবে।
এ লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের পাশাপাশি জেলায়-জেলায় হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেসিসের পরীক্ষার উপকরণ ও নিশ্চিত করতে হবে। চাইলে কোন কিছুই অসম্ভব নয় যার বড় প্রমাণ সরকারের ঊচও প্রোগ্রাম-শুধু দরকার সমন্বিত সচেতনতা ও উদ্যোগ।
পরিশেষে : থ্যালাসেমিয়া রোগের কি চিকিৎসা আছে
আপনার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক আরো কিছু পোস্ট