প্রসব পরবর্তী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, প্রসবের পর জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা,প্রসব পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি

সন্তান জন্মদানের পর পর মায়েরা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে খুব কমই ভাবেন। কিন্তু প্রসব পরবর্তী জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে সচেতন থাকা খুবই জরুরি। 

একটি সন্তান জন্মদানের পর আরেকবার গর্ভধারণের জন্য কিছুটা সময় অপেক্ষা করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা দুটি সন্তানের মাঝে কমপক্ষে ১৮ থেকে ২৪ মাসের বিরতির পরামর্শ দেন।

প্রসব পরবর্তী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, প্রসবের পর জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা,প্রসব পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি

প্রসবের পর ১৮ মাসের কম বিরতিতে পুনরায় গর্ভধারণ করলে তা মা ও শিশুর উভয়ের জন্যই জটিলতা তৈরি করতে পারে বলে গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এমনকি অকাল গর্ভপাত/মিসক্যারেজ কিংবা এবোরশন হয়ে থাকলেও পুনরায় গর্ভধারণের চেষ্টা করার আগে কমপক্ষে ৬ মাস অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে।

প্রসবের কতদিন পর গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে?

অনেক মা মনে করেন ডেলিভারির কয়েক মাস বা সপ্তাহের মধ্যে গর্ভধারণের ঝুঁকি কম থাকে। তবে এটি পুরোপুরি সঠিক নয়। অনেকে আবার মনে করেন প্রসবের পর পিরিয়ড শুরু না হলে পুনরায় গর্ভধারণ হয় না। কিন্তু গর্ভধারণের জন্য পিরিয়ড ফিরে আসা জরুরি নয়।

আপনার দেহ সাধারণত পিরিয়ড শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ আগেই ডিম্বাণু নিঃসরণ করে। একে ডাক্তারি ভাষায় ওভুলেশন বলে। তাই পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগেও আপনি গর্ভধারণ করতে পারেন।

যদি আপনি সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ান কিংবা বুকের দুধের পাশাপাশি ফর্মুলা খাইয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে ডেলিভারির এক মাসের মধ্যেই ওভুলেশন হতে পারে এবং প্রসবের ৬ সপ্তাহের মধ্যেই আপনি পুনরায় মা হতে পারেন।

তাই অপরিকল্পিত গর্ভধারণ এড়িয়ে চলতে প্রসব-পরবর্তী সহবাসের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োজন।

সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সাথে গর্ভধারণের সম্পর্ক

অনেক মা মনে করেন সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ালে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রয়োজন হয় না। বিষয়টি সঠিক নয়। বুকের দুধ খাওয়ালে ওভুলেশন কিছুটা দেরিতে হলেও জন্মবিরতিতে এটি পুরোপুরি কার্যকর নয়।

আরো পড়ুন: শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা

নিচের তিনটি ক্ষেত্রে বুকের দুধ খাওয়ানো হলে পুনরায় গর্ভধারণের ঝুঁকি কম থাকে—

  • আপনার পিরিয়ড যদি পুনরায় শুরু না হয়
  • আপনি যদি সন্তানকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ান বা এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং করেন, অর্থাৎ ফর্মুলা বা অন্য কোনো ধরনের বাড়তি খাবার না দেন
  • আপনার শিশুর বয়স যদি ৬ মাসের কম হয়

তারপরও অপরিকল্পিত গর্ভধারণের ঝুঁকি এড়াতে বুকের দুধ খাওয়ানোর পাশাপাশি যেকোনো একটি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করাটা নিরাপদ।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে পরিকল্পনা করবেন যখন

প্রসবের পর সহবাস শুরুর আগেই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে পরিকল্পনা করে নিন। এমনকি আপনার গর্ভাবস্থার সময়েও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে কথা বলে রাখতে পারেন। অধিকাংশ মা গর্ভাবস্থার শেষে অথবা প্রসবের পর পর এটি নিয়ে আলোচনা করেন।

যদি হাসপাতালে আপনার ডেলিভারি হয় তাহলে হাসপাতাল থেকে বের হবার আগেই আপনার চিকিৎসকের সাথে এটি নিয়ে আলোচনা করে নিন।

এ ছাড়াও ডেলিভারির পরবর্তী চেকআপ এর সময়ই চিকিৎসক আপনাকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করবে। সাধারণত প্রসবের ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ পর এ চেকআপটি হয়ে থাকে। তবে আপনি অন্য যেকোনো সময়ই এ নিয়ে আলোচনা করতে পারবেন।

ডেলিভারির পর যত দ্রুত সম্ভব এ নিয়ে আলোচনা করে নিন। আলোচনার সময় নিচের বিষয়গুলির দিকে লক্ষ্য রাখুন—

  • আপনার পূর্ববর্তী গর্ভাবস্থার অভিজ্ঞতা
  • আপনার ভবিষ্যৎ পরিবার পরিকল্পনা
  • আপনার ও আপনার সঙ্গীর পছন্দ, অপছন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্য
  • পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
  • আপনাদের কোনো শারীরিক সমস্যা অথবা রোগ যদি থেকে থাকে

কখন শুরু করবেন

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কখন থেকে শুরু করবেন সেটি নির্ভর করবে ব্যবহৃত পদ্ধতি, আপনার স্বাচ্ছন্দ্য, দৈনন্দিন জীবন এবং শারীরিক অবস্থার উপর।

দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতিগুলো সন্তান জন্মদানের পর পর ব্যবহার করতে পারেন। আবার কিছু পদ্ধতি (যেমন: কম্বাইন্ড জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি) ব্যবহার এর জন্য অন্তত ৬ সপ্তাহ অপেক্ষা করুন।

প্রচলিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি

বিভিন্ন ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি রয়েছে যেগুলো আপনি ডেলিভারির পর ব্যবহার করতে পারেন—

  • ব্যারিয়ার মেথড: পুরুষ ও মহিলা কনডম, স্পার্মিসাইড, ডায়াফ্রাম, সারভাইকাল ক্যাপ, স্পঞ্জ
  • জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি: মিশ্র বড়ি, প্রজেস্টোরন বড়ি বা মিনিপিল। মিশ্র বড়ি সাধারণত ‘সুখী’ নামে পাওয়া যায়। আর সরকারিভাবে সরবরাহ করা প্রজেস্টোরন বড়ি ‘আপন’ নামে পাওয়া যায়৷
  • জরায়ুতে পরার ইন্ট্রা ইউটেরাইন ডিভাইস: হরমোনের তৈরি বা কপারের তৈরি

ইমপ্ল্যান্ট

  • ইনজেকশন: ডিপো, প্রোভেরা
  • স্টেরিলাইজেশন বা স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি: পুরুষদের ভ্যাসেকটমি, নারীদের টিউবাল লাইগেশন
  • প্রাকৃতিক পদ্ধতি: ল্যাকটেশনাল এমেনোরিয়া

উপরের সবগুলো পদ্ধতিই আপনি ডেলিভারির পর ব্যবহার করতে পারবেন। তবে প্রত্যেকটি পদ্ধতিরই আলাদা কার্যকারিতা ও ব্যবহারবিধি রয়েছে।

সন্তান জন্মদানের পর কি ইমারজেন্সি জন্মনিরোধক পিল খাওয়া যাবে?

আপনার যদি সন্তান জন্মদানের পর ইমারজেন্সি জন্মনিয়ন্ত্রণ এর প্রয়োজন হয়, আপনি নিচের পদ্ধতি গুলো অবলম্বন করতে পারেন—

ইমারজেন্সি পিল: লেভোনোগ্যাস্ট্রল (LNG-ECP) নামের একটি পিল গ্রহণ করতে পারেন। এটিকে অনেকসময় ‘মর্নিং আফটার’ পিলও বলা হয়। এ ধরনের আরেকটি পিল হলো ‘ইউলিপ্রোস্টাল এসিটেট’ (UPA) পিল। সন্তানকে বুকের দুধ পান করালে এ পিল খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।

জরায়ুতে পরার কপার ডিভাইস: আপনি যদি আনপ্রোটেক্টেড বা নিয়ন্ত্রণবিহীন সহবাস করে থাকেন, সেক্ষেত্রে ৫ দিনের মধ্যে এটি ব্যবহার করতে পারেন। এটি আপনাকে ভবিষ্যৎেও জন্মনিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে।

আরো পড়ুন: জরায়ু সংক্রমণ এর কারণ লক্ষণ ও সমাধান,জরায়ু সংক্রমণ ঔষধ

বাছাই এর আগে যেসব বিষয়ে লক্ষ রাখবেন

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বাছাইয়ের আগে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখুন

  • সন্তান: আপনি আর সন্তান চান কি না, চাইলে কতদিন পর চান। আপনি যদি আর সন্তান না চান সেক্ষেত্রে স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন।
  • সময়: কিছু পদ্ধতি সন্তান প্রসব এর পর পরই শুরু করতে হয়, কিছু পদ্ধতি শুরু করতে আপনাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়। কাজেই আপনার পছন্দের সময় অনুযায়ী আপনি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বেছে নিতে পারেন।
  • বুকের দুধ খাওয়ানো: আপনি বাচ্চাকে বুকের দুধপান করালে সব ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আপনার জন্য নিরাপদ নাও হতে পারে। কোনো কোনো পদ্ধতি আপনার বুকের দুধের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
  • কার্যকারিতা: আপনি গর্ভাবস্থার আগে ব্যবহার করেছেন এমন অনেক পদ্ধতিই এখন কার্যকর নাও হতে পারে। যেমন: স্পঞ্জ পদ্ধতি, জরায়ুমুখের ক্যাপ পদ্ধতি।
  • পুনরাবৃত্তি: একটি পদ্ধতি আপনি কতবার পর্যন্ত ব্যবহার করতে চান সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন, কিছু পদ্ধতি আপনাকে প্রতিদিন ব্যবহার করতে হবে। আবার কিছু কিছু পদ্ধতি একবার ব্যবহার আপনাকে মাস কিংবা বছর পর্যন্ত সুরক্ষা দিবে।
  • যৌনবাহিত রোগ: আপনার অথবা আপনার সঙ্গীর যৌনবাহিত রোগ থেকে থাকলে সেটিও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়। যেমন, আপনার সঙ্গী যদি কনডম ব্যবহার করে তা পরস্পর থেকে যৌনবাহিত রোগ সংক্রামণের ঝুঁকি কমায়।
  • অন্যান্য রোগ: সব ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আপনার জন্য নিরাপদ নাও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আপনার যদি কোনো শারীরিক অবস্থা (যেমন: উচ্চ রক্তচাপ) থাকে, তাহলে কিছু কিছু পদ্ধতি এড়িয়ে চলুন।
  • ‘ওভার দা কাউন্টার’ কি না: কিছু কিছু পদ্ধতি আপনি নিজেই প্যাকেটের গায়ে থাকা নির্দেশিকা অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারেন। যেমন: কনডম, স্পার্মিসাইড, স্পঞ্জ পদ্ধতি। তবে কিছু কিছু পদ্ধতি অবলম্বনের জন্য আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ বা নিবিড় তত্বাবধানে থাকতে হতে পারে।

আরো পড়ুন: মেয়েদের যৌন চাহিদা বাড়ানোর ওষুধ

কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন

কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বনের সময় আপনার নিচের লক্ষণগুলির কোনোটি দেখা গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন—

  • এক পা বা উভয় পা ফুলে গেলে
  • শ্বাসকষ্ট হলে
  • বুকে ব্যথা হলে
  • পায়ে স্পর্শ করার সাথে সাথে ব্যথা হলে

এ ছাড়াও কিছু পদ্ধতি ব্যবহারের সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন। এসব পদ্ধতির যেকোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

ইন্ট্রাইউটেরিয়ান ডিভাইস ব্যবহার এর ক্ষেত্রে

  • ডিভাইসটি বের হয়ে আসলে
  • তীব্র, ধারালো পেট ব্যথা হলে
  • প্রস্রাবের সময় রক্ত পরলে
  • দুর্গন্ধযুক্ত যোনিস্রাব হলে
  • সহবাসের সময় ব্যথা হলে
  • ডিভাইসের লম্বা সুতার মতো অংশটি অনুভব করতে না পারলে

পিল, মিনিপিল, প্যাচ, রিং বা ইমপ্ল্যান্ট এর ক্ষেত্রে

  • দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথা হলে যা সময়ের সাথে সেরে যায় না
  • দীর্ঘস্থায়ী বমি হলে
  • দুই পিরিয়ডের মধ্যবর্তী সময়েও যোনিপথে ছোপ ছোপ রক্তপাত হলে

আরো পড়ুন:মাসিকে ব্যথা, মাসিকে ব্যথা থেকে মুক্তি পাবেন এই ঘরোয়া উপায়

পরিশেষে : প্রথম সন্তানের পর জন্মনিয়ন্ত্রণে কোন পদ্ধতি কার্যকর, বাচ্চা হবার ঠিক পর পর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি

আপনার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক আরো কিছু পোস্ট

স্বাস্থ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী ঔষধি গুন গোপন সমস্যা রূপচর্চা রোগ প্রতিরোধ

Leave a Comment